নতুন করোনাভাইরাস এরিমধ্যে বিশ্বের একশোর বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই। কোভিড–১৯ রোগের সর্বব্যাপী বিস্তার শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউই। জীবন–মৃত্যু থেকে শুরু করে আয়–রোজগার পর্যন্ত – সমাজ, রাজনীতি বা অর্থনীতির সবখানেই গভীর প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে ভাইরাসটি।

তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর বিস্তার এখনো কম। ৮ মার্চ বাংলাদেশ প্রথম সংক্রমণের ঘোষণা দিয়েছে। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯ জনে পৌঁছেছে। এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের সাংবাদিকরাও একটি বৈশ্বিক মহামারি সামনে থেকে কাভার করার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। নতুন করোনাভাইরাস কাভার করা চ্যালেঞ্জিং নানা কারণে। প্রথমেই রয়েছে, যিনি বা যারা মাঠ থেকে খবর সংগ্রহ করছেন তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি। এছাড়া খবরে আতঙ্ক ছড়ানো, চারিদিকে ভুয়া তথ্যের বিস্তার, এবং নির্ভরযোগ্য সূত্র ও বিশেষজ্ঞের অভাবের মত সমস্যা তো আছেই। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে নিরাপদে রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাথায় রাখতে হয় দায়িত্বশীলতার সাথে খবর তৈরি এবং প্রচারের বিষয়টিও। অন্য যেকোনো মহামারির মতোই, করোনাভাইরাসের কাভারেজে সতর্ক হওয়ার গভীর দায় আছে প্রতিটি গণমাধ্যমের। কিন্তু কিভাবে সতর্ক হবেন – এই প্রশ্নের উত্তর এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অভিজ্ঞ সাংবাদিক এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের আলোকে।

সবার আগে নিজের নিরাপত্তা
সাধারণ নাগরিকের জন্য নিজেকে রক্ষার যত রকমের উপায় আছে, তার সবই একজন সাংবাদিকের জন্যেও প্রযোজ্য। পার্থক্য হলো, একজন নাগরিক তার চলাফেরা ঘরে বা নিরাপদ স্থানে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন। কিন্তু একজন সাংবাদিককে পেশার প্রয়োজনেই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যেতে হয়। করোনাভাইরাসের খবরও সংগ্রহ করতে হবে, কিন্তু মাথায় রাখবেন, তা নিজের নিরাপত্তাকে বাদ দিয়ে নয়। সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) করোনাভাইরাস কাভারেজের একটি অ্যাডভাইজরি প্রকাশ করেছে। খবর সংগ্রহের আগে, খবর সংগ্রহের সময় এবং পরে, কি ধরণের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তা সেখানে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সিপিজের অ্যাডভাইজরি থেকে জেনে নিন আক্রান্ত এলাকায় গেলে কি করবেন:
-> সর্দি, কাশি বা শ্বাসযন্ত্রের রোগে ভুগছেন, এমন মানুষের কাছাকাছি যাবেন না। নিজে হাঁচি–কাশি দেবার সময় হাত দিয়ে নাক ও মুখ ঢেকে রাখবেন।
-> গরম পানি ও সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন। সাবান বা গরম পানি না পেলে ব্যাকটিরিয়া প্রতিরোধী জেল বা ওয়াইপস ব্যবহার করুন। কিন্তু তারপর যত দ্রুত সম্ভব গরম পানি ও সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন।
-> হাসপাতাল বা আক্রান্ত স্থানে খবর সংগ্রহ করতে গেলে হাতে দস্তানা পড়ে নিন। মাথায় রাখুন, এসব জায়গায় বডিস্যুট ও ফেসমাস্কের মত পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) দরকার হতে পারে।
-> আক্রান্ত এলাকার কাঁচা–বাজার বা খামারে যাবেন না। জীবিত হোক বা মৃত – পশু–পাখির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। সেই প্রাণির সংস্পর্শে এসেছে এমন দেয়াল বা কোনো কিছুতে হাত দেবেন না।
-> যদি আক্রান্ত বাজার বা খামারে যেতেই হয়, তাহলে আপনার কোনো যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জামই মাটিতে রাখবেন না। ফিরে এসে ব্যাকটিরিয়া প্রতিরোধী জেল (মেলিসেপ্টল) বা ওয়াইপস দিয়ে পরিষ্কার করে নিন।
-> আক্রান্ত এলাকার বাজারে যেতে হলে, ডিসপোজেবল অথবা পানি–নিরোধী জুতো পড়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে বেরুনোর পরপরই তা ধুয়ে–মুছে নিন এবং কাজ শেষ হলে তা ফেলে দিন।
-> আক্রান্ত এলাকায় বা সেখানে কোনো পশুপাখির পাশে দাঁড়িয়ে কিছু খাবেন না, অথবা পান করবেন না।
-> আপনার নিজেরই শ্বাসকষ্টসহ রোগের উপসর্গ দেখা দিলে কী করবেন, তা আগেই ভেবে রাখুন।
-> আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগের নীতিমালা (অনেকখানেই যেমন সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনের কথা বলা হয়) মেনে চলুন।
-> আক্রান্ত এলাকা থেকে ফেরার ১৪ দিনের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং আপনার অফিসকে জানান।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এই ভাইরাস প্রতিরোধের উপায় জানানো হয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে। পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করে নিতে পারেন এখান থেকে।

দয়া করে আতঙ্ক ছড়াবেন না
চলতি বছর ১২ই জানুয়ারি থেকে টানা এক মাস করোনাভাইরাস বিষয়ক প্রায় সাড়ে নয় হাজার খবর বিশ্লেষণ করেছেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার অধ্যাপক কারিন ওয়াল–জোরগেনসেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন, প্রায় ১১শ খবরে “ভয়” অথবা “ভীত” শব্দটি এসেছে। অন্তত ৫০টি রিপোর্টে রোগের পরিচয় দিতে গিয়ে “কিলার ভাইরাস” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নিম্যানল্যাবে প্রকাশিত একটি লেখায় তিনি গবেষণার এই ফলাফল তুলে ধরেন। তাঁর মতে, মহামারির খবর দিতে গিয়ে গণমাধ্যম অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক ছড়ায়।

যে কোনো নতুন রোগের সংক্রমণই ভীতিকর। কারণ, তখনো মানুষ জানে না কিভাবে সেই ভাইরাস বা রোগটিকে মোকাবেলা করতে হয়। আর এই সুযোগেই আতঙ্কও ডানা মেলে। জোরগেনসেন তুলে ধরেছেন – কিভাবে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো প্রতিদিন “প্রাণঘাতী রোগ” বলে ভয়টাকে বাড়িয়ে তুলছে; করোনাভাইরাসে ব্যবসার বিপর্যয় নিয়ে শিরোনাম কি প্রভাব ফেলছে; করোনাভাইরাস বোঝাতে শুধু মাস্ক পড়া চীনাদের ছবি ছাপিয়ে কিভাবে এশিয়দের প্রতি ভীতি বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সতর্ক হয়ে খবর প্রকাশের বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে এশিয়ান আমেরিকান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনকে একটি বিবৃতিও দিতে হয়েছে।

প্রশ্ন হলো: আতঙ্ক না ছড়িয়ে রিপোর্টিংয়ের উপায় কি? এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছেন পয়েন্টার নিউজ ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ফ্যাকাল্টি অ্যাল টম্পকিনস। তার মতে, একমাত্র সমাধান হলো: দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা। এই লেখায় তার সব পরামর্শ বিশদভাবে রয়েছে। এখানে শুধু সারাংশটুকু তুলে ধরা হলো।

১. প্রতিবেদনে বিশেষণের ব্যবহার কমান। যেমন: “প্রাণঘাতী” রোগ
২. ছবি ব্যবহার করুন সতর্কতার সাথে, যেন তা ভুল বার্তা না ছড়ায়।
৩. আপনার প্রতিবেদনে ঘটনার প্রেক্ষাপটও তুলে ধরুন।
৪. শুধু ভয়াবহতার কথা না বলে, এমন পরিস্থিতিতে কী করতে পারে, সেই পরামর্শও দিন।
৫. ব্যক্তি–অভিজ্ঞতার ভয় জাগনো বিবরণের চেয়ে পরিসংখ্যান–নির্ভর স্টোরি কম ভীতিকর।
৬. মনে রাখবেন, ভাইরাসের বিস্তার একটি প্রাকৃতিক বিষয়। বিশ্বে এর চেয়ে ভয়ংকর আরো অনেক বিষয় আছে।
৭. এই বিষয় নিয়ে যত মিথ বা ভ্রান্ত জনশ্রুতি তৈরি হয়েছে – ভেঙ্গে দিন।
৮. ক্লিকবেইট হেডলাইন পরিহার করুন এবং রিপোর্ট উপস্থাপনে সৃজনশীল হোন।

সাংবাদিক ক্যারোলিন চেন কাজ করছেন মার্কিন গণমাধ্যম প্রো–পাবলিকায়। তিনি সার্স এবং ইবোলা ভাইরাস বিস্তারের ঘটনা সামনে থেকে কাভার করেছেন। নিজ প্রতিষ্ঠানের সাইটে প্রকাশিত একটি লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন এ ধরণের ঘটনা কিভাবে কাভার করতে হয়। করোনাভাইরাস নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলে আপনি কাকে কী ধরণের প্রশ্ন করবেন, পরিসংখ্যান যেখানে নিয়ত পরিবর্তনশীল সেখানে সাবধানতা কিভাবে বজায় রাখবেন, কেন প্রাক্কলন বা পূর্বাভাস করা ঝুঁকিপূর্ণ – লেখাটিতে এসব বিষয় তিনি বর্ণনা করেছেন নিজ অভিজ্ঞতা থেকে।

চারিদিকে গুজব, যাচাই করে নিন
রসুন খেলে করোনাভাইরাস মরে যায়, কোন গোপন পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে, একটি কোম্পানি ভ্যাক্সিন বানিয়ে ফেলেছে, হোমিওপ্যাথি কোভিড–১৯ সারায়, গরমকালে এই ভাইরাস থাকবে না – এমন অনেক খবর নিশ্চয়ই আপনাদের নজরে পড়েছে। যে কোনো মহামারিতে এই ধরণের ভুয়া খবর বা মিথ্যা তথ্যে ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যম সয়লাব হয়ে যায়। এবারো ব্যতিক্রম নয়। অনেক সময় দেখা যায়, অখ্যাত উৎস থেকে নিয়ে যাচাই ছাড়াই এমন খবর প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমও ছেপে দিচ্ছে। এতে পাঠকরা যেমন বিভ্রান্ত হন, তেমনি কখনো কখনো আতঙ্কও ছড়ায় জনমনে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের নিজেদের সাইটে এমন অনেক মিথ ও গুজব খন্ডন করেছে।

যতদিন মহামারি থাকবে ততদিনই এমন সব গুজব ও ভুয়া খবর কমবেশি আপনার সামনে আসবে। তাই গুজব যাচাই করে নিন। নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে যত ভুয়া খবর আসছে, তার সত্য–মিথ্যা যাচাই করে, নিজেদের সাইটে প্রকাশ করছে এএফপি। সেখান থেকে আপনিও অনুপ্রেরণা নিতে পারেন। ছয় মার্চ পর্যন্ত তারা ৯৭টি এমন মিথ খন্ডন করেছে। পয়েন্টারের এই প্রতিবেদনেও আপনি দেখতে পাবেন কোন দেশে কী ধরণের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্কের অধীনে ৯০টি প্রতিষ্ঠান জোট বেঁধে করোনাভাইরাস নিয়ে ছড়ানো মিথ্যা তথ্য যাচাই করছে। এই লেখায় তাদের কিছু রিপোর্টেরও উদাহরণ পাবেন। আর এই টিপশীট আপনাকে জানাবে, মিথ্যা খবর না ছড়িয়ে কিভাবে করোনাভাইরাস কাভার করতে হয়।

শুধু খবর নয়, এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসছে করোনাভাইরাস বিস্তারের কিছু মিথ্যা মানচিত্রও। দুর্যোগের সময় ম্যাপের মাধ্যমে কিভাবে ভুয়া খবর ছড়ানো হয়, তা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে ফার্সট ড্রাফট নিউজ। করোনাভাইরাস নিয়ে ভুয়া খবর বিশ্বাস করে সরকার বা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা যেসব মন্তব্য করেছেন তা খন্ডন করে আসছে পলিটিফ্যাক্ট। ভারতে অল্টনিউজ, বুম লাইভ অথবা বাংলাদেশে বিডিফ্যাক্টচেকের মত সাইটে গেলেও কোভিড–১৯ নিয়ে নানা রকমের ভুয়া খবরের খন্ডন দেখতে পাবেন। নিজে থেকে কোনো তথ্য যাচাই করতে না পারলে, আপনি ফ্যাক্টচেকারদের সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে গিয়ে সাহায্যও চাইতে পারেন।

মহামারির সময়ে আতঙ্ককে পুঁজি করে প্রতারকরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিজেই তাদের সাইটে এমন প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। ভুয়া সাইট করে মানুষের তথ্য হাতিয়ে নেয়া বা তাদের নামে আপনার ইনবক্সে ফিশিং ইমেইল আসা – এমন প্রতারণা থেকে কিভাবে সাবধান থাকতে হবে, তা–ও বলা আছে এই পেইজে।

কোথায় পাবেন সঠিক তথ্য
কোথাও ভাইরাসটিকে বলা হচ্ছে নোভেল করোনাভাইরাস, কোথাও নিউ করোনাভাইরাস, কোথাও আবার দ্য করোনাভাইরাস। এত নাম কেন? কোভিড–১৯ নামটিই বা কোথা থেকে এসেছে? আপনি ভাইরাসটিকে আসলে কি নামে ডাকবেন, অথবা ভাষার ব্যবহার কেমন হবে – এসবই উঠে এসেছে কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউয়ে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে। ভাষা এবং তথ্যের উৎসসহ নানা বিষয় নিয়ে এসোসিয়েটেড প্রেসের করোনাভাইরাস স্টাইলবুক থেকে বাছাই করা পরামর্শ পাবেন এই প্রতিবেদনে। এই বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করতে হলে আপনাকে ভাইরাসটি সম্পর্কে জানতে হবে এবং হালনাগদ উপাত্ত সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আপনার মনে প্রাথমিক যত প্রশ্ন তৈরি হতে পারে, তার উত্তর পাওয়া যাবে এই পেইজে। সিপিজে বলেছে, সব সময় হালনাগাদ থাকতে হলে, আপনাকে অবশ্যই এই তিনটি সাইটে নিয়মিত যেতে হবে: ডব্লিউএইচও, সিডিসি এবং পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড। সেই সাথে নিজ দেশে সরকারের যে সংস্থাটি করোনাভাইরাস সম্পর্কে তথ্য দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। যেমন: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রোগতত্ত্ব, রোগ নিরাময় ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রোগতত্ত্ব বিভাগের দুই অধ্যাপক বিল হানাগে এবং মার্ক লিপসিচ সাংবাদিকদের জন্য পাঁচটি পরামর্শ তুলে ধরেছেন আমেরিকান সায়েন্টিফিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, যার শিরোনাম “কোভিড–১৯ রোগের বিস্তার দায়িত্বশীলতার সাথে কাভার করবেন কিভাবে।” বিশদ এই নিবন্ধে তারা যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, তার সারমর্ম এখানে:

-> বিশেষজ্ঞ বাছাই করুন সতর্কতার সাথে। বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে কেউ নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার মানে এই নয়, তিনি বিজ্ঞানের সব বিষয়ে বলতে পারবেন। একইভাবে চিকিৎসাশাস্ত্রে কেউ পিএইচডি করলেও করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানবেন এমন কোনো কথা নেই। -> বিশেষজ্ঞরা কোনটি সত্য নিশ্চিতভাবে জানেন আর কোনটি সত্য বলে মনে করেন – তার মধ্যকার ফারাকটা অবশ্যই বুঝতে হবে একজন সাংবাদিকের। জানতে হবে মতামত ও অনুমানের মধ্যে পার্থক্য।
-> প্রি-প্রিন্ট অথবা অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে উদ্বৃতি অথবা তথ্য ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক হোন। এধরণের একাডেমিক পেপার সাধারণত পর্যালোচনা বা পিয়ার রিভিউর মধ্যে দিয়ে যায় না। তাই ভুলের অবকাশ থাকে।
-> নানান নতুন তত্ত্ব এবং দাবির মধ্যে সংবাদ উপযোগী কিছু আছে কিনা, তা বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞেস করুন। পত্রিকার মতামত পাতায় প্রকাশিত তথ্যও যাচাই করুন।
-> বিজ্ঞান বিষয়ে অন্য সাংবাদিকরা কী কী রিপোর্ট করেছেন বা করছেন তা নিয়মিত পড়ুন।

দরকারি রিসোর্স
ভাইরাসের বিস্তার বিশ্বের জন্য নতুন কিছু নয়। বার্ড ফ্লু, সার্স অথবা মার্স – প্রতিটি ঘটনায় কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব, হারিয়েছে অনেক প্রাণ। আর এসব ঘটনায় সাংবাদিকরাও শিখেছেন কিভাবে মহামারি কাভার করতে হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ডার্ট সেন্টার ফর ট্রমা এমন কিছু রিসোর্সের একটি সংকলন তৈরি করেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি এখানে দেয়া রইল, যা আপনাদেরও কাজে আসবে।

-> ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু কাভারের শিক্ষা থেকে সাংবাদিক জন পোপের টিপশীট।
-> ট্র্যাজেডি ও সাংবাদিকতা – সাংবাদিক ও সম্পাদকদের জন্য গাইড
-> ট্রমা রিপোর্টিংয়ের উত্তম চর্চা
-> দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে কিভাবে কাজ করবেন

এছাড়াও আছে পয়েন্টারে প্রকাশিত “করোনাভাইরাস নিয়ে দায়িত্বশীল রিপোর্টিংয়ের গাইড.” এবং মার্কিন ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর প্রতিবেদন করোনাভাইরাস কাভারের আগে নিজের ঘর কিভাবে প্রস্তুত করবেন। যদি হাতে সময় থাকে তাহলে শুনতে পারেন দেড় ঘন্টার এই ওয়েবিনার, যেখানে সাংবাদিকদের জন্য করোনাভাইরাসের খবর সংগ্রহ কিভাবে করতে হবে, তা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন সিডিসির পরিচালক ড. ন্যান্সি মেসোনিয়ের, রিজল্ভ টু সেইভ লাইফের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমান্ডা ম্যাকলিল্যান্ড এবং ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের সংক্রমণ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক অ্যান মেরি পেটিস। এটি আয়োজন করেছে মার্কিন ন্যাশনাল প্রেস ক্লাব। আর গেট দ্য স্টোরি অন করোনাভাইরাস ক্রাইসিস শিরোনামের এই ওয়েবিনার আয়োজন করেছে সেন্টার ফর হেলথ জার্নালিজম।

আক্রান্তদের প্রতি সদয় হোন
করোনাভাইরাসের খবরাখবর জানাতে গিয়ে সাংবাদিকরা যেমন বিশেষজ্ঞের পেছনে ছুটছেন তেমনি ভিকটিমদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভিকটিমদের কথা বলতে গিয়ে আপনি কি তাঁকে আরো বিপদে ফেলছেন কিনা? কারণ আপনার রিপোর্ট প্রকাশের পর হয়ত ভিকটিমের কিংবা তাঁর পরিবারে সমাজে চলাচল বিঘ্নিত হতে পারে। অথবা তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারেন। ফলে আপনার রিপোর্টে ভিকটিমের ছবি দেখানো কিংবা তার পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাবধানী হওয়া জরুরী। এক্ষেত্রে যার পরিচয় দিবেন তাঁর অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। ট্রমা আক্রান্ত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন, পড়ে নিতে পারেন সেন্টার ফর হেলথ জার্নালিজম থেকে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে, হাসপাতালগুলো আরো ব্যস্ত হয়ে পড়বে। সেখান থেকে আক্রান্তদের ছবি, পরিচয় দেখানোর আগে একজন মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরী। আপনি হয়তো একটি রিপোর্ট করলেন, জানালেন – কিন্তু আপনার রিপোর্টের কারণে যদি আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতি হয় তার দায়ভারও আপনারই। এ ধরণের পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল রিপোর্টিংয়ের কিছু দরকারি গাইডলাইন পাবেন ডার্ট সেন্টারের এই লেখায়।

দায়িত্বশীল কাভারেজ
করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এখন যে তথ্য প্রাসঙ্গিক, কিছুক্ষণ পরই সেই তথ্য হয়ে পড়ছে অর্থহীন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজিং এডিটর মাইকেল স্ল্যাকম্যানের ভাষায়, “দিনে ২৪ ঘন্টা, সপ্তায় সাত দিন এবং গোটা বিশ্বজোড়া এই স্টোরি।” একারণে তারা একটি লাইভ ব্লগে করোনাভাইরাসের খবর দিচ্ছেন, তা প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে, এবং তিনজন সম্পাদক তিন অঞ্চল থেকে এটি পরিচালনা করছেন। এপি একটি স্ল্যাক চ্যানেল তৈরি করেছে, যেখানে তাদের ৪০০ সাংবাদিক প্রতিদিন অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময় করছে। এনবিসি তাদের সকালের নিউজলেটারটি তৈরি করছে শুধু এই রোগ নিয়ে। এভাবে আপনার নিউজরুমকেও ঠিক করে নিতে হবে কিভাবে আতঙ্ক না ছড়িয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে মানুষের কাছে সঠিক খবরটি পৌঁছে দেবেন।

সবশেষে দায়িত্বশীল কাভারেজ নিয়ে আইজেনেটের ১০টি পরামর্শ:

১. মাঠের মেজাজ বুঝে, তাকে আপনার রিপোর্টে তুলে ধরুন।
২. রিপোর্টিংয়ে মনোযোগ দিন, বিশ্লেষণে নয়।
৩. শিরোনাম খেয়াল করুন, অনেকে শুধু শিরোনাম দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়।
৪. মনে রাখবেন সব পরিসংখ্যান সঠিক না–ও হতে পারে।
৫. যত বেশি মানুষের সাথে কথা বলবেন, তত ভালো।
৬. জাতি বা বর্ণ বিদ্বেষ তৈরি করে এমন বাক্য পরিহার করুন।
৭. বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে যথার্থ প্রস্তুতি নিন।
৮. চমক নেই বলে, কোনো স্টোরিকে অবজ্ঞা করবেন না।
৯. নিজের সীমা ঠিক করুন, সময় নিয়ে ভাবুন।
১০. রোগ চলে গেলেও আপনার রিপোর্টিং থামাবেন না।

লেখকঃ 
জিআইজেএন’র বাংলা সম্পাদক। পাশাপাশি তিনি জিআইজেএন’র সদস্য সংগঠন, গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা, এমআরডিআইয়ের হেড অব প্রোগ্রাম অ্যান্ড কমিউনিকেশনস্ হিসেবে কাজ করছেন। সাংবাদিকতায় তাঁর রয়েছে ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা। যার বড় অংশই টেলিভিশনে।

নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্‌স নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে