তালাত মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধি।। ঢাকা।।এগারো মাসে পা দিয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ। অর্থডক্স ক্রিসমাস উপলক্ষে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তা ঝড়ের পূর্ভাবাস বলেই ধারণা। এই পরিস্থিতিতে লড়াই থামাতে ভারতের উপর অনেকটা ভরসা করছে আমেরিকা। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন বৈদেশিক দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি ভারতের মতো দেশ যাদের রাশিয়ার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রয়েছে তারা কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমে এই যুদ্ধ থামাতে সাহায্য করতে পারে। আমরা ভারতের সঙ্গে একমত যে ইউক্রেনে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শহমত পোষণ করি যে এটা যুদ্ধের সময় নয়। জি-২০-তেও একই বার্তা দেওয়া হয়েছে।”
বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেন ইস্যুতে বরাবর ‘বন্ধু’ রাশিয়ার পাশেই রয়েছে ভারত। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা একাধিক প্রস্তাবে ভোটাভুটিতে যোগ দেয়নি নয়াদিল্লি। একইভাবে, আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে বারবার যুদ্ধ থামানোর আরতি জানিয়েছে নয়াদিল্লি। তাই দিল্লি-মস্কো সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে এই যুদ্ধ থামাতে চাইছে ওয়াশিংটন। কারণ, গোড়া থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্র জুগিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা, এবং দিনদিন এই খরচ বাড়ছে। করোনা পরিশ্তিতি ও আর্থিক মন্দার আশঙ্কার মাঝে তাই দ্রুত সংঘাতে ইতি টানতে চায় বাইডেন প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইতিহাস কি চীন ও ভারতের দিকে ঝুঁকছে?
ছবি-এএফপি
১৯৯২ সালে ফ্রান্সিস ফুকোয়ামার বহুল প্রচলিত ইতিহাসের যবনিকাপাত? প্রথম প্রকাশিত হয়। ফুকোয়ামার যুক্তি হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়ার অর্থ হলো, কর্তৃত্ববাদের ওপর উদার গণতন্ত্রের বিজয় এবং ইতিহাসের (মতাদর্শিক) যবনিকাপাত। বাকি বিশ্বের সামনে অনিবার্যভাবেই একটি পথ খোলা, সেটি হলো পশ্চিমা উদার গণতন্ত্র।
১৯৯০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ফুকোয়ামার এই যুক্তির একটি অর্থ দাঁড়ায়। কিন্তু পরবর্তী দশকগুলোতেও পশ্চিমারা যেভাবে সেই একই যুক্তি ধরে রেখেছে, তা বিস্ময়ের ব্যাপার বৈকি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, উদারনৈতিক ব্যবস্থাকে পশ্চিমারা নিজেরাই ছিন্নভিন্ন করছে। ন্যাটোকে রাশিয়ার সীমান্তের গোড়ায় নিয়ে গিয়ে, ইসলামি বিশ্বের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে এবং এক চীন নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের সংহতি বিনষ্ট করেছে। এককভাবে অর্থনীতির দিকটা বিবেচনা করলেও দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক হর্তাকর্তারা ভুল পথে যাত্রা শুরু করেছেন। খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম বড় উৎপাদক দেশ। আর শিল্পপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে চীন। সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশও তারা। রাশিয়াকে বর্জন আর চীনকে প্রধান প্রতিপক্ষ বানানোর পশ্চিমাদের এই নীতিতে লাভবান হচ্ছেন গুটিকয়, এর বেশির ভাগই অস্ত্র উৎপাদক। উদার গণতান্ত্রিকব্যবস্থা বিকাশের বদলে পশ্চিমা বিশ্ব বরং বিপরীতটাই অর্জন করেছে। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বিশ্বে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী করছে। রাশিয়ার সস্তা জ্বালানির প্রবাহ চীন ও ভারতের দিকে চলে যাচ্ছে। আর জ্বালানি উৎপাদক দেশগুলোর (ওপেক) কাছে পেট্রো-ডলারের পাশাপাশি পেট্রো-ইউয়ানও বিনিময়ের মাধ্যম হয়ে উঠল। এই সবকিছুই ইউরোপে আংশিক বি-শিল্পায়ন (শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়া) ঘটাচ্ছে; সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা নাইবা বললাম। ২৫ বছর আগেও এসব ঘটনা একেবারেই অকল্পনীয় ছিল।
পশ্চিমাকেন্দ্রিক বিশ্বের বাইরে
দ্য স্পিরিচুয়াল ইম্পারেটিভ গ্রন্থের লেখক লরেন্স তায়ব দাবি করেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংঘাত কেন চলে, সেটি ব্যাখ্যা করার একটি সাংস্কৃতিক সূত্র তিনি খুঁজে পেয়েছেন। ভারতীয় বর্ণধারণার ওপর ভিত্তি করে তায়ব ইতিহাসের একটি বিশদ পাঠ নির্মাণ করেন। প্রাচীন বেদে বর্ণিত শ্লোকের ওপর ভিত্তি করেই ভারতীয় সমাজে পরবর্তীকালে বর্ণপ্রথার উদ্ভব হয়। পৃথক বিশ্বদৃষ্টি, সামাজিক আদর্শ ও গুণাবলির ওপর ভিত্তি করে বর্ণধারণা মানুষের চার ধরনের আর্কেটাইপ বা আদি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছে। বিশ শতকে এসে শ্রমজীবীরা তাঁদের অধিকারের আওয়াজ তোলেন। এই প্রেক্ষাপটে অভিজাতেরা শ্রমিক সংস্থা ও আমলাতন্ত্র গঠন করেন। তাঁরা বণিক শ্রেণির কাছে আরও ন্যায্যতা দাবি করেন এবং এর অনেকটা আদায় করতেও সামর্থ্য হন। কিন্তু বণিক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা তারা ভেঙে দিতে পারেননি।
তায়বের মডেল অনুসারে, পশ্চিমারা রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে এখন যে সংঘাতে লিপ্ত, সেটা বণিক আর্কেটাইপের মানুষের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টার অংশ। এ কারণেই পূর্ব এশিয়া পশ্চিমাদের সহজাত প্রতিপক্ষ। জাপান ও কোরিয়ার মতো চীন শ্রমজীবী আর্কেটাইপের একটি দেশ। বণিক সম্প্রদায় তাদের বিশ্বায়ন ধারণা বিকশিত করলে তা থেকে চীন বড় সাফল্য অর্জন করতে পারে। কিন্তু দেশটির সরকার দেশি-বিদেশি বণিক গোষ্ঠীর লাগাম টেনে রাখে। চীন সরকার বণিক গোষ্ঠীকে যেমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, অন্য দেশে তেমনটা দেখা যায় না।
ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন
যাবতীয় বাধা পেয়িয়ে চীন তার দলবদ্ধ পুঁজিবাদের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে সবচেয়ে বড় অর্থনীতিতে পরিণত হতে চলেছে। ভারতও কাছাকাছি অবস্থান করবে। এর কারণ হলো, খুব দ্রুত দলবদ্ধ পুঁজিবাদ নিজেদের মতো আয়ত্ত করে নিয়ে শিল্পায়নের বিকাশ ঘটিয়েছে ভারত। এ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে ভারতের প্রবৃদ্ধি চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি গিয়ে চীন ও ভারত প্রায় কাছাকাছি অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে। জানা ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়জুড়েই চীন ও ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ছিল। উনিশ শতকের শেষভাগে এসেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠতে পারে। এশিয়ার দুই পরাশক্তির এই পুনর্জন্ম ইতিহাসের প্রথা মেনেই ঘটছে। কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনকে লক্ষ্যবস্তু বানানোয় পশ্চিমা বিশ্ব এখন ভারতকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে না। বাস্তবতা হলো, ভারতই একমাত্র দেশ, যেটি বিশ্বে চীনের প্রভাবের ওপর ভারসাম্য আনতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠতে পারে ভারত। যেকোনো বিবেচনাতেই একুশ শতকের অপরিহার্য একটি দেশ ভারত।
কলকাতার সংবাদ প্রতিদিন, আনন্দ বাজার এবং জেন ক্রিক, এশিয়া টাইমস অবলম্বনে।