বিশ্বব্যপী মহামারী কোভিড-১৯ এর প্রভাবে আমাদের অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অস্বাভাবিক, অসাধারণ, অস্থির, অনিশ্চিত, বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি ঘোষিত হয়েছে। প্রস্তাবিত এই বাজেটটি করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় বিগত কয়েক মাসে গৃহিত বিভিন্ন নীতি, কৌশল এবং প্রণোদনাকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে জীবন জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের অন্যতম উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে।
ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেট ২০২০-২১ এর মৌলিক অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হল করোনা দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন নীতি কৌশলের সঠিক বাস্তবায়ন। যথা:মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত ১,০৩,১১৭ কোটি টাকার বিশাল প্রণোদনার দ্রুত বাস্তবায়ন, সরকারি ব্যয়ে কর্ম সৃজনকে প্রধান্য, বিলাসী ব্যয় হ্রাস ও নিরুৎসাহিত করা, স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত করা, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি এবং বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
উল্লেখিত বিষয় সমূহকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষৎ পথ পরিক্রমা’ শিরোনামের প্রস্তাবিত ২০২০-২১ বাজেটটি (১১ জুন, ২০২০) মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এই সরকারের প্রতিটি বাজেটই রেকর্ড ভেঙ্গেছে। এবার তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেটও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাজেট ২০২০-২১ এ মোট ব্যয় প্রাক্কলন হয়েছে ৫,৬৮,০০০ কোটি টাকা। যেটি সংশোধিত ২০১৯-২০ থেকে ৬৬,৪২৩ কোটি টাকা বা ১৩.২৪ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য যে, ২০১৯-২০ এর পরিমাণ ছিল ৮০,৬৪৯ কোটি টাকা বা ১৮.২ শতাংশ বেশি।একইভাবে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩,৭৮,০০০ কোটি টাকা যেটি সংশোধিত ২০১৯-২০ অর্থসাল থেকে ২৯,৯৩১ বা ৮.৬০ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের মোট রাজস্ব প্রাক্কলন পূর্ববর্তী সংশোধিত বাজেটটির তুলনায় ৬১,১৯৭ কোটি টাকা বা ১৯.৩২ শতাংশ বেশি। মোট ব্যয় এবং রাজস্বপ্রাক্কলনের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে বলা যায় যে, মোট ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি রাজস্ব প্রবৃদ্ধির তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং মোট বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১,৯০,০০০ কোটি টাকা, যেটি জিডিপির ৬.০০ শতাংশ।
২০১৯-২০ সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে ১,৫৩,৫০৮ কোটি টাকা, যেটি জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে বহিঃ উৎস হতে ৮০,০১৭ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ১,০৯,৯৮৩ কোটি টাকা যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ ৮৪,৯৮০ কোটি টাকা ঘাটতি অর্থায়নের প্রাক্কলন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৯-২০ সংশোধিত বাজেট বহিঃ উৎস হতে ৫৬,১৬৩ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ৯৭,৩৪৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ ৮২,৪২১ কোটি টাকার অর্থায়ন পুনঃপ্রাক্কলন করা হয়েছে। অথচ ২০১৯-২০ এ ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের প্রাক্কলন ছিল ৪৭,৩৬৪ কোটি টাকা।
ঘাটতি অর্থায়ন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, বহিঃ উৎস হতে অর্থায়ন টার্গেট অনুযায়ী না হওয়ায় এবং রাজস্ব আদায় ঘাটতির কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাজেটের টার্গেট অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে ঘাটতি অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হয়, তাই বাজেট২০২০-২১ এ ঘাটতি অর্থায়ন ১,৯০,০০০ কোটি টাকা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জিং।
কেননা অভ্যন্তরীণ উৎস বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাজেট অতিরিক্ত ঋণ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্তসহ তারল্য সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতিতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সুতরাং রাজস্ব আহরণ এবং বৈদেশিক উৎস হতে প্রাক্কলিত অর্থ যথাসময়ে সংগৃহিত না হলে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এ জন্য রাজস্ব আহরণে এবং ঘাটতি অর্থায়নে বিশেষ করে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নে সাফল্য দেখাতে না পারলে প্রস্তাবিত বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তাই প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কলা-কৌশলসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থা অতীতের যে কোন সময় থেকে বেশি নিতে হবে। মোট বাজেট ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে, সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১,৫৫,৫৩৬ কোটি টাকা যা বরাদ্দের ২৭.৩৮ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ১,৬৭,০১১ কোটি টাকা (মোট ব্যয়ের ২৯.৪০ শতাংশ), সাধারণ সেবা খাতে ১,৪০,২৬৫ কোটি টাকা (মোট ব্যয়ের ২৪.৬৯ শতাংশ), সুদ পরিশোধ ৬৩,৮০১ কোটি টাকা বা ১১.২৩ শতাংশ এবং সরকারি বেসরকারি অংশীদ্বারিত্ব (PPP), আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি এবং বিনিয়োগসহ মোট ৩৬,৬১০ কোটি টাকা যা বরাদ্দের ৬.৪৫ শতাংশ এবং উক্ত বরাদ্দগুলো যথাক্রমে সংশোধিত বাজেট ২০১৯-২০ চলতি অর্থ বছরের যথাক্রমে ১,৩৯,৫০৮ কোটি টাকা(২৭.৮১ শতাংশ), ১,৫৯,৫৪৫ কোটি (৩১.৮১শতাংশ), ১,১০,৮১৩ কোটি (২২.০৯ শতাংশ), ৫৭,৬৬৪ কোটি (১১.৫০ শতাংশ) এবং ৩০,০৯৯ কোটি টাকা (৬.০০শতাংশ) পুনঃপ্রাক্কলন করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ যে, সামাজিক অবকাঠামো এবং ভৌত অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়লেও মোট বরাদ্দের শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।
বিগত তিন বছরে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত যথাক্রমে ৭.২৮,৭.৮৬ এবং ৮.১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এবং সামষ্ঠিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আলোকে চলতি বছরে প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আগ্রাসী আক্রান্তে ৫.২ শতাংশে সংশোধিত প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাজেট ২০২০-২১ এ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ।
বাজার চাহিদাসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী অবস্থায় পুনর্বাসন হলে হয়ত এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা। মুদ্রাস্ফিতি ৫.৪ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার আসার প্রত্যয় বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে বিচার বিশ্লেষণপূর্বক অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে যেটি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমান হবে।
কেননা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ১০,০০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ এবং এই খাতে ২৯,২৪৭ কোটির টাকা বরাদ্দ যেটি ২০১৯-২০ এ ছিল ২৫,৭৩২ কোটি টাকা, তাছাড়া স্বাস্থ্য সেবায় আরো ১৩টি মন্ত্রণালয় যুক্ত আছে সেগুলোসহ বিবেচনায় নিলে মোট বরাদ্দ ৪১,০২৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা আরেকটি অগ্রাধিকার খাত যেটিতে আগামী অর্থ বছরে ৯৫,৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে যা বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.০১ শতাংশ। সংশোধিত বাজেট ২০১৯-২০ এ যেটি ৮১,৮৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল।
বিশ্লেষণে বলা যায় যে, বরাদ্দের এই প্রবৃদ্ধি সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আওতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। কৃষি এবং কৃষির উপখাতকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে বাজেটে বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা, ভর্তুকি এবং নানা নীতি কৌশল প্রাধান্য পেয়েছে। এই খাতে মোট বরাদ্দ ২৯,৯৮৩ কোটি টাকা। যা সংশোধিত বাজেটে ২৭,০২৩ কোটি টাকা। বরাবরের মতই সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত যেটি মোট ৮৫,৭৬০ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ১৫.১ শতাংশ এবং যেটি সংশোধিত ২০১৯-২০ এ প্রাক্কলন হয়েছে ৭৭,০৩৯ কোটি টাকা। যদিও বরাবরের মতোই উল্লেখযোগ্য বাজেট বরাদ্দ পাবলিক সার্ভিস খাতে হয়ে থাকে যেখানে সুদ পরিশোধ ৬৩,৭৭৬ কোটিসহ মোট বরাদ্দ ১,৮০,৭১৫ কোটি টাকা যেটি মোট বরাদ্দের প্রায় ৩২.০০ শতাংশ।
এছাড়া পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ৬৪,৫৮৭ কোটি টাকা যা বরাদ্দের ১১.৪ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ণ মন্ত্রণালয়ে ৩৯,৫৭৩ কোটি (বরাদ্দের ৭.০০ শতাংশ), প্রতিরক্ষা খাতে ৩৪,৮৮২ কোটি টাকা (বরাদ্দের ৬.১ শতাংশ), সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ খাতে ৩২,১৬৬ কোটি টাকা (বরাদ্দের ৫.০ শতাংশ) ইত্যাদি খাতগুলো উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ পেয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন খাতগুলোর বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে, প্রস্তাবিত বাজেট জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বিধানমূলক কর্মসূচি এবং কর সহনীয়করণ সহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারী মেঘা প্রকল্প সমূহ এবং স্থবির বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নানা কলাকৌশল অগ্রাধিকার পেয়েছে।
বাংলাদেশের অপার উন্নয়ন সম্ভাবনা, জনগণের প্রত্যাশা, ভোগ ও চাহিদার ক্রমোন্নতি, বর্তমান অর্থনৈতিক স্থিতিশিলতা ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে বলা যায় যে, আকার রক্ষণশীল না হওয়াই ভাল। বড় আকারের বাজেটে অনেকে মনে করেন যে, অর্থের অপচয় ও অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমি বলব অর্থ বরাদ্দে উদারতা থাকা ভাল এবং অনেক সময় সফলতা আসে তবে অর্থ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক থাকা এবং অর্থ অপব্যবহার বা অপচয় রোধকল্পে সচেতনতা সহ কঠোরতা অবলম্বন করলে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিশেষ করে সেপ্টেম্বর ২০২০ যদি বিশ্ব মহামারী কোভিড-১৯ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনে আসলে বিশাল এই বাজেট অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কিত স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার সমষ্টিকে অর্থনীতির সুচকগুলো যথা- মুদ্রাস্ফীতি ৫.৪ শতাংশ রাখা, মধ্যমেয়াদী নীতি কৌশল কঠোরভাবে পরিপালনসহ কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, রপ্তানিখাত, আবাসনখাত, প্রবাসি আয় ও সেবা খাতকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নেওয়ার অঙ্গীকার, দারিদ্র নিরসন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট এবং আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে স্ববিশেষ সূচক ও চলকগুলোকে বাজেট বাস্তবায়নে কঠোরভাবে পরিপালনসহ নজরদারিতে রাখতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কোন ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ নতুন করারোপন ছাড়াই এই বিশাল বৃহৎ এবং উচ্চ বিলাসী বাজেট যদি প্রত্যেক মাসে আনুপাতিক হারে সততা ও আন্তরিকতার সাথে সঠিক অর্থে ও মানসম্মতভাবে বাস্তবায়িত হলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি, অবকাঠামো ঘাটতি হ্রাস এবং দারিদ্রবান্ধব, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বিধানমূলক ব্যয় ইত্যাদির মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেট সার্বিক জনকল্যাণে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে।
মুদ্দোকথা, প্রস্তাবিত বাজেটের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে সারা বৎসরের আর্থিক কর্মকান্ডগুলো মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিকের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে গুণগত ও পরিমাণগত বৈশিষ্টের আলোকে মানসম্মত বাজেট বাস্তবায়নের উপর। কেননা বিগত বৎসর সমূহে বাজেট অবাবস্তবায়নের হার প্রায় ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২১ শতাংশে পৌঁছেছে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বর্তমান বিনেয়োগ যথেষ্ট নয়। সক্ষমতার অভাবে এডিপি বাস্তবায়ন পুরোপুরি না হওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ কাঙ্খিত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আবার বছর বছর সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, এর গুণগতমান বৃদ্ধি এবং অর্থ বৎসর শেষ তিন মাসে বা শেষ প্রান্তিক অত্যাধিক ব্যয় প্রবণতার কারণে সরকারি অর্থের অপচয়, কাজে নিম্নমান ও গুণগতমান হ্রাস, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়।
অন্যদিকে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ গত কয়েক বছর ধরে ২১-২২-২৩ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধির জন্য এই হার জিডিপির ২৬-২৭ শতাংশে উন্নীত করা দরকার। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আগামী অর্থ বছরে ঋণ সুবিধা, বিনিময় হার, তারল্য সংকট, খেলাপী ঋণ সংকট, মুদ্রাস্ফীতির হার, বর্হিখাতের অসামঞ্জস্যতা, বিনিয়োগকারীর আস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংকটসহ প্রধানতম বিশ্ব মহামারী কোভিড-১৯ এর ধংসাত্বক আক্রমন ও প্রভাব ইত্যাদি কারণে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে অন্যান্য চ্যালেঞ্জ সমূহের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আহরণ অন্যতম, অবকাঠামোগত ঘাটতি, সরকারি ব্যয়ের অগ্রাধিকার ঠিক করা, ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থ প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সমুহ, রপ্তানী বৈচিত্রকরণ, রপ্তানীর প্রবৃদ্ধির তুলনায় আমদানী প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক বৃদ্ধি, কাঙ্খিত মাত্রায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সঞ্চয় বিনিয়োগ তারতম্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উপরোক্ত চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ব্যয়ধিক্য (Cost Overrun) এবং বাস্তবায়ন সময়োত্তর্ণের (Time overrun) সঠিক ঝুকি নির্ণয়, মাসিক ভিত্তিতে প্রকল্প রেজাল্ট ভিত্তিতে মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা দরকার। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বৈদেশিক সূত্র থেকে ঝামেলামুক্ত ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত, ৯% সুদের হার, বিনিময় হার, মুদ্রাস্ফিতির হার, আস্থার উন্নতি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহণ ও যোগাযোগ ইত্যাদি চলমান কার্যক্রমগুলোর সুষ্ঠ সমাপ্ত সহ ইত্যাদি বিষযের উপর জোর নজরদারি, তদারকি এবং স্থিতিশিলতা অন্যতম নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। এছাড়া বাজেটকে সঠিক বাস্তবায়নে সক্ষমতা, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের স্বচ্ছ রোডম্যপ, রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে গুণগত পরিবর্তন ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে বাজেট বাস্তবায়নের অনেক চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট, ব্যবসা ব্যয়-হ্রাস, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান, অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে এই বাজেটে সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোখাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যয়ের গুণগতমান, বাস্তবায়ন সময়, মোট প্রকল্প ব্যয়, ইত্যাদির উপর অধিক গুরুত্বরোপ করে সঠিক ব্যয়ে সঠিক সময়ে এবং সঠিক গুণে ও মানে প্রকল্প কার্য সমাপ্তের জন্য সঠিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে।চলমান বৃহৎ প্রকল্প গুলোর বাস্তবায়নের হার সময় সময় প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জনসম্মুক্ষে প্রচারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। যেমন- বাংলাদেশ দৈনিক কতটুকু বা কত কিলোমিটার রাস্তা সম এককে (equivalent unit)তৈরি হচ্ছে, দৈনিক কত কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে (সম এককে) ইত্যাদি প্রকাশ করার জন্য সুপারিশ করছি। সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোর কারণে সুফলগুলো সুস্পষ্ট করা উচিত বলে মনে করি।
নিম্ন আয়ের ব্যক্তিবর্গ, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসায়ী বৃন্দকে কোভিড-১৯ এর ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আয়করের অ-করযোগ্য সীমা বৃদ্ধি, প্রথম ১,০০,০০০ টাকায় ৫% আয়কর, সর্বোচ্চ কর হার ৩০% এর বদলে ২৫%, অতালিকাভূক্ত কর হার হ্রাস, কৃষি ও কৃষি উপখাতে নিয়োজিত কৃষি যন্ত্রপাতিতে শুল্ক হ্রাস, ভ্যাট রেয়াত, কাস্টমের হয়রানি রোধে বিভিন্ন কর্ম কৌশল, রপ্তানী মূখী দেশীয় এবং আমদানী পরিপূরক শিল্প ও ব্যবসায়কে সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরণের প্রণোদনার প্রবর্তন, শুল্ক হ্রাস, কর হার হ্রাস, রাজস্ব প্রণোদনাসহ বিভিন্ন নীতি কৌশলের সহায়তা বাজেটে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
মোটামুটি বড় ধরনের নতুন কোন কর আরোপ ছাড়াই এই বাজেট প্রণীত হয়েছে। রাজস্বের উৎসের জন্য অনেকটা ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে অর্থমন্ত্রী অনেকটাই কালোবাজারীর অর্থের উৎসের উপর নির্ভরশীল হতে চেয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা এ ব্যপারে সুখকর নয় তবে আগামী অর্থবছরের অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন হয় কিনা দেখার বিষয়। সকল পক্ষকে মোটামুটি স্বস্তি দিয়ে এই বাজেট বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা রচিত হয়েছে সেটি সঠিক অর্থে দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে এবং সময়মত বাস্তবায়নের সকল কর্মকৌশল গ্রহণ ব্যতীত সফলতা দূরহ হবে।
বিশ্ব মহামারী কোভিড-১৯ বিগত কয়েক মাসে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত বিশ্বকে একটি শিক্ষা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, অদূর ভবিষৎতে বা নিকট ভবিষৎতে বহু জানা, অসস্পষ্ট, স্পষ্ট এবং অজানা চ্যালেঞ্জ এবং বিপদ যে কোন সময় দেখা দিতে পারে যেটি অর্থনীতি পুর্নগঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে যা অবশ্যই বৈচিত্রময় ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত ঘটনাবলীর সাথে দ্রুত তাল মিলিয়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের ব্যবস্থা রেখেই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সংগে সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে।
লেখক- অধ্যাপক, একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন পরিচালনা পর্ষদ।
নির্বাহী চেয়ারম্যান, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড পরিচালনা পর্ষদ।
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ