গ্রাহকদের ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার ২২৭ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন, তাঁর স্ত্রী ফারাহ দিবাসহ (ডেসটিনির পরিচালক) ১৯ জনকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
আজ বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪–এর বিচারক মো. রবিউল আলম এ রায় ঘোষণা করেন। সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী বেলাল হোসেন রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আসামিদের মধ্যে জামিনে ছিলেন প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশিদ। তিনি আদালতে হাজির ছিলেন। তাকে সাজা পরোয়ানাসহ কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। অন্যদিকে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। দীর্ঘ ১২ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর আলোচিত এ মামলার রায়ের ফলে রফিকুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসাইনের মুক্তিতে আর কোন বাধা থাকছে না।
রাজধানীর কলাবাগান থানায় ২০১২ সালের ৩১ জুলাই মামলা দুটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ৪ মে একটি মামলায় ১৯ জনের এবং অপর মামলায় ৪৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সংস্থাটি। ২০২২ সালের ১২ মে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং বেআইনিভাবে অর্থ পাচারের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদসহ ৪৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ মামালায় এখন পর্যন্ত ১৫ আসামী পলাতক রয়েছেন।
মামলার আসামিরা হলেন: ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল আমিন, পরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুনুর রশিদ, প্রধান কার্যালয়ের চেয়ারম্যান মো. হোসেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ গোফরানুল হক, মো. সাইদ-উর রহমান, মেজবাহ উদ্দিন স্বপন, ইঞ্জিনিয়ার শেখ তৈয়েবুর রহমান ও গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস, পরিচালক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ সানী, মিসেস ফারহা দিবা ও জামসেদ আরা চৌধুরী, প্রফিট শেয়ারিং ডিস্ট্রিবিউটর মো. জসিম উদ্দীন ভূঁইয়া, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন ও সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ, ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভ এস এম আহসানুল কবির বিপ্লব, জোবায়ের সোহেল ও আব্দুল মান্নান এবং ক্রাউন এক্সিকিউটিভ মোসাদ্দেক আলী খান।
সাজাপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন—ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন, ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান লে. জে. (অব.) হারুন অর রশিদ, ডেসটিনির ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. গোফরানুল হক, মো. সাঈদ উর রহমান, মেজবাহ উদ্দিন স্বপন, ইঞ্জিনিয়ার শেখ তৈয়েবুর রহমান ও গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস, পরিচালক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ সানী ও জামশেদ আরা চৌধুরী, প্রফিট শেয়ারিং ডিস্ট্রিবিউটর মো. জসিম উদ্দীন ভূইয়া, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন ও সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ, ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভ এস এম আহসানুল কবির বিপ্লব, জোবায়ের সোহেল ও আব্দুল মান্নান এবং ক্রাউন এক্সিকিউটিভ মোসাদ্দেক আলী খান।
আসামিদের মধ্যে কারাগারে আছেন—রফিকুল আমীন, ফারাহ দিবা ও মোহাম্মদ হোসেন। রায় শেষে তাঁদের সাজা পরোয়ানাসহ কারাগারে পাঠানো হয়। তবে রফিকুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসেন ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে কারাগারে থাকায় তাদের সাজার মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে বলে আদালত রায়ে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জামিনে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুনুর রশিদ। তিনি আদালতে হাজির ছিলেন। তাঁকে সাজা পরোয়ানাসহ কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে কারাগারে প্রথম শ্রেণির কয়েদির মর্যাদা দিতে কারা বিধি অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালত রায়ে বলেছেন, কারাগারে থাকা আসামিরা এর আগে যত দিন কারাগারে ছিলেন, সাজার মেয়াদ থেকে তত দিন বাদ যাবে। বাকি ১৫ আসামি পলাতক। পলাতকদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাঁরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর বা আদালতে আত্মসমর্পণের পর এই রায় কার্যকর হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, প্রতারণামূলকভাবে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে তা অন্যত্র পাচার করার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন দুদকের পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আইনে থাকা সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন আদালত। রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ খুশি।’ গত বছর ১১ নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেন।
গ্রাহকেদের ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার ২২৭ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল আমীনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার কলাবাগান থানায় মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরকার। মামলার তদন্ত শেষে ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১৪ সালের ২০ মার্চ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার। তদন্তে আরও সাতজনের নাম আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন আদালত। এ মামলায় বিচার চলাকালে ১৪০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) মামলায় আসামিরা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য ২০০৬ সালের ২১ মার্চ থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সাড়ে ৮ লাখের বেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এ সময় ঋণ প্রদান, অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ, নতুন প্রতিষ্ঠান খোলার নামে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে আসামিরা লভ্যাংশ, সম্মানী ও বেতন-ভাতার নামে সরিয়ে নিয়েছেন।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ডেসটিনির সংঘ-স্মারকে (মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন) কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও বান্দরবানের লামা উপজেলায় জমি লিজ নিয়ে গাছ লাগানোর এবং গাছ বড় হলে তা বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা লাভ দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছিলেন আসামিরা। পরস্পর যোগসাজশে তারা ডেসটিনির ব্যাংক হিসেবে টাকা রেখে ওই টাকা অন্যত্র স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করেন। ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার বেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া হলেও ডেসটিনির ব্যাংক হিসাবে ওই টাকা স্থিতি ছিল না। বিভিন্ন সময়ে আসামিরা ২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকার বেশি নিজেদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছেন।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ১২ মে গ্রাহকদের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা আরেকটি মামলায় রফিকুল আমিনসহ ডেসটিনির অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ঢাকার আদালত। রফিকুল আমিনকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।