সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির জাতীয় খানা জরিপে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের মাত্র ষোলোটি সেবা খাতে শুধু ২০১৫ সালেই মোট ঘুষের লেনদেন হয়েছে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগণ এ আর্থিক দুর্নীতির শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। জরিপ অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলের ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। বিপরীতে শহরাঞ্চলের চিত্রও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। শহরের ৬২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষকেও সেবা নিতে কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। পরিসংখ্যান ছাড়াও স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণেই বোঝা যায়, গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশই সেবা খাতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৃহত্ অংশের কাছে পুরোপুরি অসহায়। হারানো গবাদিপশু খুঁজে পাওয়া থেকে শুরু করে জমি রেজিস্ট্রি, বিধবা ভাতা থেকে শুরু মুক্তিযোদ্ধা ভাতা উত্তোলন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই ঘুষ দেয়াটা তাদের কাছে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিআইবির জরিপ আরো বলছে, দেশের ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কাজ আদায় করে নেয়ার জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হন। আবার সেবাপ্রাপ্তির পদ্ধতি ও নিয়ম সম্পর্কে জানা না থাকায় ঘুষ দেন আরো ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ। ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ ঘুষ দেন হয়রানি এড়াতে। অথচ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার এ দেশে এখনো ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে; যেখানে মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশই দরিদ্র আর নিম্ন দারিদ্র্যরেখায় বসবাসকারীর সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, সে দেশে এক বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন মোটেও কম নয়।

জাতীয় খানা জরিপের মাধ্যমে সেবা খাতে দুর্নীতি কিংবা ঘুষ লেনদেনের তথ্য একক সংস্থা হিসেবে শুধু টিআইবিই গত ২০ বছরে সাতটি জরিপের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাতে আসলে ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজদের কতটুকু আটকানো যাচ্ছে! দুর্নীতির শিকার মানুষের ভাগ্য কতটুকু বদলাচ্ছে! হয়তো জরিপের প্রতিবেদনের পর ‘লোক দেখানো’ কিছু পদক্ষেপের জন্য হলেও দুর্নীতির ধারণা সূচকে দেশের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে, র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ এখন আর প্রথম হয় না; কিন্তু এ প্রথম না হওয়া কিংবা ধারণা সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি কি প্রমাণ করে এ দেশে দুর্নীতি হ্রাস পাচ্ছে? নাকি এর আড়ালে দুর্নীতিবাজরা আরো কূটকৌশলী হয়ে দুর্নীতি গোপন করার পদ্ধতি খুঁজে নিয়েছে বলেই অনেক তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে না!

প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছেন অনেক আগেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ দমনের মতো ‘জিরো টলারেন্সে’র ঘোষণাও শোনা গেছে বেশ কয়েকবার। তাতে লাভের লাভ হয়নি কিছুই। বরং ‘গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি দেয়া’র মতো দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদকের ক্ষমতা হ্রাস করে সেটিকে নখদন্তহীন বাঘে পরিণত করা হয়েছে বহু আগেই। অন্যদিকে দুদকও সব সময়ই যত গর্জায় তত বর্ষে না। তা না হলে তো দাতা অর্থায়নে টিআইবিকে দুর্নীতি নিয়ে গবেষণা করতে হয় না। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বরং দুদকই এ ধরনের গবেষণা কিংবা জরিপ করে তা প্রকাশের মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করার পাশাপাশি সরকারকে সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণে বাধ্য করতে পারে।

পাশাপাশি বেশ কিছুদিন আগে যখন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত দ্রুত কাজ আদায় করে নেয়ার জন্য অর্থের লেনদেনকে ‘স্পিড মানি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রকারান্তরে ঘুষকে বৈধতা দিয়ে দেন তখন দুর্নীতির সংজ্ঞাই আসলে পাল্টে যায়! ‘ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার’— দুর্নীতির বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাই এতে অসার হয়ে যায়। অথচ এ সংজ্ঞা অনুযায়ী শুধু ঘুষ নেয়া বা ঘুষ দিতে বাধ্য করাই দুর্নীতি নয়। বরং অর্থসম্পদ আত্মসাত্, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানিকেও দুর্নীতির সংজ্ঞার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। সেটা বিবেচনায় নিলে ভুক্তভোগী আমজনতা মাত্রই জানেন যে সেবা খাতগুলোয় ঘুষ দেয়া ছাড়াও প্রতিনিয়তই দায়িত্বে অবহেলা, হয়রানি আর স্বজনপ্রীতির মতো দুর্নীতির শিকার হতে হয় কম-বেশি সবাইকেই। অথচ অর্থমন্ত্রীর এ এক বক্তব্যেই এর সবকিছুই কেমন যেন বৈধতা পেয়ে যায়। যার প্রমাণও মেলে টিআইবির জরিপে। দেখা যায়, জরিপে অংশ নেয়া মোট উত্তরদাতার ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশই হয়রানি বা জটিলতা এড়াতে কিংবা নির্ধারিত সময়ে বা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সময়ে সেবা পেতে ঘুষ প্রদান করেছে। যাতে ঘুষগ্রহীতারা লাভবান হলেও আখেরে ক্ষতির শিকার হয়েছেন কিন্তু ছাপোষা সাধারণ জনগণই। অথচ এ জনগণের সেবার জন্যই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ করার কথা! আবার ভাইস ভার্সা হিসেবে জনগণও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করবে সবটুকু দিয়ে। কিন্তু অবস্থা যখন এই, তখন আসলে সাধারণ জনগণ যদি দেশের সেবায় আগ্রহী না হয়, তাহলে কিন্তু তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না!

ক্ষমতাবানরা এসব বোঝেন না বিষয়টা এমন নয়। বরং তারা বুঝেও অবুঝ। আর ক্ষমতাবানদের কাছে অসহায় জনগণও নিশ্চুপ। তাই তো আইয়ুব বাচ্চুর ‘এই শহর এখন ঘুমিয়ে গেছে, এখানে কোথাও কেউ জেগে নেই’ গানের মতোই দেশটাও যেন ঘুমিয়ে আছে। শুধু মাঝে মাঝে কিছু মানুষ জেগে উঠে সতর্কতা বার্তা দিয়ে জানিয়ে দেন যে, এখনো সময় ফুরায়নি। জাতি হিসেবে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে, মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে হলে বুক চিতিয়ে লড়তে হবে দুর্নীতি নামক এ সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে। যেভাবে ‘চলছে চলুক না’—এ মনোভাব ছেড়ে রুখে দাঁড়াতে হবে দুর্নীতিবাজ আর অর্থলোভী হায়েনাদের বিরুদ্ধে। একসঙ্গে জেগে উঠলে ‘নিয়মে পরিণত হওয়া অনিয়মে’র বেড়াজাল ছিন্ন করা অসম্ভব কিছু নয়।

জাফর সাদিক, লেখক,সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী
সুত্র ঃ বনিকবার্তা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে