সময়টা হল তথ্য প্রযুক্তির। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও। কিন্তু প্রযুক্তির আশীর্বাদ যেমন আছে তেমনি আছে এর অভিশাপও। অবশ্য তা মানুষেরই সৃষ্টি।
তাই এসব অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বের অনেক দেশেই প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন আইন। তার মধ্যে আজ যে বিষয়টি সব চেয়ে বেশি মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হল ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধ। অনেক সময়ে যা ছড়িয়ে পড়ে খুন-ধর্ষণ-ডাকাতির মতো অপরাধ কার্যক্রমেও!
ক্রমাগত সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ বাড়ার কারণে “তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬” নামে আমাদের দেশে একটি আইন পাশ হয় যা ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়। নিঃসন্দেহে আইনটি সাইবার অপরাধ দমনে ভুমিকা রাখবে এমনটিই আশা ছিল সকল মহলের।
কিন্তু আশানুরূপ ফল আসেনি কারণ আইনটি প্রণয়নের পরেও সাইবার অপরাধ স্বীয় গতিতে যেমন পূর্বের তুলনায় বেড়েই চলছে তেমন পরিবর্তিত হচ্ছে সাইবার অপরাধের ধরণ ও প্রকৃতি যা দমনে আমাদের দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যকরভাবে পেরে উঠছে না।
এই ক্ষেত্রে শুধু মাত্র কঠোর শাস্তির বিধান করেই কোন আইন যে কার্যকর করা যাবে এমনটি আশা করা ঠিক নয়। সাইবার আইন এ দেশে নতুন একটি বিষয়। ফলে এই আইনে বিচার ও তদন্ত করার ক্ষেত্রে যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন, তা তাঁদের অনেকেরই নেই। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেট,কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই ব্যবহার কখন অপরাধ হয়ে যেতে পারে, তার ধারণা অনেকের নেই।
ইতোমধ্যে উল্লেখিত আইনে দেশে অনেক মামলাও হয়েছে ও বিচারাধীন অবস্থায় আছে। কিন্তু কোন ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত। প্রচলিত আইনটিতে আলাদা ট্রাইব্যুনালের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অধিক মামলার ভারে নুয়ে পড়া গতানুগতিক আদালতের মাধ্যমেই বিচার করা হচ্ছে। এতে বিচারকের ওপর অতিরিক্ত মামলার চাপ পড়ে। তথাপি সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ বিষয়ে বিচার করতে বিচারকদেরও প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। যাতে মামলার ফল পেতে একজন ভুক্তভোগীকে যেন আবার ভুক্তে না হয়। “তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬” এর ৬৮(১) ধারায় বলা হয়েছে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের কার্যকর বিচারের উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারবে৷ আর সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে, সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন দায়রা জজ বা একজন অতিরিক্ত দায়রা জজের সমন্বয়ে গঠিত হবে এই ট্রাইব্যুনাল। একই আইনের ৬৮(৬) ধারায় আরও বলা আছে সরকার, আদেশ দ্বারা, যে স্থান বা সময় নির্ধারণ করবে সেই স্থান বা সময়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আসন গ্রহণ করতে পারবে এবং এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।
এই আইনের প্রয়োগ বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ফৌজদারি বা দেওয়ানি বিধির মত হওয়া উচিত নয়। যেহেতু আইন অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় নি। এই আইনের সফল প্রয়োগে কিছু বিধিমালা প্রণয়নের ব্যবস্থা থাকলে অপেক্ষাকৃত ভাল ফল আসত। আইনজীবীরা মনে করেন কোন আইন প্রণয়ন করা হলে তা কার্যকর করতে হলে সেই সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করতে হয় আর সেই সাথে সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয় বিধিমালাও প্রণয়ন করা উচিত। তা না হলে অবস্থা দাঁড়াবে “কাজীর গরু কিতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই” এমন।
বছর কয়েক আগেও ইন্টারনেটে অশ্লীল ছবি বা হুমকি দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সাইবার অপরাধ। কিন্তু এখন নেট ব্যাঙ্কিং চালু হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাঙ্ক জালিয়াতি হচ্ছে ইন্টারনেটে। প্রতারিত হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও।
সাম্প্রতি দেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যার থেকে সুস্পষ্ট হচ্ছে প্রচলিত আইনটি কার্যকরভাবে সাইবার অপরাধ দমনে ব্যর্থ। বিশেষ করে এই আইনে সুস্পষ্ট ভাবে বলা নেই যে কোথায় কার কাছে মামলা দায়ের করতে হবে। যার কারণে ভুক্তভোগী প্রতিকার পেতে থানা থেকে আদলাতে দৌড়াতে দৌড়াতে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেন। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশন এর কাছে এমন অনেক চাঞ্চল্যকর সাইবার অপরাধের অভিযোগ এসেছে যেখানে ভুক্তভোগী সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে আত্নহত্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত চালায়।
সম্প্রতি প্বার্শবর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ দমনে লালবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে সাইবার থানা। কিন্তু আমাদের দেশে এমন কোন থানা বা পুলিশের আলাদা কোন বিভাগ নেই যারা শুধুমাত্র সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে কাজ করবে। এমনকি সেখানে বিচারকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে আনন্দ বাজার পত্রিকা থেকে জানা যায়।
অতি দ্রুত সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ মোকাবেলা ও সাইবার অপরাধীদের সনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে দেশে বিশেষ করে বিভাগীয় শহরগুলোতে পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার আলাদা প্রযুক্তি বিষয়ে কার্যকর ইউনিট গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেই সাথে সাইবার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিচারকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।
এখন গতানুগতিক পুলিশিংয়ের দিন শেষ হয়ে এসেছে। সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ দমন ও এই সমস্ত অপরাধের ধরণ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করার জন্য পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের আলাদা বিভাগ থাকা উচিত উচ্চ প্রশিক্ষিতদের নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ খুন-ধর্ষণ-ডাকাতিতেও সাইবার তথ্যপ্রমাণকে ব্যবহার করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারীরা। কিন্তু বর্তমানে সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ দমনে পুলিশ তেমন দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না। কারণ পুলিশের তথ্য ও প্রযুক্তি উপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। যার কারণে তারা অপরাধ ও অপরাধী সনাক্ত করতে বার বার ব্যার্থ হচ্ছে।
আর সাইবার অপরাধীরা অপরাধের পুনরাবৃত্তি করেই যাচ্ছে। গেল বছর কিভাবে পুলিশের ওপর হামলা করতে হবে, কীভাবে বোমা বানাতে হবে, পুলিশের সাঁজোয়া গাড়ির ওপর কীভাবে হামলা করতে হবে—এসব তথ্য প্রচার করছে কিছু ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। কিন্তু তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। গত বছর ২৪ অক্টোবর সারারাত ডিএমপির সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোনে বিদেশ থেকে ফোন এসেছে, হুমকি দিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হয়েছে। এসব ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় কি হারে সাইবার অপরাধ বাড়ছে! তাই এসব প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ দমনে প্রযুক্তিকেই দক্ষভাবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া ভুক্তভোগীর প্রতিকার পেতে সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক উদ্যোগ ও এই সংক্রান্ত অভিযোগ ও মামলা দায়ের পদ্ধতি আর সহজ করাও বাঞ্ছনীয়।