ইলিয়াস কাঞ্চন জনগণের জন্য কাজ করে সড়কের দানবশক্তির কাছে অপমানিত হন। দানবশক্তিকে রাষ্ট্রযন্ত্র রুখতে পারে না রাজনৈতিক কারণে। আর জনগণ সেখানে যেন ঘরে বসে দানবশক্তির হাতে ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতি নোংরা-অসভ্য আক্রমণের দৃশ্য দেখে আর উপভোগ করে। বীরের জাতি যেন আজ কাপুরুষে পরিণত। ইলিয়াস কাঞ্চন এ দেশের চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এই মানুষটি কোনো সরকারের কাছ থেকে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা চাননি। তবে তাঁর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে গণসচেতনতা তৈরির জন্য মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার সরকার সমাজসেবায় অবদানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
১৯৭৭ সালে বসুন্ধরা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিষেক। তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনকে বেদের মেয়ে জোছনা ছবিটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। তিনি একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে জাহানারার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কাবিননামা হলেও ’৮৩ সালে ঘরের বউ করে তুলে আনেন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর বান্দরবানে ইলিয়াস কাঞ্চনের চলচ্চিত্রের শুটিং দেখতে যাওয়ার পথে চন্দনাইশে তাঁর স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তাদের একমাত্র পুত্র মিরাজুল মঈনকে নিয়ে গড়া সুখের সংসার তছনছ হয়ে যায়। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে শোকার্ত ইলিয়াস কাঞ্চন চলচ্চিত্রজগৎ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এই শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই ’৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ জীবন স্লোগানে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন শুরু করেন। বাংলাদেশে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় যখন মৃত্যুর মিছিল ও স্বজন হারানো শোকার্ত মানুষের কান্না চারদিকে, তখন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ঘুমন্ত মানুষকে জাগ্রত করতে থাকে। গণমাধ্যম তাঁর পাশে দাঁড়াতে থাকে। তাঁর সংগঠনের কর্মকা- জাতিসংঘেও প্রশংসিত হয়। দেশের বিভিন্ন মহল তাঁর আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। এমনকি ’৯৮ সাল থেকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসতে থাকেন। এজন্য গণস্বাক্ষরও নেওয়া হয়। ২০০২ সালে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করে। পরে ২০১৭ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করা হয়। সে বছর ২২ অক্টোবর ‘সাবধানে চালাব গাড়ি, নিরাপদে ফিরব বাড়ি’ স্লোগানে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়।
ইলিয়াস কাঞ্চনের আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছিল না। দেশের জনগণের নিরাপদ জীবনের জন্য সড়ক ব্যবস্থাপনায় যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লড়াই ছিল। একদিকে সড়ক ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অন্যদিকে গাড়ি, গাড়ির ফিটনেস, চালকের যোগ্যতা এসব বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অদম্য গতিতে সাহসের সঙ্গে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন এ আন্দোলন সততার সঙ্গে সারা দেশ সফর করে নিরন্তর সংগ্রামে রূপ দিয়েছেন। বহুবার তাঁর ওপর হুমকি এসেছে। পরিবহন শ্রমিক নেতাদের সরকারে থাকা মন্ত্রীর আশকারা আর পরিবহন মালিকদের সিন্ডিকেট বাণিজ্যের ষড়যন্ত্রের অশুভ শক্তি তাঁর বিরুদ্ধে নোংরা স্লোগান বক্তৃতা আক্রমণ শানিত করেছে। তবু তিনি দমে যাননি। ইলিয়াস কাঞ্চন কোনো রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে না জড়িয়ে তাঁর চিন্তা বা আইডিয়া যেমন সরকারকে দিয়েছেন, তেমনি পরিবহন সেক্টরকেও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সড়কশৃঙ্খলা না থাকার কারণে, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের কারণে, নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করার কারণে বেপরোয়া গাড়িচালকদের জন্য শুধু পথচারী আর যাত্রীরাই মৃত্যুমুখে পতিত হন না, চালক-হেলপার পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন। অথচ লুটেরা মালিক ও শ্রমিক নেতারা শ্রমিকদের বিপদে কখনো সাহায্যের হাত বাড়ান না। কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চনের এ আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ মুনাফালোভী ও চাঁদাবাজ পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বৈরিতায় মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা উপলব্ধি করতে পারছেন না, সরকারের সড়কশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ ও ইলিয়াস কাঞ্চনের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অন্যদিকে পরিবহন সেক্টরকে জিম্মি করে রাখা পঞ্চপা-বকে সমানে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের জনগণ রোষে ফুঁসছে। তাদের অবস্থান, বক্তব্য ও কর্মকান্ডকে অপরাধ ও ঘৃণার চোখে দেখছে।
২০১৮ সালে রাজধানী ঢাকায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর কিশোর ছাত্রছাত্রীরা যে উত্তাল আন্দোলনের মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশের জনগণকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিল, রাষ্ট্রযন্ত্রসহ প্রশাসনের সব স্তরকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল, তা ছিল এ দেশের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। তারা দেশের ট্রাফিক আইন হাতে তুলে নিয়েছিল। তারা স্লোগান তুলেছিল, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, রাষ্ট্রের সঙ্গে সংবিধানের ভিত্তিতে জনগণের যে চুক্তিনামা তৈরি হয়ে আছে, সেখানে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করা রাষ্ট্র্রের দায়িত্ব, তেমনি ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি জনগণের প্রাপ্য অধিকার। সেই আন্দোলনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারও সহানুভূতি জানাতে ভুল করেনি। ওরা সেদিন রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে বলে মানুষের বিবেকে নাড়া দিয়েছিল। এ দেশের অভিভাবকরা কাপুরুষের মতো সংগঠিত সড়ক হত্যার মুখে যখন নীরবে ঘরে বসে ছিলেন, তখন আমাদের মাসুম সন্তানরা সতীর্থদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাস্তায় নেমে এসে প্রমাণ করেছিল, মানুষের কল্যাণের জন্য সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করার সুযোগ নেই। সংবিধান ও আইনের কার্যকারিতা এবং সুশাসন মানুষের জীবনকে নিরাপদ করতে পারে। তারা লাইসেন্সবিহীন চালকের গাড়ি থেকে সেদিন মন্ত্রীদের নামিয়ে দিয়ে সম্মানের সঙ্গে অন্য গাড়িতে তুলে দিয়েছে। তারা সেদিন অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী মন্ত্রী-নেতাকে চালকরা উল্টো পথে নিয়ে যাওয়ায় ফিরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছে আইন সবার জন্য সমান।
সরকারের উদ্যোগের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসের মধ্য দিয়ে তাদের দাবি-দাওয়া আদায় করে শান্তিপূর্ণ ইতিহাস সৃষ্টিকারী আন্দোলনের সমাপ্তি টেনে ঘরে ফিরে গেছে। সেদিন শেখ হাসিনার সরকারও বসে থাকেনি, সে বছরই ১৯ সেপ্টেম্বর সরকার সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ পাস করে। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে তা কার্যকর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নতুন এ আইনে আইন লঙ্ঘনের শাস্তি বৃদ্ধি করা হয়। এরপর পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ সড়ক পরিবহন আইনটিতে সংশোধনসহ সাত দফা দাবিতে ঢাকা বিভাগে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। তারা ইলিয়াস কাঞ্চনকে দেশের সব বাস টার্মিনালে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। খুলনা ও ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবি পোড়ানো হয়। নতুন সড়ক আইন কয়েক দফা পিছিয়ে পরবর্তীতে ১৮ নভেম্বর কার্যকর হয়। এতে ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান মালিক ও শ্রমিক ঐক্য পরিষদ অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ সময় ইলিয়াস কাঞ্চনকে ব্যানার টানিয়ে কুশপুত্তলিকা তৈরি করে এমনকি রঙিন পোস্টার ছাপিয়ে সেখানে জুতার মালা দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের ঔদ্ধত্যপনার মুখে নেতৃত্বের দৃঢ়তার ওপর দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, এদের কাছে মাথা নত করবেন না। তেমনি ইলিয়াস কাঞ্চনও বলেছেন, কারও চাপের মুখে নতিস্বীকার করা যাবে না। সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে তবু এই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাম্ভিক অবস্থান নিলে সেখানে ঢাকার পুলিশ কমিশনার কঠোর হুঁশিয়ারই উচ্চারণ করেননি, বলেছেন, আমাদের সন্তানরা রাস্তায় নামলে কারও পিঠের চামড়া থাকবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রাতভর আলোচনার মধ্য দিয়ে আপাতত ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও গণবিরোধী আইন অমান্যকারী নিরাপদ সড়কবিরোধী বা সড়কশৃঙ্খলা নষ্টকারী এই দানবশক্তির সঙ্গে আপস করা যাবে না। সড়কের দানবদের হাতে জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় দিন শুরু করতে পারে না। আইন তাদের মানতেই হবে।
জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের ভাষা আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের আন্দোলনে আত্মদানের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের গৌরবময় অতীত স্মৃতির ওপর দাঁড়িয়ে বীরের জাতি হিসেবে গৌরববোধ করি। কিন্তু সরকার জনগণের স্বার্থে যে উদ্যোগ নিয়েছে, ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়কের জন্য যে লড়াই চালিয়ে আসছেন বৈরী পরিস্থিতির মুখে; সেখানে তাদের প্রতি রাস্তায় নেমে সংহতি জানাতে দেখি না। আমরা কাপুরুষের মতো দর্শক গ্যালারিতে বসে থাকি। বোবার কোনো শত্রু নেই- এই নীতিতে চুপ করে থাকি। চারদিকে অপরাধ সিন্ডিকেটদের দম্ভ দৌরাত্ম্য দেখে উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে বসে থাকি।
নুসরাতের বীভৎস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল বলে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা অপরাধীদের ছাড় দেননি। দ্রুত বিচারের মধ্য দিয়ে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তিদান দেশের মানুষকে আশার আলো জাগিয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে মেধাবী আবরারকে ছাত্রলীগের ছেলেরা নৃশংসভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে বিকৃত উল্লাস করে যেভাবে হত্যা করেছে, সেখানে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। অভিনন্দন জানাতে হয় রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন মুহসীন হলের সেভেন মার্ডারের খুনিদের নিজের সংগঠনের হওয়া সত্ত্বেও ছাড় দেননি, সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করেছিলেন; তেমনি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হওয়া সত্ত্বেও আবরারের খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও ছাড় দেননি। ২৬ জনের বিরুদ্ধে এই হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অপরাধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এদেরও বিচার হবে। বুয়েট প্রশাসন এদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। একটা অপরাধকে প্রশ্রয় দিলে দশটা অপরাধ সংঘটিত হতে উৎসাহ পায়। আর অপরাধীদের তড়িৎ গতিতে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করলে চারদিকে অনেক অপরাধী সংঘটিত অপরাধ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেয়।
নিরাপদ সড়ক আইন কার্যকরের প্রশ্নে দেশের জনগণের স্বার্থে সব রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে এখানে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন দিনের পর দিন বছরের পর বছর যেভাবে নায়কোচিতভাবে নেতৃত্ব দিয়ে গণজাগরণ ঘটিয়েছেন, সেখানে জনগণকে তার পাশে দাঁড়িয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের অপরাধ ও অন্যায় আবদার এবং কুৎসিত বেপরোয়া কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠে আসা গণমানুষের নেতা মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ বলেছেন, পরিবহন মালিকদের ঐক্য দেখি, শ্রমিকদের ঐক্য দেখি, জনগণের ঐক্য দেখি না। তাঁর এ দীর্ঘশ্বাসমিশ্রিত আকুতি বিবেকবান মানুষের হৃদয়ের ভাষা। আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসীম ত্যাগ, অন্তহীন নির্যাতন সহ্য করে জেল-জুলুম খেটে গোটা জাতিকে জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তে প্রতিষ্ঠা করেননি সংবিধান ও আইন লঙ্ঘনকারী অপরাধী শক্তির অভয়ারণ্যে পরিণত করতে। লাখো লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বীর যোদ্ধাদের বীরত্বের গৌরবগাথা স্বাধীনতা সংগ্রামী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা ও শহীদদের গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা বাংলাদেশ অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হতে পারে না। বীরের জাতি কাপুরুষের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে বসে থাকতে পারে না।
আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মানুষের অধিকার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ইতিহাস রচনা করে গেছেন। বাংলার বাঘ খ্যাত শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক জমিদারি প্রথাই বিলুপ্তই করেননি, কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করেই কৃষকের বন্ধু হয়েছেন। গণতন্ত্রের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ আমৃত্যু নীতিতে অবিচল থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্রের মানসপুত্র হয়েছেন। আজ তাঁদের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে আমরা তাঁদের আদর্শিক রাজনীতির বাতি নেভাতে বসেছি। কাপুরুষের মতো জাতি আজ ঘুমিয়ে আছে। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে তাঁর ঘর থেকে অর্থাৎ দলের অপরাধীদের পাকড়াও করার মধ্য দিয়ে অভিযান শুরু করেছেন। অপরাধী যেই হোক, কে কোন দল, কোন রাজনীতিতে বিশ্বাসী সেটি বড় কথা নয়, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার এই দৃঢ় অবস্থানের সঙ্গে জনগণকে পাশে দাঁড়াতে হবে। জেগে উঠতে হবে। আমাদের সব খাতে ঘুষ, দুর্নীতি, লোভ-লালসা মহামারী আকার নিয়েছে।
আমরা এতটাই নির্লজ্জ জাতিতে পরিণত হয়েছি যে, চোখের সামনে যারা অন্যায়ভাবে অপরাধ করে দুর্নীতির মধ্যে ডুবে গিয়ে পাপের সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছে, তাদের সমীহ করে চলি। অনেক শিক্ষিত লোক দুদক তলব করলে দুর্নীতিবাজের পক্ষে সাফাই গায়। বিসিবির পরিচালক পদে বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদার শ্যালক কীভাবে থাকে? এ প্রশ্ন তুললে কেউ কেউ ব্যথিত হয়। সৎ-আদর্শবানরা সমাজে উপেক্ষিত, বিদ্রুপের শিকার হচ্ছে। খুনিচক্র, লুটেরা অপরাধীদের প্রতি সমীহ করার নীতি পরিহার করে অন্তরাত্মার ডাকে সেই অপরাধী যদি মন্ত্রী হয়, এমপি হয়, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হয়, আমলা হয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়, তাদের সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেও ঘৃণা, বয়কট ও প্রতিরোধ করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যে সুপার সিন্ডিকেট বিদেশে লাখ লাখ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে, ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়ে গেছে, ব্যাংকের টাকা নিয়ে ঋণ শোধ কোনোটাই না দিয়ে দেশে-বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করে তাদের এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পাকড়াও করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আইনের সংস্কার করে হলেও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। প্রশ্রয় বা উৎসাহ রাষ্ট্র দিতে পারে না। সব সেক্টরে অপরাধ সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। ১০ বছরে দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত যেসব নেতা-কর্মী বিপুল অর্থবিত্ত ও বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছে দুর্নীতির অর্থে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারি দলকে যেমন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি আইনের আওতায় আনতে হবে। দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের বিবেকের তাড়নায় তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।
শেখ হাসিনার আকাশছোঁয়া উন্নয়নের সাফল্য মাঝেমধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে একেক মন্ত্রী, সচিব বা কর্মকর্তার ব্যর্থতায়। পিয়াজ সংকট হবেÑ এ নিয়ে ছয় মাস না হোক দু-তিন মাস আগে হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠক করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আজ এ পরিস্থিতি হতো না। বাণিজ্যমন্ত্রী আকাশে উড়ে বেড়ান। আজ এ দেশে তো কাল আরেক দেশে। তার মন্ত্রণালয়ের মিটিং বাতিল হয়। তার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মিটিং হয় না। সব সাফল্যের কৃতিত্ব যেমন প্রধানমন্ত্রীর তেমনি কারও ব্যর্থতার দায়ও মুজিবকন্যাকে বহন করতে হবে। শেখ হাসিনাকে বুঝতে হবে এটা। এমন বাণিজ্যমন্ত্রী এ দেশে আসেনি। বিএনপির আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ব্যর্থতায় মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। ব্যর্থদের সরিয়ে যোগ্যদের বসানোই হবে উত্তম।
ঘুঘুর মতো বারে বারে শেয়ারবাজার লুট করে নিয়ে গিয়ে জুয়াড়ি সিন্ডিকেট লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে রিক্ত-নিঃস্ব করে দিয়েছে। যেসব ব্রোকার হাউসের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন, সেসব ব্রোকার হাউসের অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। আগের দফায় নেতৃত্ব দিয়েছেন মুশতাক আহমেদ সাদেক। বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাকিল রিজভীরা। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে কমিশনার, সরকারি আমলা আর মন্ত্রীদের চাটুকারিতা ছাড়া শেয়ারবাজার চাঙ্গা করা কিংবা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার আলো জাগাতে এরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দাস সংস্কৃতিতে বাস করা মোসাহেব নেতৃত্ব দিয়ে কোথাও কোনো মানুষের কল্যাণ আসে না। এরাসহ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের নির্বাচিত পরিচালকরা যখন সেমিনার আর নৈশভোজের পার্টিতে স্যুট-টাই পরে গণমাধ্যমে ছবি দেন, টিভির পর্দায় দাঁত বের করে হাসেন, নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা তখন তীব্র ঘৃণার সঙ্গে তাকান, বিদ্রুপের হাসি হাসেন। এরা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবেন কীভাবে, ব্রোকারেজ হাউসই বাঁচাতে পারছেন না। বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বাজার তিন মাসে স্থিতিশীল করার অঙ্গীকার ১০ বছরেও পূরণ করতে পারেননি। তবু তাকেই রাখতে হবে?
সমাজটা নষ্ট হতে হতে শেষ তলানিতে গেছে। যারা গণতন্ত্র আর ভোট নিয়ে প্রশ্ন করেন, তারাও এসব অপরাধ নিয়ে কথা বলেন না। কারণ অপরাধীরা অতীতে ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের সঙ্গে ছিল, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে তাদের সঙ্গে আরও বেপরোয়া রূপ নিয়ে আসবে। শেয়ারবাজারকে লুণ্ঠন করে কবরস্থান বানিয়ে রেখেছে, সেই লুটেরাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দিতে হবে। কাপুরুষের মতো ঘুমিয়ে থাকা জনগণকে সব স্তরে যে যেখানে আছেন, আশপাশে বিচরণকারী দুর্নীতিবাজ অপরাধীদের সমীহ নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে গণজাগরণ ঘটাতে হবে।
লেখক:নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সূত্র:বাংলাদেশ প্রতিদিন
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ