লেখকঃ অধ্যাপক সন্দীপ ব্যানার্জী (কলকাতা)।।
কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে অনেকরকম পরিবর্তন আমরা দেখব। এই পরিস্থিতিতে আমরা এমন দিন কাটাচ্ছি যা মানুষের সবরকম কর্মক্ষেত্রকে ব্যহত করছে। সবকিছু আবার কবে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে তা অনুমানসাপেক্ষ ও অনিশ্চিত। বলাই বাহুল্য, শিক্ষা এর বাইরে নয়। বর্তমান অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। শিক্ষায় পাঠদান শ্রেণীকক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তা বলে কি শিক্ষাদান থেমে যাবে? না। আমাদের তাই শিক্ষাদানকে এগিয়ে নিয়ে যাবার নতুন পন্থা খুঁজে বের করতে হচ্ছে। সেই প্রয়াসই ই-শিক্ষা বা অনলাইন শিক্ষা, যা ক্রমে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। ক্রমশ আগামী দিনে এই শিক্ষা মাধ্যম আরো বেশি করে গ্রহনযোগ্য হবে এবং তা হবে যথার্থ কারণেই।
বিবেকানন্দ শিক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন “If the purpose of a teacher is to give information only, then library would be the best teacher”. সত্যি বলতে, শিক্ষাব্যবস্থাতে পাঠদানের পদ্ধতি শুরু হওয়া থেকে একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তা প্রচলিত হয়েছে। একজন শিক্ষক উপস্থিত থেকে ছাত্রকে পড়াচ্ছেন এটাই সবথেকে প্রচলিত ও সমাদৃত। এতে যে শুধু একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ব্যাখ্যাদান হয় তা নয়, একজন শিক্ষক তার বক্তব্য ও উপস্থিতির মাধ্যমে ছাত্রকে অনুপ্রাণিত করেন এবং তার ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ঘটান। এবং সে কারণেই শিক্ষাদানকে যথার্থভাবে মানবসম্পদ উন্নয়ন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আজকের দিনেও শ্রেণিকক্ষ শিক্ষা ( classroom teaching) সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয়, কিন্টারগার্ডেন স্তর থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সবই পরিবর্তনশীল। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সাথেই যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন দিক খুলে গেছে এবং বর্তমান শিক্ষণ পদ্ধতি এই প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। বর্তমানে গোটা বিশ্ব এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চলেছে, তা হল ওয়েব (web) মাধ্যম যা শিক্ষার প্রযুক্তিকেও প্রভাবিত করেছে। শিক্ষার তিন মূলনীতি হল: সুযোগ, সাম্য ও গুণমান। এই তিনটি বৃহত্তর ক্ষেত্রে পৌছে দেবার ব্যাপারে ই-এডুকেশন এক নতুন পথের দিশারী। পরিবর্তন হলো একমাত্র ধ্রুব এবং মানবসভ্যতার ইতিহাস মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। বিখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের কথায়, “Without contrary there is no progression.” শিক্ষাও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরনোপন্থীরা সবসময় শ্রেণিকক্ষকেই মান্যতা দেন শিক্ষার পাঠদানের ব্যাপারে। কিন্তু অনলাইন শিক্ষাকে আর ব্রাত্য ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এটা এখন এক বিশ্বব্যাপী ঘটনা। সারা পৃথিবীর ছাত্ররা এর সুবিধা উপলব্ধি করে তার সুফল তুলছে। এর বেশ কিছু সঙ্গত কারণ আছে- ভালো করে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে যে অনলাইন শিক্ষামাধ্যমে এক ধরনের নমনীয়তা আছে যা পাঠদানকে অনেক সহজে অনেক বেশি শিক্ষানবিশদের কাছে পৌঁছে দেয়। যে সকল ছাত্র প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষার সুযোগ থেকে নানা কারণে বঞ্চিত তারা ই-শিক্ষার মাধ্যমে নিজেরা শিক্ষার আঙিনায় বিরাজমান থাকতে পারে, কেতাবি ও বৃত্তিমূলক উভয় শিক্ষাক্ষেত্রেই। এই শিক্ষার মাধ্যমে বাড়িতে বসেই পাঠ নেওয়া সম্ভব। এই ব্যবস্থা একজন ছাত্রকে নানাবিধ সুবিধা এনে দেয় যেমন তার যাতায়াতের খরচ বাঁচায় যে খরচ অনেক ক্ষেত্রে তার শিক্ষা গ্রহণে বাস্তবিক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া যায় যে অনেক সময়ে ছাত্ররা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। কিন্তু অনলাইন শিক্ষাতে এই সমস্যা নেই। এবং তা সেইসব ছাত্রদের ক্ষেত্রে উপকারী যাদের ব্যর্থতাকেন্দ্রিক মানসিক অবসাদ হয়।
ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, “Knowledge comes but wisdom lingers.” কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেটকে ধন্যবাদ- শিক্ষা এখন আরো বেশি বিস্তারিত। যেখানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সেখানে অনায়াসে অনলাইন শিক্ষা পাঠ দান করছে। পরিস্থিতি ও অবস্থান নির্বিশেষে শিক্ষার প্রসার অগ্রসর হচ্ছে। কারণ অতি সহজেই শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে ভৌগলিক দূরত্ব দূর হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষণ পরিনতি বা “learning outcome” মানদন্ডে বিচার্য যার মূল লক্ষ্য ছাত্রদের পাঠ গ্রহণের সুবিধা প্রদান করা।
ছাত্রেরা পাঠ গ্রহণের সময় বা পাঠের ব্যাপ্তি নিজেদের মতো করে গড়ে নিতে পারে। তারা দরকার মত পরীক্ষা নির্ঘণ্ট বেছে নিতে পারে। এমন অনেক ছাত্র আছে যারা জীবিকার তাগিদে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা চালাতে পারেনা। ই-শিক্ষা তাদের এই ঘাটতি মেটাতে বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। ই-শিক্ষা এক ধরনের ফলতো শ্রেণিকক্ষ (virtual classroom) নির্মাণ করে যার দ্বারা ছাত্রদের শারীরিক অনুপস্থিতি শিক্ষাদানকে ব্যহত করে না। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো এখনকার সময়। আজকের এই করনা আক্রান্ত বিশ্বে সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাদানকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের “বাংলার শিক্ষা” নামক ওয়েব পোর্টাল এর কথা বলতে পারি যার দ্বারা প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাদান চলছে এবং তা লক্ষাধিক ছাত্রকে লেখাপড়ার অভ্যাসের মধ্যে রেখেছে। এবিপি আনন্দ, জি 24 ঘন্টা বা দূরদর্শন ইত্যাদি চ্যানেলগুলিও বিদ্যালয় শিক্ষার বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান সম্প্রসারণ করছে। এতে ছাত্রদের বুদ্ধিমত্তার অনুশীলন হচ্ছে, যার দ্বারা ছাত্রদের মানসিক অবসাদ ও শিক্ষা সংক্রান্ত উৎকণ্ঠার উপশম ঘটছে।
ভারতবর্ষের মতো দেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটা সংকুচিত। আর এ ব্যাপারে অনলাইন শিক্ষা একটি বিরাট আশীর্বাদ। শিক্ষাক্ষেত্রে এ একধরনের গণতান্ত্রিক বিকাশ, কারণ ছাত্রদের উপস্থিতি সব সামাজিক শ্রেণী থেকে হতে পারে এবং বেশি সংখ্যায় হতে পারে। আজকাল বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ICT বা Information and Communication Technology Classroom আছে যেখানে ইন্টারনেটের সাহায্যে ছাত্ররা যেকোনো বিষয়ের বিবিধ বিশ্লেষণের উপকারিতা কাজে লাগাতে পারে। ছাত্ররা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো বিষয়ের ওপরে জ্ঞান ও তথ্যের রসদ সংগ্রহ করতে পারে। অনলাইন শিক্ষা মাধ্যমের দ্বারা কোন নির্দিষ্ট পাঠক্রমের আন্তর্জাতিক শংসাপত্র ও শিক্ষা যোগ্যতা লাভ করা সম্ভব এবং তাও নিজের দেশে বসে। ভারতবর্ষে পেশাগত শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে ই-শিক্ষা যথেষ্ট ফলোদায়ী হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।
ই-শিক্ষার জনপ্রিয়তা ও ব্যাপ্তির বৃদ্ধির সাথে একটি বিতর্ক জন্ম নিচ্ছে। তাহলে কি আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপযোগিতা হারিয়ে গেছে? রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে নানা মত দিচ্ছেন। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে অনলাইন শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার একটি কার্যকর পরিপূরক। বর্তমান শিক্ষার উন্নতি সাধনে এই দুই শিক্ষা মাধ্যমের সার্থক মেলবন্ধন কাম্য। আজকে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সব শ্রেণীর পাঠক্রমে ইন্টারনেট অপরিহার্য। করোনা পরবর্তী বিশ্ব অনেক পরিবর্তন দেখবে যার মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ই-শিক্ষার প্রভাব ও প্রসার একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যদিও এই শিক্ষামাধ্যমের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবুও আমাদের সবাইকে এই পরিবর্তনকে আবাহন করে নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিশ্চয়ই থাকবে তার নিজের স্থানে ও মহিমায়। কিন্তু ই-শিক্ষা তার সম্প্রসারণ ঘটাবে। এর দ্বারা শিক্ষাদান তার উৎকর্ষতার উদ্দেশ্য ও দর্শন- দুইই লাভ করবে, জ্ঞান এবং দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়ে।
লেখক – অধ্যাপক সন্দীপ ব্যানার্জী(কলকাতা)
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ