ভারতে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে দুই দিনের সফরে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। ঢাকা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ল্যাভরভ। পারস্পরিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ল্যাভরভের সফরে আলোচনা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। ল্যাভরভের ঢাকা সফর নিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে মস্কোর প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে এটিকে(সফর) একটি পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই হতে যাচ্ছে প্রথম বাংলাদেশ সফর। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মিত্র ছিল তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন। নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমাদের নানা তৎপরতার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা চলছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সফরে এসে সন্ধ্যায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ল্যাভরভ। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াদিল্লি যাবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে শুক্রবার নয়দিল্লি যাবেন। ওইদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে শেখ হাসিনার। ল্যাভরভের সফরে রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাণিজ্য ও জ্বালানিসহ দ্বিপাক্ষিক সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে বলে রয়টার্সকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। তিনি বলেছেন, তার সফরে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো (ল্যাভরভের সফরে) আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মতামত বিনিময়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে,’ বলেছেন জাখারোভা। সের্গেই ল্যাভরভ ঢাকায় আসছেন ইন্দোনেশিয়া থেকে। জাকার্তাতে ১৮তম ইস্ট এশিয়া সম্মেলনে যোগদান শেষে তিনি রওনা হবেন। তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ
সের্গেই ভিক্টোরোভিচ লাভরভকে রাশিয়ার একজন বিচক্ষণ কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদের হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। পুতিন জমানার শুরুতেই ২০০৪ সাল থেকে অর্থাৎ ১৯ বছর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে আসছেন। জারদের আমলের পর রাশিয়ার সব থেকে দীর্ঘ সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ল্যাভরভ। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আসার আগে জাতিসংঘে কাজ করেছেন ল্যাভরভ। সেখানে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৯৪ সাল থেকে ছিলেন ১০ বছর। গত ২০ বছরে রাশিয়ার সরকার ও মন্ত্রীসভার প্রায় সব পদেই রদবদল হলেও ল্যাভরভকে কখনোই তার পদ থেকে সরানো হয়নি। রাশিয়ান পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ল্যাভরভকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘তিনি একজন শক্ত, নির্ভরযোগ্য, অত্যন্ত পরিশীলিত আলোচক। ল্যাভরভকে ‘পুতিনের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাবলয়ের অংশ’ হিসেবে অনেকেই দেখেন না। তবে ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানের পেছনে ল্যাভরভকে ‘সহিংস বিদেশনীতির প্রতীক’ হিসাবে মনে করেন কেউ কেউ। রুশ, ইংরেজি ও ফরাসিসহ অন্তত পাঁচটি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন সের্গেই ল্যাভরভ। একইসঙ্গে তিনি প্রখর ক্রীড়াবিদ। টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখতে খুবই পছন্দ করেন।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ পেশাদার কূটনীতিক হিসাবে খ্যাতি পাওয়া ল্যাভরভ রাশিয়ান স্বার্থের একজন কঠোর রক্ষক। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া বারবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার শুরু করে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই নীতি থেকে সরে গিয়েছিল রাশিয়া। ল্যাভরভ শুধু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো নীতিই ফিরিয়ে এনেছেন তাই নয়, তিনি আগ্রাসী কূটনীতির মাধ্যমে রাশিয়াকে আবার বিশ্বমঞ্চে উপস্থিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল, সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়া, ইরানকে সঙ্গী করে মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ করা, উত্তর কোরিয়ায় পরমাণু কর্মসূচি, আফ্রিকায় রাশিয়ার উপস্থিতি এবং সবশেষ চলমান ইউক্রেন যুদ্ধেও সের্গেই ল্যাভরভ তার আগ্রাসী কূটনীতির পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।

ল্যাভরভের রোল মডেলদের মধ্যে একজন হলেন উনিশ শতকের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও চ্যান্সেলর আলেকজান্ডার গোরচাকভ। ‘যুদ্ধে পরাজয়ের পর অস্ত্র দিয়ে নয়, কূটনীতির মাধ্যমে ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব পুনরুদ্ধার করা’ – গোরচাকভের এই উদ্ধৃতি ল্যাভরভের মুখেও শোনা গেছে বেশ কয়েকবার। আর স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর রাশিয়াকে নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পুতিনের নীতিগুলোর বাস্তবায়ন ঘটিয়ে চলেছেন ল্যাভরভ। যার পেছনে একমাত্র উদ্দেশ্য, মস্কোকে আবার একটি বিশ্বশক্তির কেন্দ্রে নিয়ে আসা। ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইওআরএ কাউন্সিলের ২২তম বৈঠকে যোগ দিতে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল ল্যাভরভের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সফরটি বাতিল হয়। পরে মোমেন ও ল্যাভরভ টেলিফোনে কথা বলেন এবং বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন। এই সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ল্যাভরভ। টেলিফোনে আলাপে সের্গেই ল্যাভরভ সে সময় ঢাকায় আসতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ এবং শিগগিরই সফরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।

ল্যাভরভের বাংলাদেশ সফর কেন গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকেই। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বছরে প্রায় সোয়াশো কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের অর্থায়ন হিসাব করলে এই অঙ্ক আরও বেশি হবে। প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন করছে রাশিয়া। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক, আলুসহ বেশকিছু পণ্য। আর বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সার, গম, সামরিক সরঞ্জামসহ বিভিন্ন আমদানি করে। রূপপুর চালু হলে রাশিয়া থেকে আসবে পারমাণবিক জ্বালানি। সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মুদ্রা কী হবে তা নিয়ে উঠেছে আলোচনা। তবে ডলারের বাইরে অন্য কোনো মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক লেনদেন হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত না।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের চাপের মধ্যে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। আবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেরার একদিন পরই বাংলাদেশ সফরে আসছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর নানামুখী চাপ এবং বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ল্যাভরভের সফর কতটা প্রভাব ফেলবে সেদিকেই তাকিয়ে সবাই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে