ইফতেখার হোসাইন: এ বদ্বীপে তথা নদীমাতৃক বাংলাদেশে বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ঐতিহাসিক এবং এর সঙ্গে এদেশের মানুষের জীবন সংগ্রামের যোগসূত্র রয়েছে। এদেশের আকাশে পুঞ্জিভূত মেঘমালা থেকে ভারী বর্ষণে কিংবা নদীর দুকূল উপচে লোকালয় প্লাবিত করা, যার পরিণতিতে বন্যায় এখানে মানুষের বাঁচা-মরার লড়াইও সীমাহীন। ভয়াল বন্যার সেসব তাÐব রুখে দিতে বিপন্ন মানুষ নিজেরা নিজেদের প্রতিরোধ করেছে, আবার তাতে এদেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে এমন ইতিহাসও স্মরণীয়। এবার স্মরণকালের ভয়াবহতম ও নজিরবিহীন বন্যার কবলে দেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী ১২ জেলা। তন্মধ্যে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অ লে বন্যায় প্রাণহানী ও জনদুর্ভোগের সীমা ছাড়িয়েছে। অথচ বাংলাদেশে গত ত্রিশ দশকে এ জেলাগুলোতে বন্যার দরুণ এত প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির রেকর্ড নাই। সাধারণত বর্ষা মৌসুমের প্রারম্ভে কিংবা মাঝভাগে সিলেট ও উত্তরবঙ্গে বছরে একাধিকবার বন্যা হয়ে থাকে। কিš‘ এবার ব্যতিক্রমভাবে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের ১২ জেলার ওপর দিয়ে বইছে বন্যা। বয়ে যাওয়া প্রাণঘাতী বন্যার প্রকোপে এ পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়, পানিবন্দী আছে লাখো মানুষ। আর বানভাসি সেসব মানুষের উদ্ধারকার্যে নিবেদিত প্রাণ বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে, তা যেন আমাদের অজানা না থাকে সে কৃতজ্ঞতা থেকে এ লেখার প্রয়াস। যেকোনো দুর্যোগে দেশের অপ্রতিরোধ্য শিক্ষার্থীরা যে মানুষের পাশে দাঁড়ায় এবং এমনটি এ দেশের অন্যতম সৌন্দর্য, এবারকার বন্যায় তা আরো ব্যতিক্রমী হয়ে দৃশ্যায়িত হলো দেশবাসীর নিকট।কর্মস্থল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরাই এ অনন্য নজির স্থাপন করেছে, যা সর্বমহলে প্রশংসা কুঁড়ায়। ছাত্ররা জাতির দুর্যোগকালীন সময়ে যেভাবে উদ্ধারকর্তা হয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে, ঠিক তেমনই বন্যাদুর্গতদের সেবা দিতে নিজেদের সর্বো”চ দিয়েছে এরা। প্রথম ধাপে নোয়াখালী জেলা প্লাবিত হওয়ার পর থেকেই অর্থাৎ বন্যার শুরুতেই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা নিজেরা সংগঠিত হয়। পরে ২১ আগস্ট সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগের শতশত শিক্ষার্থী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ ২৩টি ক্লাব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নোয়াখালীর বানভাসি মানুষদের উদ্ধারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত অডিটোরিয়াম ভবন বন্যা কবলিতদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে থাকার উপযোগী করে প্রস্তুত করে।
এরপর দ্বিতীয় ধাপে নিজ উদ্যোগে স্থানীয় কলা গাছ কেটে বানানো হয় অসংখ্য ভেলা। সেসব ভেলাকে সঙ্গী করে এবার শিক্ষার্থীরা চলে যায় সমিতির বাজার, আলু ওয়ালার দোকান ও ভুবানিপুর এলাকায়। উদ্ধার করে বানভাসিদের নিয়ে আসে পূর্ব থেকে প্রস্তুতকৃত আশ্রয়কেন্দ্রে। শুধু তাই নয়, আশ্রয় প্রত্যাশীদের ভিড় সামলাতে বিকেলের দিকে ক্যাম্পাসের বড় প্রবেশমুখ খুলে দেয়া হয়। এরপর দেখা মেলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের। বানভাসি মানুষের পাশাপশি শতশত গরু-মহিষ প্রবেশ করতে দেখা যায় ক্যাম্পাসে। পরে আশ্রয় প্রার্থী দুর্গত মানুষরা চলে যায় অডিটোরিয়াম ভবনে। পূর্বেই সেখানে তাদের জন্য আলাদা আলাদা পুরুষ ও মহিলা শয্যার ব্যবস্থা করা হয়। শৌচাগারগুলোতে পরি”ছন্ন ও আনুষঙ্গিক হাইজিন মেইনটেইন করে রাখা হয়। আর গবাদি পশুর জন্য বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠ উপযোগী করে দেয়া হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে উদ্ধারকার্যের যে ছবিটি সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে তা হলো- ২৪ আগস্ট রাতে নোবিপ্রবি এক ছাত্রীর কোলে নবজাতকের মায়াভরা মুখের ছবি। সে ছবি অন্য সবার মতো আমারও নজর এড়ায়নি। ওই ছবি নিয়ে বলতে ই”েছ করে- ‘হায় নবজাতক শিশু। এ পৃথিবী কতোটা বাসযোগ্য তা তোমার অজানা। তুমি জানো না বন্যা, বুঝো না পানির ন্যায্য হিস্যা।তুমি কেবলই খুঁজে ফেরো মায়ের উষ্ণতা। হায় মা! মা যে আজ বানভাসি, মা যে আজ নিজেই ঠিকানাবিহীন। কী নির্মম! মা-শিশুর আজ যে বাঁচা-মরার লড়াই সীমাহীন। প্রিয় উদ্ধারকর্মী শিক্ষার্থীরা তাই তোমাদের কাছে আমাদের আজন্ম ঋণ’। ২৪ আগস্ট আরেকজন আশ্রিত গর্ভবতী মাকে জরুরি ভিত্তিতে নেয়া হয় হাসপাতালে, সেখানে তিনি একটি ফুটফুটে সন্তানের জন্ম দেন। এখানে উল্লেখ্য ছাত্রীরা গর্ভবতী নারীদের আশ্রয় দিতে নিজেদের হলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রাখে । এছাড়া সকল আশ্রীতদের চিকিৎসা সেবা দিতে নোবিপ্রবি কেন্দ্রীয় মেডিকেল সেন্টার, আবদুল মালেক উকিল মেডিকেলের টিম এবং নোবিপ্রবি ফার্মেসি বিভাগের উদ্যোগে ঢাকা থেকে আগত টিম একযোগে কাজ করে। যার ফলে গর্ভবতী মা, শিশু, বয়স্কসহ আশ্রয়কেন্দ্রের সকলের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হয়। তাদের দেয়া হয় প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী। নোবিপ্রবি পরিবারের এমন উদ্যোগ যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও ইতিমধ্যে সারাদেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ¯’াপন করেছে।
ভৌগলিক দিক থেকেই বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায় এবং এর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বঙ্গোপসাগর ও অসংখ্য ছোট-বড় নদ নদী। তাই বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ ও তৎপরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতাও বেশি। দেশের ভূতাত্তি¡ক গঠন ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে ২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার ২০২৪ এ স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখতে পেলো দেশবাসি। এর কারণ হিসেবে বলা হ”েছ টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে ধেয়ে আসা পানির ¯্রােত। বন্যায় নোয়াখালীর পাশর্^বর্তী জেলা ফেনীর তিন উপজেলা পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে আছে, সেখানে কতো সংখ্যক মানুষ জীবিত কিংবা কতোজন মৃত তা আজো অজানা। ভয়াবহ এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্র¯’ হয়েছেন ৪৮ লাখের বেশি মানুষ। বন্যার তোড়ে বসতবাড়ি, গ্রামীণ সড়ক, ফসলি মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাছের খামার, গাছপালা ও গবাদি পশু ভেসে গিয়েছে। সর্বগ্রাসী বন্যার এমন রুপ নাড়া দেয় দেশের ছাত্র সমাজকে। সারাদেশেই শিক্ষার্থীরা সরাসরি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক-টিকটকে বন্যার্তদের পাশে দাাঁড়ানোর ও ফান্ড সংগ্রহের আহŸান জানায়। এমন নির্দেশনা পেয়ে তৃতীয় ধাপে নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা তাদের কার্যক্রম নিজ ক্যাম্পাস ছাড়াও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ছড়িয়ে দিতে জরুরি তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। শিক্ষার্থীদের আহŸানে এবার নোবিপ্রবি পরিবারের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও হৃদ্যতার বন্ধনে এক হয়ে বানভাসি বিপন্ন মানুষদের সহযোগীতায় মানবতার হাত বাড়ায়। এছাড়াও নোবিপ্রবি এলামনাই ও স্বউদ্যোগী নানা পেশার মানবিক মানুষ এ তহবিল বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সকলের এরুপ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বড় তহবিল গঠন সম্ভব হয়। এতে করে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে প্রায় ২৫০ আশ্রিতের প্রতি বেলা খাবারের ব্যব¯’া করা হয়। আকস্মিক বন্যার কারণে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন এক কাপড়ে। সে সেক্ষেত্রে তাঁদের সাধারণ পরিধানের কাপড়ের পাশাপাশি গরম কাপড়েরও ব্যবস্থা করা হয়। তহবিলের অর্থে নৌকা, ট্রাক, পিক আপ ও বাসের ব্যব¯’া করা হয়। এবার বিভিন্ন টিমে ভাগ হয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই নোয়াখালী শহর, কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, কবিরহাটসহ সেনবাগ উপজেলায় উদ্ধারকার্যে নেমে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও ফেনী, ল²ীপুর ও কুমিল্লা জেলার প্রত্যন্ত অ লের বানভাসিদের নিকট ছুটে যায় তারা, সেসব অ লে আজ সপ্তাহ ধরে আটকে আছে মানুষ। এর মধ্যে ফেনী জেলার মোবাইল নেটওয়ার্ক পুরোপুরি বন্ধ আছে এবং সেখানে প্রত্যেক মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বি”িছন্ন। বাংলাদেশের ইতিহাসে বন্যায় এমন ব্যাপকতার নজির নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। যাইহোক, উদ্ধারকর্মীরা আটকে থাকা পানিবন্দী সেসব মানুষ, নোবিপ্রবি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার এবং স্থানীয় বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায়। বন্যা কবলিতদের শুকনা খাবার, মেডিকেল সেবা ও ত্রাণ সামগ্রীও পৌঁছে দেয় তারা।
স্বাভাবিক ভাবেই সর্বগ্রাসী বন্যায় শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার এমন উদাহরণ ইতিহাসে যেন অবিস্মরণীয় থাকে এবং তা ভবিষ্যতের প্রজন্মের পথচলার পাথেয় হয়ে যেনো অন্যদের অণুপ্রাণিত করে- এমনটি আমাদের প্রত্যাশা। এর পাশাপাশি যে বিষয় আমাদের আশান্বিত করে তা হলো- সরকার, সেনাবাহিনীসহ পেশাজীবী, সাধারণ জনতা, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণকাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তবে এ মুহূর্তে চতুর্থ ধাপে শিক্ষার্থীদের পাশপাশি সব মহলের বন্যা পরবর্তী প্রয়োজনীয় করণীয় বাস্তবায়নেও সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি। সাধারণত বৃষ্টি কমে গেলে এবং পানি নামতে শুরু করলে বন্যা শাসিত এলাকায় পানিবাহিত রোগসহ স্বা¯’্যঝুকি দেখা দেয়। তাই ভুলে গেলে চলবে না বন্যা শেষে দুর্গতদের খাবার, পানীয়, স্বা¯’্য সেবা ও পুনর্বাসনের প্রয়োজন হবে। এসময় বন্যায় ঘরবাড়ি, খাদ্য শস্য, ফলফলাদি স্বজন হারানো মানুষ তখনও আরো অনিশ্চিত জীবনে পদার্পন করবে, ভুক্তভোগী ছাড়া এমন দুঃসহ কষ্ট অনুধাবন সাধারণের অসাধ্য। তখন এসব নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ালে তাদের মানসিক বল বৃদ্ধি পাবে, তাদের নিত্যকার দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব হবে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বললে- ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’। তাই আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন যেমন বন্যা চলমান অব¯’ায় অসহায় ভেঙে পড়া দুর্গতদের পাশে দÐায়মান, তেমনি তারা দুহাত প্রসারিত করবে বন্যা পরবর্তী জটিলতা নিরসনেও।
লেখক: সহকারী পরিচালক (তথ্য ও জনসংযোগ), নোবিপ্রবি।