ভোলা প্রতিনিধি/(ফয়সল বিন ইসলাম নয়ন)ঃ ভোলার লালমোহনের মৃৎশিল্প এখন ক্রমশই মৃতপ্রায়। যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের লোকজ শিল্পের মূল্যবান ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যেত এমন কমদামী সাধারণ উপকরণ দিয়ে তৈরী হত এসকল মৃতশিল্পে।
গ্রামের মেঠোপথ ধরে গায়ের বধূরা দলবেঁধে কলসি কাঁখে পানি আনতে যেত নদীতে। সেই মাটির কলস, পিঠার সাজ, আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না বললেই চলে। কালমা গ্রামের মৃৎশিল্পি রামদাস জানান, মাটির তৈরী জিনিসের কুমাররা সাধারণত হাড়ি, ঘট, কলসি, বাসন-কোসন ইত্যাদি তৈরী করে। তারপর এগুলোর উপর রঙের প্রলেপ দেয়া হয়। পরে আগুনে পুড়িয়ে সেই মাটি পাকা করা হয়, এক সময় এসব জিনিসের চাহিদা ছিল প্রচুর। আগের দিনে কোনো আধুনিক বিলাসি প্রযুক্তি যেমন-ফ্যান, এসি, ফ্রিজ ইত্যাদি ছিল না তখন মাটির কলসিতে পানি রাখত গ্রামবাসীরা। গ্রীষ্মকালও সেই পানি দীর্ঘ সময় খুব ঠান্ডা থাকত। তাই সেই সময় কলসের চাহিদা খুব বেড়ে যেত। কিন্তু ইদানিং মেলামাইন, সিরামিক,এ্যালুমিনিয়ামের আধিক্যের কারনে ও সরকারি পৃষ্টপোষকতার অভাবে হাজার বছরের এ পেশা ছেড়ে যাচ্ছে লালমোহনের অনেক কামার-কুমার।
কুমারদের ঘামে ভেজা, মনের মাধুরী আর নিপুন হাতের ছোঁয়ায় যে সকল সামগ্রী তৈরী হয় তা হলো হাঁড়ি, পাতিল, সানকি, মটকা, হুক্কা, দইয়ের চারা, সরা, টব, কলসি, ঢাকনি ইত্যাদি। চরটিটিয়া গ্রামের কুমার গোপাল কৃষ্ণ জানান, স্বাধীনতার আগে লালমোহনে কয়েক হাজার লোক কুমার পেশার জড়িত ছিল। বর্তমানে সেই সংখ্যা নিতান্তই কম। প্রতি বছর কুমার পাড়ায় আগে শীতের মৌসুমে মাটির তৈজষপত্র তৈরিতে ধুম পড়ে যেত। তখনকার কুমার শিল্পীরা ছিলেন দক্ষ ও নান্দনিক। তারা এঁটেল মাটি দিয়ে নানান সরঞ্জাম তৈরি করতেন। উপজেলার হিন্দুদের প্রতিমা তৈরির বিখ্যাত কারিগর রতেন বলেন, আগে পূজাঁর মৌসুমে ইচ্ছামতো কাজ করা যেত। ভালো সম্মানিও পাওয়া যেত। কিন্তু সেরকম পরিবেশ এখন আর নেই। তাই আমরা পালরা খুবই অসুবিধায় আছি।
মৃৎশিল্পের এসব শিল্পিরা আজ নানান সমস্যায় জর্জরিত। এদের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে মৌসুম নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা। মৌসুম নির্ভরতার কারণে ৬ মাসের বেশি সময় এদের হাতে কাজ থাকেনা।এসকল মৃৎশিল্পিদের নিজস্ব কোনো পুজিঁ নেই। ব্যবসা মন্দা হওয়ার কারণে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। চরলক্ষ্মী গ্রামের মৃৎশিল্পি সন্ধ্যা রাণী পাল বলেন, এ শিল্পের উপকরণ যেমন-মাটি, জ্বালানী, রং ইত্যাদির দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আগে শুধু রং ছাড়া অন্যান্য উপকরণ সামান্য দামে পাওয়া যেত। ফলে পূর্বে মাটির পাতিল ৮/১০ টাকায় বিক্রি করলেও এখন ৩০/৩৫ টাকায় বেঁচলেও লোকসান হয়। ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ এর কারিগরদের পুরনো গতানুগোতিক উৎপাদন ব্যবস্থা।
তাছাড়া বাজারে অল্প মূল্যে প্লাস্টিক, এলুমিনিয়ামের তৈজষপত্রের সহজলভ্যতা। ফলে ব্যবসায় তারা লোকসান দিচ্ছেন। সচেতন মহলের ধারণা মৃৎশিল্পিদের যদি প্রযোজনীয় প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা এবং মাটির তৈরি জিনিস পরিবেশ বান্ধব এই পেশাদারীদের প্রচার করা হয় তাহলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ কুটির শিল্প টিকে থাকবে। পাশাপাশি পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোতে মৃৎশিল্পের সামগ্রী রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অজর্ন করা যাবে।
ফয়সল বিন ইসলাম নয়ন
ভোলা ।। বিডি টাইম্স নিউজ