অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের মুখোমুখি অবস্থান দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে শঙ্কা এখন সবচেয়ে বেশি। তৈরি পোশাক রপ্তানির বৃহৎ গন্তব্যের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি ছাড়া যুক্তরাজ্য ও কানাডা আছে।

যুক্তরাষ্ট্র কোনো সিদ্ধান্ত নিলে পশ্চিমারাও অনেকটাই সেই পথ অনুসরণ করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কী ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে তা নিয়েই ব্যবসায়ী মহলে আলোচনা হচ্ছে। উদ্বেগ, শঙ্কা আর অস্বস্তিতে দিন কাটছে ব্যবসায়ীদের। গত সোমবার রাতে ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি সংবিধানের বাধ্যবাধকতার বাইরে যেতে পারবেন না। দেশি-বিদেশি নানা চাপ, ষড়যন্ত্রের মধ্যে তিনি চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। নির্বাচন দেশে যথা সময়ে হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। ফলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তিনি পিছপা হবেন না। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর ব্যবসায়ী মহলেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যদিও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম মঙ্গলবার বিকালে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অতি সম্প্রতি এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসার কোন যুক্তিই নেই। তিনি কয়েকটি দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে থাকলেও অনেক দেশের সঙ্গে ব্যবসা তারা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। একটা ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের মাধ্যমেই ব্যবসায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়। কয়েকদিন আগে ইবিএ (এভরিথিং বাট আর্মস) রিভিউ করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটা টিম এসেছিল বাংলাদেশে। তখন আলোচনা হল, দু’একটি মিডিয়ায়ও রিপোর্ট হয়ে গেল যে, তারা জিএসপি সুবিধা বাতিল করতে যাচ্ছে। অথচ তারা বাণিজ্য, শ্রম ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর আমার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। সেখানে তারা পরিষ্কার বলেছেন, মনিটরিং পিরিয়ড তিন বছর বাড়ানো হবে। সেটা ২০২৬ হতে পারে বা ২০২৯ পর্যন্ত হতে পারে। যদিও প্রধানমন্ত্রী এটা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর কথা বলেছেন। সেটা যাই হোক এখন আমাদের আলোচনা হচ্ছে জিএসপি প্লাস কীভাবে হতে পারে সেটা নিয়ে। জিএসপি আছে, এটা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে, এমন অনেক দেশের সঙ্গেও তাদের বাণিজ্য দিন দিন বেড়েই চলছে এমন উদাহরণও আছে। ফলে অর্থনৈতিক কোন নিষেধাজ্ঞা আসার কোন যুক্তি আমি দেখি না।

শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির কারণে বাংলাদেশে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কা নাকচ করেছেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। শ্রম পরিস্থিতির ধারাবাহিক উন্নতির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজে তারা সন্তুষ্ট।’ গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ী, শ্রমসচিব, বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন বাণিজ্যসচিব।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে সব দেশে শ্রম পরিস্থিতি আরও উন্নত হোক। এটা শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করে না। ইউএস-এর প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম বিষয়ে রপ্তানিকারকরা সচেতন আছেন। আমরাও অবশ্যই সচেতন আছি। আমাদের রপ্তানি বাজার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য যা যা করা দরকার আমরা সেটা করব। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা, রপ্তানি পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর চাহিদা বিবেচনায় রেখেই সামনে আগাতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক ও উৎপাদকদের সমিতি বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে আমরা মোটেও উদ্বিগ্ন নই। কারণ, আমরা মনে করি, আমাদের যে সংস্কারমূলক কাজগুলো চলছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিবিরুদ্ধ কিছু নেই। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের কাজ চলছে। সেই কাজগুলো যাতে চলমান থাকে সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি। তবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এই ধরনের আলোচনায় বেশ উদ্বিগ্ন। সোয়েটার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম শামসুদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখন পরিস্থিতির শিকার।

নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে সেটা তো রাজনৈতিক কারণে। আমাদের কোন দোষের কারণে তো এখানে নিষেধাজ্ঞা আসার সুযোগ নেই। কারণ ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর অ্যাকর্ড ও এলায়েন্সের মাধ্যমে আমাদের এখানে যে ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও নেই। যতগুলো দেশ গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করে তাদের মধ্যে একটি দেশও পাবেন না যারা আমাদের চেয়ে টেকসই। এখন লেবার ইস্যুতে যদি আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে এই অঞ্চলের একটি দেশেরও গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির সক্ষমতা থাকবে না। যদি আইনসঙ্গতভাবে বিচার করেন। আমরা আসলে রাজনৈতিক কারণে ভিকটিম হয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি দেখেন, ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন এই সেক্টরে। সেখানে ৭০ শতাংশ নারী। এর মধ্যে আবার ১০ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিকের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তারা মাসে ১৪ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। এখন এই সেক্টরটা ধ্বংস হয়ে গেছে এক হাজার মালিক হয়ত পথে বসবেন। কিন্তু এই যে ১০ লাখ নারী যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর তারা কী করবেন? সামাজিক অবক্ষয় আমাদের কোথায় যাবে? এটা কী আপনি বিলিয়ন ডলার দিয়ে রিকভারি করতে পারবেন?’

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতিকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ও প্লামি ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, ‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে আলোচনাটা হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য সুখকর কোনো সংবাদ না। যে ধরনের নিষেধাজ্ঞা হোক না কেন। সেটা যদি তারা ডিউটি বাড়িয়ে দেয় বা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করে তা তো আমাদের ব্যবসার জন্য খারাপই হবে। ফলে এই পরিস্থিতিতে আমরা আসলে এক ধরনের অস্বস্তি বা অস্থিরতার মধ্যে আছি। যদিও বায়ারদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে, তারা এটা নিয়ে যে উদ্বিগ্ন তেমন কিছু বলছেন না। তাদের কাছে কোন তথ্যও নেই। তারপরও আমাদের তো উদ্বেগ কমছে না। আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে মনে করি, আমরা যাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি তাদের তুলনায় আমাদের শ্রমিকদের স্ট্যান্ডার্ড যথেষ্ট ভালো। তারপরও তারা আমাদের যেসব জায়গায় উন্নতি করার কথা বলছেন সেটা আমরা করছি। গতকাল রাষ্ট্রপতি শ্রম বিলে স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠিয়েছেন। সেটাও তাদের কাছে একটা ভালো বার্তা যাওয়ার কথা। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা আসলে এই পরিস্থিতির উন্নতি চান। এটাকে অবহেলা না করে আলোচনাটা চালিয়ে যাওয়া দরকার।’

বাংলাদেশ বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ও ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, ‘শ্রম নীতিকে কেন্দ্র করে তাদের যদি গঠনমূলক কোনো পরামর্শ থাকে আমরা সেটাকে সাধুবাদ জানাবো। কিন্তু অভ্যন্তরীণ জাতীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে বিষয়টা হয়ে যাচ্ছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। সেই জায়গায় শঙ্কাটা বেশি। কেউ যদি কোনো দিক থেকে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যায় তার আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য নির্ভর বা সঠিক পথে না থেকে নেতিবাচক হয়ে যায়। আমাদের আশঙ্কা এই জায়গায়। আমি বলব, আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে যদি তাদের এত বেশি আগ্রহ থাকত, তাহলে এটা তো এ বছর তৈরি হয়নি। বেশ কয়েকবছর ধরেই এই পরিস্থিতি আছে। কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে তো তারা আগে থেকেই নিতে পারত। পাশাপাশি আমি আরেকটি বিষয়ে বলি, বায়াররা যেন আমাদের পণ্যের সঠিক মূল্য দেন সে বিষয়েও নজর দিতে হবে। আপনি শুধু আমাকে উন্নতি করতে বলবেন, কিন্তু পণ্যের সঠিক মূল্য দেবেন না সেটা হয় না।’

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সমীর কুমার দে। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে