মোঃ তানসেন আবেদীনঃ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনকারীদের উপর প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান ও তার অনুসারী আওয়ামীলীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ছাত্র-জনতার উপর গুলি করা সেইসব চিহ্নিত অস্ত্রধারীদের কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে, শামীম ওসমানসহ তার বাহিনীর অনেকেই দেশ ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে, গুলিতে হতাহত পরিবারগুলোতে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে চলতি বছরের জুনে রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। জুলাইতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। নারায়ণগঞ্জ শহরে ১৪ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রথম মাঠে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শুরুতে শহরের চাষাঢ়াকেন্দ্রিক হলেও পরবর্তীতে আন্দোলন জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের পঞ্চম দিন ১৮ জুলাই পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় আন্দোলনকারীরা। দিনভর চলে এই সংঘর্ষ। এতে কয়েকশ’ আন্দোলনকারী আহত হয়। গুলিবিদ্ধ হন অনেকে। পরদিন এই আন্দোলন আরও তীব্র হয়।
আন্দোলনকারীদের দমাতে ১৯ জুলাই দুপুরে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে সড়কে নেমে আসেন সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। দিনভর নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের এক মাথা থেকে অন্য মাথা এবং জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কে (লিংক রোড) আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়েন শামীম ওসমান ও তার লোকজন। শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলি ছোড়ার সময় ধারণ করা কয়েকটি ভিডিওচিত্র, স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ এবং আন্দোলনকারী, প্রত্যক্ষদর্শী ও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে প্রেস নারায়ণগঞ্জ অস্ত্রধারী কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছে। জেলা পুলিশও আন্দোলনে গুলি ছোড়া কয়েকজনকে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে। তবে, অস্ত্রধারী কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা যায়নি। গত ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনীর অগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করার একটি ভিডিওচিত্রে শামীম ওসমানের বাহিনীকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ভিডিওতে শামীম ওসমানের শ্যালক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক তানভীর আহমেদ টিটুকে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। ওইদিন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায় শামীম ওসমানকেও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র হাতে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। ওই সময় শামীম ওসমান, তার ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু ও তার ছেলে এমআরকে রিয়েনও গুলি চালিয়েছেন।জালকুড়িতে গুলি করার একটি ভিডিওতে শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন একটি অত্যাধুনিক অস্ত্র থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ছেলের পেছনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সঙ্গে ছিলেন শামীম ওসমান নিজেও। গুলি করেন শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদও।
সশস্ত্র মহড়ায় ছিলেন শামীম ওসমানের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর) ফয়েজউদ্দিন লাভলু, লাভলুর ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ভিকি, শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুচর ব্যবসায়ী অনুপ কুমার সাহা, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া সাজনু, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল হোসেন ও। হামলায় আরও ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি সোহেল করিম রিপন, অয়ন ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সোহানুর রহমান শুভ্র, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসমাইল রাফেল প্রধান, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান সম্রাট, সাধারণ সম্পাদক রাসেল প্রধান। তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ১৯ জুলাই শামীম ওসমানের নেতৃত্বে গুলি চালানোর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। তারা জানান, সেদিনে পরিস্থিতি ছিল ভীতিকর। ওই পরিস্থিতিতে ছবি ও ভিডিও ধারণের কোনো সুযোগ ছিল না। ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা মারধরেরও শিকার হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, ওইদিন শামীম ওসমান বাহিনীর গুলিতে মারা যান ৬ বছর বয়সী রিয়া গোপ। এই শিশু বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে নয়ামাটি এলাকায় তাদের চারতলা বাড়ির ছাদে খেলছিল। এ সময় মাথায় গুলি লাগে রিয়ার। পাঁচদিন পর রিয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট সকালেও শামীম ওসমানের সশস্ত্র বাহিনী শহরে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়। শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে, বিভিন্ন মাধ্যমে খবর ছড়িয়েছে, শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যরা, যারা আন্দোলনে গুলি চালিয়েছে, তারা দেশ ছাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তিনি ভারত হয়ে বর্তমানে মালয়েশিয়াতে অবস্থান করছেন। ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান রিয়াদ, আশরাফুল ইসমাইল রাফেল ও সোহানুর রহমান শুভ্ররও মালয়েশিয়াতে অবস্থানের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে, আওয়ামী লীগ নেতা শাহ নিজাম ও সোহেল করিম রিপনসহ শামীম ওসমান বাহিনীর অনেকেই দেশে আত্মগোপনে আছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর দুইমাস পেরিয়ে গেলেও তাদের গ্রেপ্তারের কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি। রাব্বির কিশোর ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগও শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৮ অক্টোবর শহীদ মিনারে ত্বকী হত্যার ১৪৪ মাস উপলক্ষে আলোক প্রজ্বালন অনুষ্ঠানে রফিউর রাব্বি বলেন, ‘এই খুনি, ঘাতক ওসমান পরিবার সারা দুনিয়ায় চিহ্নিত হওয়ার পরও তারা একজনও গ্রেপ্তার হলো না কীভাবে? শুনছি, তাদের পরিবারের সকলে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। যদি তারা পালিয়ে যেতে পারে, তাহলে তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিলো কারা, কারা সহযোগিতা করলো? তাদের সহযোগীরা এখন পর্যন্ত পরিবর্তিত সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়, বিভিন্ন জায়গায় বিরাজমান।’
শামীম ওসমানের লোকজন নারায়ণগঞ্জে থাকলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না অভিযোগ করে রাব্বি বলেন, ‘শামীম ওসমানের লোকজন বসে আছে নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিক, আইনজীবীদের মধ্যে শামীম ওসমানের লোকজন রয়েছে। আমরা সবাই তা জানি। তারা এখনো পর্যন্ত তো ধরা পড়েনি। শামীম ওসমানের খুনিরা, চাঁদাবাজরা, মাদক ব্যবসায়ীরা, দখলবাজরা; কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। এতকিছুর, এতগুলো খুন করার পরেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। প্রশাসন তাদেরকে পাহারা দিয়ে রাখছে না, তা কীভাবে বুঝবো?’ তবে, জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন অস্ত্রধারীদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী কাজ করছে। যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিবে। তবে যারা দেশে আছেন, তাদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা চলছে।’
নারায়ণগঞ্জ নিউজ ডেস্ক।। বিডি টাইমস নিউজ