ভারতে চলমান জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেননি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। তাঁর এই অনুপস্থিতি নানা কল্পনা-জল্পনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সি মূলত এই সম্মেলনের সময় আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির স্পটলাইট নিজের ওপর রাখতেই এ কৌশল নিয়েছেন।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন-এর নিবন্ধে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পরিকল্পনা থেকেই জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেননি চীনের প্রেসিডেন্ট। সি ২০২২ সালের নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় চীন ধীরে ধীরে কোভিড-১৯ মহামারি থেকে সেরে উঠছিল। কোভিডের পর সেটিই ছিল তাঁর বড় কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার ঘটনা। সেই সম্মেলনে সি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বের ১১টি দেশের নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। পাশাপাশি জি-২০ ভুক্ত অনেক দেশের নেতাকে চীন সফরের আমন্ত্রণও জানান। তাঁর সেই আমন্ত্রণের পর জার্মানির চ্যান্সেলর থেকে শুরু করে ফ্রান্স, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশের নেতাই বেইজিং সফর করেছেন। কেবল তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনও চীন সফর করেছেন। বালি সফরের পর চীনে বিদেশি নেতাদের সফরের লাইন লেগে গেলেও সি মাত্র দুবার বিদেশ সফর করেছেন। প্রথমে তিনি মস্কো সফরে যান এবং পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। তাঁর এ দুটি সফরই ছিল মূলত বিশ্ব ব্যবস্থাকে নতুন আকার দেওয়ার প্রচেষ্টা। চলতি বছরের মার্চে সি মস্কো সফরে যান তাঁর ‘পুরোনো বন্ধু’ ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁরা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী। গত আগস্টে সি যোগ দেন ব্রিকস সম্মেলনে। বিশ্বের উদীয়মান পাঁচ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট এটি। সেই সম্মেলনে একপ্রকার চীনের চাপাচাপিতেই নতুন ৬টি দেশকে সদস্য করা হয়। নতুন সদস্য হওয়া দেশগুলো অনেকটাই চীন ঘেঁষা হিসেবে নয়তো পশ্চিম বিরোধী বলে পরিচিত।
সি চিনপিং নতুন ৬ দেশকে ব্রিকসে নেওয়ার পর জোটের সম্প্রসারণকে স্বাগত জানান। এটি নিঃসন্দেহে বেইজিংয়ের জন্য বিরাট একটি অর্জন। চীন দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছিল অর্থনৈতিক জোটটিকে পশ্চিমা বিরোধী একটি ভূরাজনৈতিক জোটে পরিণত করতে। তবে চীন বারবার দাবি করেছে, তারা কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে না। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির চায়না সেন্টারের সহযোগী এবং অর্থনীতিবিদ জর্জ ম্যাগনাস বলেন, পরিবর্ধিত ব্রিকস একটি বিকল্প বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার উদাহরণ। এই বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাটি বেইজিং স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে তৈরি করতে চেয়েছে। ম্যাগনাসের মতে, গ্লোবাল সাউথের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশই এই শাসনব্যবস্থার অংশ এবং চীন এখানে কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সি তাঁর নিজস্ব বিশ্ব ব্যবস্থার রূপকল্প হাজির করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই রূপকল্পে তিনটি প্রধান উদ্যোগ রয়েছে। প্রথমত, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ—যেখানে নতুন ধরনের নিরাপত্তা পরিকাঠামোর কথা বলা হয়, যা বিদ্যমান নিরাপত্তা পরিকাঠামোর থেকে আলাদা; দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ—যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে এবং তৃতীয়ত, বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগ—যেখানে নতুন ধরনের রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ হাজির করা হবে এবং এই মূল্যবোধ বিদ্যমান সর্বজনীন মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। ম্যাগনাসের মতে, মোটা দাগে এসব উদ্যোগ অনেক বড় এবং সারবত্তার দিক থেকে অনেকটাই অস্পষ্ট। ম্যাগনাসের মতে, তবে বেইজিং এসব উদ্যোগের মাধ্যমে এমন একটি বলয়ের নকশা করেছে যেখানে দেশগুলো চীন নির্ধারিত ন্যারেটিভকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হচ্ছে এবং তা অবশ্যই জি-২০ জোটের পৃষ্ঠপোষকতায় টিকে থাকা শাসনব্যবস্থার বিপরীত।
অনুমান করা হচ্ছে, আগামী অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট দেশটির বৈশ্বিক অবকাঠামো এবং বাণিজ্যিক উন্নয়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামের আয়োজন করতে পারেন। এই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চীনের বৈশ্বিক নতুন শাসনব্যবস্থা তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। ম্যাগনাস বলছেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ব্রিকস এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার মতো বহুজাতিক সংগঠন বা উদ্যোগগুলোতে চীন হয় প্রতিষ্ঠাতা নয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং এগুলো চীনের মর্যাদাকে উন্নীত করেছে। জর্জ ম্যাগনাস বলছেন, ‘এই এনটিটিগুলো একটি বিকল্প বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার কাঠামো হিসেবে বিরাজ করছে যেখানে চীন ঐতিহাসিকভাবে কেন্দ্রে অবস্থান করেছে এবং এর মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার লাইমলাইট অনেকটাই নিজের দিকে টেনে নিয়েছে।’
অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান