মুহম্মদ আশরাফুল, নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুরের অধিকাংশ এলাকা ও দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশ নিয়ে ছিলো এ সেক্টর। সদর দফতর ছিল কল্যাণীতে। প্রথম কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও পরে মেজর এমএ মঞ্জুর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে(বর্তমান বাংলাদেশ) ১১’টি সেক্টরে বিভক্ত করে। এটি ছিলো যুদ্ধ পরিচালনার একটি সামরিক কৌশল। নিয়মিত সৈন্য ৩৩১১’জন, ৮০০০’জন গণবাহিনীর যোদ্ধা, সর্ব মোট ১১,৩১১’জনকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল ৮নং সেক্টর। যার, সাব সেক্টর ছিল আরও ৭টি। ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর সাতটি।

মুহম্মদ আশরাফুল, নিজস্ব প্রতিবেদক।। সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুরের অধিকাংশ এলাকা ও দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশ নিয়ে ছিলো এ সেক্টর। সদর দফতর ছিল কল্যাণীতে। প্রথম কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও পরে মেজর এমএ মঞ্জুর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে(বর্তমান বাংলাদেশ) ১১’টি সেক্টরে বিভক্ত করে। এটি ছিলো যুদ্ধ পরিচালনার একটি সামরিক কৌশল। নিয়মিত সৈন্য ৩৩১১’জন, ৮০০০’জন গণবাহিনীর যোদ্ধা, সর্ব মোট ১১,৩১১’জনকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল ৮নং সেক্টর। যার, সাব সেক্টর ছিল আরও ৭টি। ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর সাতটি।

বিডি টাইম্‌স নিউজের সাক্ষাতকারে বলছিলেন ৮নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম আব্দুল ওয়াহাব, সাবেক ডিজি( প্রথম), জামুকা। তিনি বলেন, আমি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ গ্রহণ করেছি।এবং ৮ নং সেক্টরে আমি যুদ্ধ করেছি। একটি স্বাধীননতার সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করবো, দেশের কাজে অংশ গ্রহণ করবো এমন একটি চেতনা আমার মনের মধ্যে আগেই সৃস্টি হয়েছিল।

১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করি। ওই সময় গণআন্দোলন তুঙ্গে ছিল। তোফায়েল ভাই আমাদের নেতা ছিল। আমরা একদিন তোফায়েল ভাইকে প্রশ্ন করলাম,আমরা এই যে আন্দোলন করছি এটার ভবিষ্যৎ কি? তোফায়েল ভাই বললেন, প্রয়োজনে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দিবো। আমি আমার প্রেরণা পেতে শুরু করলাম।কারণ যদি স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার হয় তাহলে তো আমার অংশগ্রহণ করার সুযোগ আছে। আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী আছি সবাই মিলে বুদ্ধি করলাম আমরা ইন্ডিয়া যাবো। আমরা পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলাম।

আমরা জানি, ব্যারাকপুর ক্যাম্প হচ্ছে একটা ওয়েটিং ক্যাম্প। অর্থাৎ সামনে আমরা একটা বড় ট্রেনিং এর প্রস্তুতির জন্য। এই ক্যাম্পের দায়িত্ব হলো ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন আর এন মুখার্জী। ব্যারাকপুর ক্যাম্পটা ছিলো আম বাগানের ভিতরে।আম বাগানের চতুর্দিকে মাটির বেরিবাঁধ দিয়ে ঘেরাও করা। একদিন রাতে ডিউটি দেয়া হলো বেরিবাঁধে। ক্যাপ্টেন আর এন মূখার্জী সতর্ক করে দিয়ে বললেন, বেড়িবাঁধ ভেঙে যেতে পারে। তোমরা ওখানে থাকো এবং মাটি কেঁটে বেড়িবাঁধের রক্ষা করার চেস্টা করো। আমরা বেড়িবাঁধের দায়িত্ব নিলাম। মাটি কেঁটে আমরা বেড়িবাঁধে দিই। কিন্তু পানি বাড়ছেই, হঠাৎ বাঁধ ভেঙে গেলো। যেখানে পানি ছিলো হাঁটু পরিমাণ, সেখানে ক্যাম্পের ভিতরে বুক পরিমাণ পানি হয়ে গেলো। দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শোয়া ছিলো তাঁরা বের হতে পারেনি, মারা গেলো। রাত্রে তাঁদের লাশ কোলকাতা বা কোথাও নিয়ে গেলো। আমরা ক্যাপ্টেন আর এন মুখার্জী’র কাছে যুদ্ধের নিয়ম কানুন শিখি অর্থাৎ যুদ্ধের প্রস্তুতি আর কি। এরপর আমরা হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য রামপুর হাট বীরভূম চলে গেলাম।এখানে আমরা তাবুতে থাকতাম।সকালে পিটি প্যারেড, অন্যান্য ট্রেনিং চলে।যুদ্ধের জন্য যা যা লাগে সব ট্রেনিং ই দেয়া হতো। একটা ঘটনা এই মূহুর্তে খুব মনে পড়ছে। যশোর বাড়ি আফজাল নামে একজন আমার পেছনে পেছনে ঘুরতো গান লিখে নেয়ার জন্য। ওকে গান লিখে দিয়ে সূর শিখিয়ে দিলাম।ও তা গাইতো।একদিন ট্রাকে করে বস্তা ভরা মাটি আসতেছে আর আমরা ট্রাক থেকে মাটি নামাচ্ছি। তো আফজাল একটা খালি ট্রাকে দৌড়ে উঠার চেস্টা করলো কিন্তু উঠতে পারলো না, পড়ে যায়। ট্রাকটা পেছন দিকে আসতেই আফজালের উপর দিয়ে ট্রাকের চাকা উঠে যায়। ওই মুহূর্তে আফজাল বাঁকা হয়ে গেলো।কোলকাতা থেকে হেলিকপ্টার এসে ওকে নিয়ে গেলো।পরে জানতে পেরেছি ও মারা গেছে। এখনো চোখের সামনে ভাসে কিভাবে ও চাকার নিচে পড়ে বাঁকা হয়ে গেলো। একপর্যায়ে আমাদের ট্রেনিং শেষ হলো।আমরা দেশে প্রবেশ করবো। এই জন্য ৩০/০৯/৭১ এ আমরা আসলাম কল্যানী ক্যাম্পে।এটাকে বলা হয় রেস্ট ক্যাম্প। একটা কথা আসতে পারে বাবা- মা’র কথা মনে পড়তো কি না? হ্যাঁ পড়তো।কিন্তু আমরা যে ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম তাতে মনে পড়লেও ওই মনে পড়াটা এমনি উড়ে গেছে। একদিনের এক ঘটনা আবুল বাশার নামে এক ছেলে মা মা করে হঠাৎ কেঁদে উঠলো।ওই কান্নায় আমরা কেঁদে উঠলাম। এমন কেও নাই যে সেদিন কান্না করেনি।বহু দূর থেকে লোক এসে আমাদের শান্তনা দিয়েছে।

মেজর জেনারেল মঞ্জুর ছিলেন আমাদের সেক্টর কমান্ডার। ১২/১০/৭১ আমাদের ডাক পড়লো যে তোমরা অস্ত্র নাও। আমরা ৫০০ জন এক সাথে অস্ত্র নিয়ে বয়রাবর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম।রাত ১ টা/২টা যশোরে সি এম ভি রোড়। একটা গ্রুপ রোড় পার হয়ে আসছে।আর কিছু গ্রুপ পেছনে ছিলো।দেখলাম সেনাবাহিনীর প্রচুর গাড়ি যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে কেও একজন ট্রাকের গাঁয়ে ফায়ার ওপেন করে দিয়েছে। তারাও পাল্টা ফায়ার করছে আমরাও করছি, এভাবে কিছুক্ষন চলার পর ফায়ার থেমে গেলো। আমি খেয়াল করলাম আমার ডান পা ভেঁজা ভেঁজা লাগছে। একটা গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে নিলাম।আমার সহকর্মী দের বললাম, তোরা ধর আমাকে আমি হাঁটতে পারছি না। দুজন ধরে আমাকে এগিয়ে নিচ্ছিলো, তখন ভোর হবে হবে অবস্থা। এক পর্যায়ে দেখলাম আমার পায়ে রক্ত। আমি এখানে আহত হলাম। আমাকে একটা হিন্দু বাড়ি তে নিয়ে যাওয়া হলো। একজন বুড়ো লোক বেরিয়ে আসলো।সে বলতে লাগলো রনজিৎ…রনজিৎ তাঁড়াতাঁড়ি আয়, রনজিৎ আসলো। হাতে একটা ব্যাগ।মনে করলাম উনি একজন ডাক্তার। কাচারি ঘরে আমাকে শুইয়ে দিয়ে পায়ে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেস করলো। বুড়ো লোকটি আমাকে বললো, এখানে থাকতে পারবেন না। রাজাকারের ঘাঁটি কাছাকাছি। আমি’সহ কয়েকজন এক বুড়ীর বাড়িতে অবস্থান করি। দুপুরে বুড়ী আমাদেরকে শিং মাছ আর ডাল দিয়ে ভাত খেতে দিলো। আমাদের সংগে ছিলো সামাদও কেঁদে দিলো।যে এতোদিন পর দেশের ভাত খাচ্ছে শিং মাছ দিয়ে বুড়ীর হাতে। রাত্রে আমরা রওনা করলাম। দিনে পালিয়ে থাকতে হয়। আর রাতে হাঁটা শুরু করি। আসতে আসতে আমরা মধুমতি নদীর দিকে আসলাম। ওখানে আমাদেরকে চারটা হেলিকপ্টার ঘেরাও করলো। যে কোনো সময় তারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারে। আমাদের সাথে এল এম জি ছিলো। একজন বললো, ফায়ার করি। আমি বললাম, যুদ্ধের নিয়ম তো এটা না। কমান্ডার হুকুম দিবে, যাই হোক, নদীতে পানি কম থাকায় আমরা পার হয়ে একটা গ্রামের কাচারি ঘরে বসলাম। তখন বেলা ১১ টার মতো বাজে। হেলিকপ্টার কিন্তু আমাদের চতুর্দিক ঘুরছে।আমাদের কেও কেও বলছে, আমরা হেলিকপ্টার ফেলে দিই।আমি বললাম, না এখানে ফাইট করা ঠিক হবে৷ না।আমরা নিরাপদে থাকি।যুদ্ধের নিয়ম ই হলো আগে তুমি সেফ থাকো পরে শত্রুকে মারো।

অবশেষে আমরা ১৫’তারিখে বাড়ি আসি। উঠানে এসে আমি তিনবার মা মা ডাক দিলাম। কিন্তু আমার মনে হলো আমার ডাকটা মা শোনে নাই। ক্লান্তির কারণে ওতোটা শব্দ করে ডাকতে পারছিলাম না।উঠানে ধান মাড়াই করছিলো একজন।তিনি জোরে ডাক দিলে মা এসে জড়িয়ে ধরে কান্না কাটি শুরু করলো।এলাকার লোকজন চলে আসলো।আমাদেরকে তখন গরুর দুধ দিয়ে গোসল করানো হলো। এরপর আমরা আগে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধারা আসছে তাঁদের নিয়ে ভদ্রাসনে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প করলাম। এই ক্যাম্পে এলাকার লোকজন আসে। আমরা তাঁদের ট্রেনিং করাই। এভাবে আমাদের দল ভারি করলাম। ২৫/১১ তারিখে খবর আসলো যে, ৩০/১১ তারিখ শিবচর থানা অপারেশনে যেতে হবে।আমরা অস্ত্র নিয়ে শিবচর থানায় গেলাম। থানার পেছনে গুয়াতলা নামে একটা জায়গা আছে।সেখানে আমরস পজিশন নিলাম। সকাল থেকে ফাইট করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।তখন পাকিস্তানি বাহিনীরা সারেন্ডার করলো। থানা আমরা দখল নিলাম। আমাদের কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ আশে পাশে পড়েছিলো।এখানে আমাদের চারজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে।তাঁরা হলেন,শিবচরের সালাম,কালকিনি’র মোশাররফ,দেলোয়ার (কালকিনি’র পাশের গ্রাম),১১ বছর বয়সের এসকেন্দার নামে এক ছেলে। এরপর ৯ ডিসেম্বর মাদারীপুর জেলা শহরে আক্রমণ করতে হলো।এখানে আমাদের মন্ত্রী শাহজাহান খান,মোসলেম খান( চার থানার কমান্ডার ছিলেন),শাহজাহান মোল্লা,রেজাউল তালুকদার, সরোয়ার মোল্লা তাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১০ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীদেরকে সারেন্ডার করাতে পারি। ওরা আশ্রয় নিয়েছিলো হাওলাদার জুট মিলে।সমাদ্দার ব্রীজে কাছাকাছি এসে ওদের আটক করি।মেজর খট্টাক ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলো।উনচল্লিশ জন সহ রাজাকার আলবদরদের ধরে বিভিন্ন স্কুলে নিয়ে রাখি। এরপর আমরা অপেক্ষায় আছি ঢাকায় কবে আসবো।আমার একটা দুই ব্যান্ডের রেড়িও ছিলো।রেড়িও তে ঢাকার খোঁজ খবর জানি।তো একদিন রেড়িওর মাধ্যমে জানতে পারলাম ঢাকায় সারেন্ডার হচ্ছে। তাই আমাদের আর ঢাকায় এসে যুদ্ধে অংশগ্রহন করতেহলো না। ২’রা ফেব্রুয়ারী আমরা ঢাকায় স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছি। মনে একটা বিশাল আনন্দ। এই আনন্দে একটা গান লিখি-

“ও আমার সোনার বাংলাদেশ
তোমারই ধূলা মাটি
সবুজ শ্যামল ঘাসের বুকে
আমি যে নিত্য বেড়াই
গান গেঁয়ে যাই হাঁসি খেলি
ও আমার সোনার বাংলাদেশ।

যে আনন্দটা আশা করছিলাম যে একটা পতাকা নিয়ে আসবো সেই পতাকা নিয়ে আসলাম। দেশ স্বাধীন করলাম। সব শেষে কথা হলো-যেটা আমি সব সময় বলি, ইয়াহিয়া- ভুট্টোর দোষে ধ্বংস হইলো পাকিস্তান, আমরা গাই সকলে বাংলাদেশের গান। এটা চির সত্য কথা।নিজের বুকের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলাম। মৃত্যু আমাদের হয়েই যাবে এটাই ছিলো স্বাভাবিক। আমরা দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি এটা গৌরবের,এটা বড়ই অহংকারের,এটা বড়ই আনন্দের।এই আনন্দ আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের যারা আছে, আজকে যারা তরুণ, যারা সামনে আসবে এই বাংলাদেশের নাগরিক, যে বাংলা ভাষা বাংলার স্বাধীনতা ভাষার উপর কেন্দ্র করে সেই ভাষা টিকে থাক।বাংলাদেশ টিকে থাক।এবং এই বাংলাদেশে যাঁরা বাংলা ভাষাভাষী আছেন তাঁরা বাংলাকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার জন্য। বাংলাকে শক্তিশালী করার জন্য দায়িত্ব নতুন যাঁরা আছে তাঁদের হাতে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে