রাজধানীতে অস্ত্র ঠেকিয়ে এক ব্যবসায়ীর কর্মচারীর কাছ থেকে সাড়ে ৩৩ লাখ টাকা ছিনতাই করেছে চকবাজার থানা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। এই ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগের তিন সদস্যকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অভিযান এখনো অব্যাহত আছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। গত বুধবার(১’লা নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে রাজধানীর চকবাজারের মোগলটুলির ৯২ নম্বর বশির ম্যানসনের সামনের সড়কে এই ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী ওই যুবকের নাম আনিসুল ইসলাম। তিনি হাজী সেলিম টাওয়ারের সুবাহান স্টোরের কর্মচারী। ওই দিন দোকানের মালিক সোবাহান ওই কর্মচারীর কাছে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ইসলামী ব্যাংক মৌলভীবাজার শাখায় জমা দিতে পাঠিয়েছিলেন। এই ঘটনায় দোকান মালিক আব্দুস সুবাহান বাদী হয়ে চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। এবিষয়ে তিনি বলেন, আমি চায়না থেকে ইমিটেশনের মালামাল আমদানি করি। এই কাজের জন্য আমাকে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে চেক নিয়ে সেটি সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে দিতে হয়। সে অনুয়ায়ী গত বুধবার আমি আমার দোকানের কর্মচারীকে দিয়ে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাংকে পাঠায়। কিন্তু প্রায় দুঘন্টা হয়ে গেলেও কর্মচারীর কোনো হদিস পাচ্ছিলাম না। ফোন দিলেও ধরছে না। এতে টেনশন বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে দুপুর ১টার দিকে আমার কর্মচারী আনিস রক্তাক্ত অবস্থায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে অফিসে আসে। তখন সে জানায় তাকে কয়েকজন যুবক জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে টাকার ব্যাগ ছিনতাই করেছে। এসময় ব্যাগ না দেওয়ায় তার মাথায় পিস্তল (অস্ত্র) ঠেকায় কয়েকজন। এসময় তাকে খুন করার হুমকি দেয় এবং সাথে থাকা কয়েকজন একটি নির্মানাধীণ ভবনে নিয়ে ব্যাপক মারধর করে। এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে টাকার ব্যাগ ছেড়ে দেয় আনিস। পরে তাকে চোখ বেঁধে অন্য জায়গায় ফেলে রেখে তারা পালিয়ে যায়। এঘটনায় ভুক্তভোগী আনিসুল ইসলাম বলেন, আমি দোকান থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ পেছন থেকে ৪-৫ জন লোক আমাকে টেনে ধরে কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই কিলঘুষি মারতে থাকে। এসময় আমি ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার দিলে আশপাশের মানুষ ছুটে আসলে তারা নিজেদেরকে চকবাজারের ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে জানায়- এই ছেলে (আনিস) জামায়াত-বিএনপির লোক। তাকে থানায় নিতেছি। এসময় তারা সবাই জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে আমাকে রিক্সায় তোলে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষেরা আমাকে রক্ষায় আর এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি। তারা ছাত্রলীগ করে এই ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি।
আনিস বলেন, এরপর তারা আমাকে একটা অটো রিকশায় করে চোখ বেঁধে একটা নির্মানাধীণ ভবনে নিয়ে যায়। সেখানে নির্মাণাধীণ সরঞ্জাম দিয়ে আমাকে এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকে কয়েকজন। আমি তবুও ব্যাগ ছাড়ছি না। এক পর্যায়ে তাদের একজন আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং আমার কানে আঘাত করে। এতে আমি অনেক জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে তারা আমার বুকের উপরে ঝাপটে ধরে রাখা টাকার ব্যাগ কেড়ে নেয়। এরপর তারা আমাকে চোখ বাধা অবস্থায় ওই ভবন থেকে বের করে অজ্ঞাত একটি স্থানে রেখে চোখ খুলে দিয়ে বলে সোজা বাসায় যাবি। আর তোকে যদি কোনোদিন চকবাজার এলাকায় দেখি জানে মেরে ফেলবো। এরপর আমি কোনো মনে সেখান থেকে দৌড়ে অফিসে আসি। ভুক্তভোগী আনিসের কাছ থেকে এমন ঘটনা শুনার পর দোকান মালিক সোবাহান হাজী সেলিম মার্কেট মালিক সমিতির সহায়তায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করে। পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। আর ওই সিসিটিভি ফুটেজে যাদেরকে দেখা যায় তারা প্রকৃতপক্ষে চকবাজার থানা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়। এরপর গুরুত্বের সঙ্গে এই ঘটনায় টাকা উদ্ধারে অভিযানে নামে পুলিশের একাধিক টিম।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়- অভিযান শুরুর পর প্রযুক্তির সহায়তায় তারা দেখতে পান অভিযুক্তরা টাকার ব্যাগ নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে ট্রেন যোগে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় চট্টগ্রামের পুলিশ এবং রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় টাকা ছিনতাইকারী দুজনকে আটক করা হয়। এসময় চকবাজার থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য বিমান যোগে ওই আসামিরা চট্টগ্রামে পৌঁছার আগেই সেখানে পৌঁছে যায় এবং আটক মিরাজ ও সায়েম নামের ওই দুই ছাত্রলীগ নেতাকে নিয়ে অভিযান শুরু করে। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা নগদ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর তাদেরকে ঢাকায় এনে আবারও অভিযান শুরু করে পুলিশ। অভিযানে আরেক নেতা শুভ ধরা পড়ে। পুলিশ জানায় এই ঘটনায় ৭-১০ জনের একটি চক্র কাজ করেছে। বাকিদের গ্রেফতারে এখনো অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জানা গেছে- টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় আটকৃত মিরাজ চকবাজার থানা ছাত্রলীগের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সায়েম সদস্য এবং শুভ সহ-সভাপতি হিসেবে বর্তমানে কমিটিতে রয়েছে।
চকবাজার থানা পুলিশের একটি সূত্র বলছে- ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক উপ-প্রচার সম্পাদক হাফিজুল ইসলাম জিসান, চকবাজার থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রুবেল হোসেন জয়, সোলায়মান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক রাব্বিও এই ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য পাচ্ছেন তারা। তবে এসব তথ্য নিয়ে তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এই বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে যদি কেউ অপরাধ করে সে দায় আমরা নিবো না। অপরাধীর পরিচয় যাই হোক তাকে শাস্তি পেতেই হবে। আমরা এই ঘটনায় তদন্ত করে যদি তাদের জড়িত থাকার প্রমান পাই তাহলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিবো। এবিষয়ে লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. জাফর হোসেন বলেন, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে অভিযান চালিয়ে প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পালিয়ে যাওয়া মিরাজ ও সায়েম নামের দুজনকে আটক করা হয়। তাদের তাদের দেওয়া তথ্যে শুভ নামের অপর একজনকে আটক করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি টাকা এবং অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। তবে ছিনতাইকারীরা ছাত্রলীগ কিনা তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। তিনি বলেন, অপরাধীর অন্য কোনো পরিচয় আমাদের কাছে মুখ্য নয়। আমাদের কাছে অপরাধীর একমাত্র পরিচয় সে অপরাধী। সে হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।