বাংলাদেশ-ইরানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘ফেরেশতে’ সিনেমার শুরু হয় বেশ দুর্দান্তভাবেই। গত ২০’শে জানুয়ারি শুরু হয় ২২’তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসবের উদ্বোধনী দিনই প্রদর্শিত হয় অভিনেত্রী জয়া আহসান অভিনীত ‘ফেরেশতে’ সিনেমা। এরপর যথারীতি ইরানেও যায় সিনেমাটি। দেশটির ৪২তম ফাজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী দিনেও প্রদর্শিত হয় ইরানি নির্মাতা মুর্তজা অতাশ জমজম পরিচালিত ‘ফেরেশতে’।গত ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় ৪২তম ফাজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এর পর্দা নামবে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তেহরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান এবং অভিনেত্রী জয়া আহসান, সুমন ফারুক ও রিকিতা নন্দিনী শিমু। আরও ছিলেন ‘ফেরেশতে’র গল্পকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুমিত আল রশিদ। এবার ইরানের ফাজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়েছে ‘ফেরেশতে’ সিনেমা। এটি ‘সি মোরগ ব্লুরিন’ অ্যাওয়ার্ডের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। অ্যাওয়ার্ডটি খুবই মর্যাদাপূর্ণ। ১০৫টি সিনেমার প্রথম ২৫টির মধ্যে রয়েছে এই সিনেমা। ফেরেশতের বিপরীতে যেসব সিনেমা রয়েছে তার অধিকাংশই বহু ব্যয়বহুল বাজেটের। সেখানে একমাত্র ফেরেশতে সিনেমাই স্বল্প বাজেটের বলে তেহরান থেকে চ্যানেল 24 অনলাইনকে জানান সিনেমাটির গল্পকার মুমিত আল রশিদ।

ভিনদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে দর্শকের আগ্রহ কেমন ছিল―এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, অসাধারণ সাড়া পেয়েছি আমরা। “ফেরেশতে” আমাদের সিনেমা বলে বলছি না, বাংলাদেশ-ইরানের যৌথ প্রযোজনার সিনেমা হলেও দর্শক ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে সিনেমাটি। দর্শকদের সাড়া আমাদের এই উপলব্ধি জোরালো করেছে যে, সিনেমা এবং এর গল্প কখনো কোনো দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। তিনি বলেন, ‘অডিটোরিয়ামে প্রচুর দর্শক ছিল। সিনেমা দেখা শেষ করার পর অনুষ্ঠানে আগত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। সেখানে আমাদের সামনে প্রচুর চলচ্চিত্র সমালোচক, চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছিলেন। তাদের অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, তাদের প্রশংসা পেলেও এত প্রশ্নবান ছিল যে, একপর্যায়ে সময়ের অভাবে আগেই সাংবাদিক বন্ধুদের বিদায় জানান সঞ্চালক। কারণ, সেখানে কথা বলতে থাকলে আরও একটি সিনেমা প্রদর্শনের সময় পার হতো।’

ঢাকা শহরে একজন রিকশাচালক, তার স্ত্রী একজন গার্মেন্টসকর্মী এবং প্রতিবেশি এক বাকপ্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে গল্প ‘ফেরেশতে’ সিনেমার। রিকশাচালক পরিবারে কোনো সন্তান নেই। তাদের অল্প আয়ে দিন চল। এদিকে তাদের পার্শ্ববর্তী একজন কালা (কানে কম শুনতে পান) শিশু থাকে। স্বল্প আয়ের দিন কাটানো দম্পতি সেই শিশুকে নিজেদের সন্তানের মতো লালন-পালন করেন। চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য চেষ্টা করেন। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে গল্প। এ’সিনেমায় রাজধানীর ব্যস্ততম কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সবুজায়ন প্রাঙ্গণ এবং বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ উদযাপনসহ বিভিন্ন সংষ্কৃতির দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে। কিন্ত কীভাবে এমন গল্পে সিনেমা তৈরির ভাবনা এলো, সেটি জানতে চাইলে মুমিত আল রশিদ বলেন, ‘আমি প্রথমে আমার ইরানি বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেই যে, এবার এমন একটি গল্প লিখব যা আমাদের আশপাশেই ঘটে, চারপাশে তাকালেই চোখে পড়ে। তারপর যা ভাবা তাই শুরু। আমাদের বাংলাদেশে গ্রাম কিংবা শহরে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছেন, যারা নিজের খাবার থেকে প্রতিবেশিকে খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেন। অচেনা মানুষকেও সহায়তা করেন। এমনই একজন মানবিক মানুষ আমাদের দেশের রিকশাচালকরা। তারা অভাবের তাড়নায় রিকশা চালালেও তাদের মধ্যে মানবিকতা, সহজ-সরলতা রয়েছে। তারা অল্প টাকায় আপনাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। জায়গাটি আপনার অচেনা হলেও সে সহায়ক হয়। আমি সেসব বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এছাড়া আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়, যার শুরু ইরান থেকে। বাংলাদেশে বৈশাখ উদযাপন সম্রাট আকবরের আমল থেকে জৌলুসভাবে পালন করা হয়। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইরানের নওরোজ উৎসব থেকে অনেক কিছু নেয়া। আর বৈশাখি উৎসবে যে আমাদের (বাঙালি জাতি) বিশেষ খাবার ও নানা আয়োজন থাকে, সেসব রাখার চেষ্টা করেছি সিনেমাটিতে। সবমিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবিকতার দিকগুলো তুলে ধরার প্রয়াস ছিল।

ফেরেশতে সিনেমাটি ইরানে প্রদর্শিত হওয়ার পর দেশটির দর্শকরা এটা ভালোভাবে জানতে পেরেছে―বাংলাদেশের মানুষরাও বেশ ঘটা আয়োজন করে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। নানা খাবারের পসরা থাকে। বাংলাদেশ মানবিক দেশ। এর জন্য সমালোচকরা প্রশংসাও করেছেন বলে জানান মুমিত আল রশিদ। এদিকে জয়া আহসান ঢাকা ও কলকাতার সিনেমায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। গল্পের প্রয়োজনে সাহসী দৃশ্যেও দেখা গেছে তাকে। পাশাপাশি প্রায়ই বিভিন্ন ফটোশুটের খোলামেলা ছবি পোস্ট করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ইরানে ফাজর চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেয়ার জন্য গত ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে পাড়ি জমান তিনি। ইরান মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ায় ধর্মীয় রীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। এ অবস্থায় নিজেকে কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছেন জয়া আহসান, সেটি প্রশ্ন রাখা স্বাভাবিক।

গল্পকার মুমিত আল রশিদ গল্পে গল্পে অভিনেত্রী জয়া আহসানের কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং দায়িত্বশীলতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘এবার ইরানে ফেরেশতে সিনেমা প্রদর্শনে এসে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বাংলা সিনেমার ব্যাপারে অনেক কথা হয়েছে। তারা তাদের ইরানি সিনেমা বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও ডাবিং করে বাংলাদেশে প্রদর্শনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে আমাদের বাংলা সিনেমা তাদের কাছে ভালো লাগায় বাংলা সিনেমা ইরানে নেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে, খুব বেশি সময় লাগবে না―যেদিন ইরানেও আমাদের বাংলা সিনেমা চলবে, সবাই দেখবে ও প্রশংসা করবে। বলতে পারা যায় এই ফেরেশতে সিনেমার মাধ্যমে ইরানে দুয়ার খুলতে যাচ্ছে বাংলা সিনেমার। এ ব্যাপারে মুমিত আল রশিদ বলেন, ‘মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের অবশ্যই রাষ্ট্রীয় কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। আমরা মুসলমান। এর বাইরে যদি এখানে কোনো খ্রিস্টান বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কেউ আসেন, তাহলে তাকে তার দিক থেকে যতটা সম্ভব পরিমার্জিত ও শালীন পোশাকে থাকতে হয়। এটা সবারই জানা। আর জয়া আহসান তো একজন দাপুটে অভিনেত্রী, যেমন গল্পের প্রয়োজনে নিজেকে ভাঙা-গড়ার মধ্যে রাখেন। তাই এখানে কোনো সমস্যা হয়নি। খুব সহজেই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন নিজেকে।

জয়া আহসান অভিনীত প্রথম কোনো সিনেমা এবার ইরানে প্রদর্শিত হলো। ইরানে ফেরেশতে প্রদর্শিত হওয়ার পর যেমন অভিনেত্রী হিসেবে আরও দ্যুতি ছড়িয়েছেন, তেমনি নিজের অভিনয়ের দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছেন। ফাজর চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি দেখানোর পর সমালোচকদের কথায় এটা অন্তত স্পষ্ট হয়েছে, জয়া আহসান ইরানি সিনেমাতেও অভিনয়ের জন্য যোগ্য। এই ইন্ডাস্ট্রিতেও অনেক ভালো করবেন বলে মতামত ইরানি সমালোচকদের।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে