একুশ বছরে শহিদ কে. মুখতার ইলাহীর স্মরণে: একজন নেতা, কবি ও দার্শনিক শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী (২৬ মার্চ, ১৯৪৯- ৯ নভেম্বর, ১৯৭১) ছিলেন একজন রাজনৈতিক নেতা, স্বভাব কবি, সুবক্তা, দার্শনিক ও বহুগুণের অধিকারী একজন মহাপুরুষ। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে অমর হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ যার প্রচেষ্টায় উত্তারাঞ্চলের আপামর জনসাধারণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষা ও গবেষণার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজ, রংপুর-এর ১৯৭০-৭১ সালের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি), রংপুর
জেলার মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা, তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটির ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের তিনি শিক্ষার্থী ছিলেন।

শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী-এর পিতার নাম খোন্দকার দাঁদ ইলাহী ও মাতার নাম মরিয়ম খানম। দাঁদ ইলাহীর ০৭ (সাত) জন পুত্র ও ০৩ (তিন) কন্যা ছিল। সাত ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ৪র্থ পুত্র। সাত ভাই যথাক্রমে বীর মুক্তিযোদ্ধা কে মঞ্জুর ইলাহী, কে মওদুদ ইলাহী, বীর মুক্তিযোদ্ধা কে মুশতাক ইলাহী, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী, কে মাহফুজ ইলাহী, কে মুরাদ ইলাহী এবং কে মারুফ ইলাহী। তাঁদের সন্তানেরাও সুনামের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও শিক্ষার মানোন্নয়নের কারণে রংপুর শহরে ইলাহী পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। পারিবারিকভাবে এ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আপন মহিমায় ভাস্বর ও সুনামের সাথে সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। রংপুর ভৌগলিক, কৌশলগত এবং রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত ছিলো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে যে ০৫ টি অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলেন, রংপুর ছিলো তার মধ্যে একটি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যে কয়েকজন নেতা ও ব্যক্তি নিজস্ব অঞ্চলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি
ছিলেন ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও ত্যাগী নেতা। মুখতার ইলাহী ছিলেন ৬ নং সেক্টরের মুজিব বাহিনী প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভেই তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্যান্টনমেন্টস্থ রংপুরের ধাপ সংলগ্ন হাজী পাড়ার যুবকদের সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ২৮ মার্চে রংপুরের বীর জনতা কর্তৃক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার প্রেক্ষিতে পাক বাহিনীর গুলিতে প্রায় ২০০ (দুইশত) জন নিহত হওয়ার ঘটনা এবং সম্মুখ যুদ্ধের গুরুত্ব উপলব্দি করে তিনি যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার পরিকল্পনা করেন। তাই তিনি ও তাঁর দলসহ প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে গমন করেন।

কুড়িগ্রামে উত্তরবঙ্গ জাদুঘর কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী ওরফে চিনুর সহযোদ্ধা, বন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মাহবুবুর রহমান শহিদ মুখতার ইলাহীর স্মৃতিচারণ ও তাঁর মায়ের সাথে দেখা করার মূহুর্তের অনুভূতি ব্যক্ত করেন যা তিনি ২০১৬ সালের মার্চের ১ তারিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শেয়ার করেছেন। তাঁর আবেগঘন স্মৃতিচারণ শুনে সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের রনাঙ্গণে তাঁর ভূমিকা নিয়ে মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী ছিলেন অকুতোভয় যোদ্ধা ও দার্শনিক। তাঁর কথা ও ভবিষ্যতবাণী আমাদের মত অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিলো অনুপ্রেরণাস্বরূপ ও
উৎসাহব্যঞ্জক। মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার সাথে মুখতারের একসময় দেখা হয় ভারতে। তখন সে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সম্পর্কিত লিফলেট বিলি করছিল। সেখানে তাঁর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় আমি বললাম যে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। যা কখনোই কাম্য নয়। আমাদের এ নিরীহ বাঙালীদের জন্য পরিকল্পিতভাবে কিছু করা দরকার। তখন মুখতার বলল যে, ‘তোমার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে দেখবে যে আমরা অচিরেই স্বাধীনতা লাভ করছি। কারণ একজন প্রকৃত যোদ্ধা কখনো সাধারণ ও নিরীহ নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করতে পারে না। আর যদি কখনো হত্যা করে তাহলে ধরে নিতে হবে যে তাদের মনোবল ভেঙ্গে গেছে এবং পরাজয়ের ভয়ে ক্ষণিকের জন্য ত্রাসের রাজত্ব
কায়েম করছে’। মুখতারের কথা শুনে আমি মুগ্ধ হলাম এবং তাঁর মায়ের কাছে কোন অভিপ্রায় আছে কি না জানতে চাইলাম। তখন সে বললো যে, ‘আমার মাকে এ লিফলেট টা দিবে এবং বলবে আমি ভালো আছি’।
পরবর্তীতে আমি বাংলাদেশে আসি এবং রংপুরে এসে শত্রু পক্ষকে প্রতিহত করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করলাম। আমার দৃষ্টিতে শহীদ মুখতার ইলাহীর মা মরিয়ম খানম ছিলেন এক অগ্নিগর্ভা মা। এ অগ্নিগর্ভা মায়ের তিন সন্তান মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা কে. মঞ্জুর ইলাহী, মুক্তিযোদ্ধা কে. ড. মুশতাক ইলাহী ও শহীদ কে. মুখতার ইলাহী।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষে রংপুরের বাবুখাঁয় অবস্থিত বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে হামলার পর আমি কয়েকটি পরিবারের খবর নেই। প্রথমেই আমি খবর নেই আমার বাবা-মায়ের। তারপর খবর নেই মুখতারের বাবা-মায়ের। আমি ক্যান্টনমেন্টের ২০০ (দুইশত) গজ দুরে জঙ্গলে আচ্ছাদিত বাড়িতে শেয়ালের মত ঢুকে পড়লাম। মুখতার ইলাহীর বাসার দরজায় অতি সন্তর্পণে টোকা দিলাম। অতি সতর্কতার কারণ হলো এই যে, ১০০ (একশত) গজের মধ্যে পাক সেনারা পাহারা দিচ্ছে। আমাদের চির-পরিচিত মুখতারের মা দরজা খুলে দিলেন এবং ভিতরে ঢুকতেই তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, এ ক্রান্তিলগ্নে মূহুর্ত সময় নষ্ট করার মত সুযোগ আমাদের নেই। মাকে বললাম, চিন্তা করবেন না। মুখতার ভাই ভালো আছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাকে উত্তর
দিলেন। চিন্তা কিসের বাবা! “আমিতো ওকে স্বাধীনতার জন্যে কোরবান দিয়েছি”। একটু থেমে তাঁর মা বললেন। জানো বাবা! যাওয়ার সময় সে আমার হাত দ্#ু৩৯;টো ধরে বলে গেছে মা, আমি তোমাকে বড় ভালোবাসি মা। কিন্তু মা আমি দেশমাতৃকাকেও যে বড় ভালোবাসি। তুমি দোয়া করবে মা, আমি দেশ স্বাধীন করে যেন তোমার কাছে ফিরে আসি। তাইতো ওকে আমি স্বাধীনতার জন্য কোরবান দিয়েছি। তাঁর মায়ের এ উত্তর শুনে আমার হৃদয়টা নাঁড়া দিয়ে উঠলো এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বেড়ে গেলো। পরবর্তীতে আমি বাংলাদেশের খোঁজ-খবর নেয়া ও অন্যান্য অর্পিত দায়িত্ব পালন শেষে ভারতে যাই এবং সেখানে আবার এক পর্যায়ে তাঁর
সাথে দেখা হয়।

সাহেবগঞ্জে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষে খোন্দকার মুখতার ইলাহী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মুখতার সে সময় আমার রংপুরের বাসায় ১ সপ্তাহ ধরে অবস্থান করেছিলো। তারপর আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পকিল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকি। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে আমরা আলাদা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়ন করি। রংপুরের বর্তমানে টাউন হলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতো যা ঐ সময় রংপুর শহরের মডার্ন হল হিসেবে খ্যাত ছিলো। মুখতার ইলাহী ঐ নির্যাতন কেন্দ্রে
হামলার পরিকল্পনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে তিনি ১৯৭১ সালের ০৮ নভেম্বর রংপুরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে যাত্রা বিরতি করতে হয়। লালমনিরহাটে মুখতারের অবস্থানের টের পেয়ে পাক বাহিনীর প্রায় ৪০০ (চারশত) জন আর্মি তাঁকে ও অন্যান্যদেরসহ গ্রামটিকে ঘেরাও করে ফেলে। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি অসীম বীরত্বের সাথে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তাঁর সাথে এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকেও আটক করা হয়। তাঁকে আটক করার পর জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, তুমি কি মুক্তিযোদ্ধা? তখন মুখতার বলেছিলো যে, হ্যাঁ আমি মুক্তিযোদ্ধা এবং জয় বাংলা বলে স্লোগান দিয়েছিলো। তাঁর উত্তর শুনে পাক বাহিনী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি কোন ভয় নেই? তখন মুখতার বলেছিলো, না। মৃত্যুর মুখে থেকেও সে জয় বাংলা স্লোগান ও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে ভুলেননি। পরবর্তীতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী খোন্দকার মুখতার ইলাহীসহ অন্যান্য আটককারী বাঙালীদের ১৯৭১ সালের ০৯ নভেম্বর লালমনিরহাটের বড়বাড়ি ইউনিয়নের আইরখামারে হত্যা করে। তাঁকে হত্যার করার পূর্বে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে তথ্য নেয়ার জন্য অনেক অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, এক পর্যায়ে আমি মুক্তিযোদ্ধা বশিরের লেখা মারফৎ জানতে পারি যে, মুখতার ইলাহী শহীদ হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। এ ঘটনা থেকে আমার উপলব্দি হলো যে, আল্লাহ্ধসঢ়; তাঁর মায়ের ঐ দোয়া কবুল করেছে এবং মুখতার দেশের জন্যে শহীদ হয়েছে। তাঁকে হারানোর ক্ষতি কখনো পূরণ হবার নয় বলে আমি বিশ্বস করি। মুখতার ইলাহী বলতেন, স্বাধীনতার জন্য অনেক ত্যাগ এবং রক্ত দিতে হয়। তাইতো তিনি নিজের জীবন দিয়ে জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তিনি এবং তাঁর পরিবার সত্যিকার দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মুখতার ইলাহীরা কখনও মরে না। খোন্দকার মুখতার ইলাহীর হত্যাকান্ডের পর ১ (এক) মাসের মধ্যে শহীদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর মুজিব বাহিনী ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রংপুর পাক বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মুক্ত অঞ্চল হিসেবে রংপুরও বাংলাদেশের মানচিত্রে স্থান দখল করে নেয়। কুড়িগ্রামে উত্তরবঙ্গ জাদুঘর কর্তৃক আয়োজিত স্মারক বক্তব্যে শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর বড় ভাই প্রফেসর ড. মুক্তিযোদ্ধা কে মুশতাক ইলাহী বলেন, শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী সময়ের তুলনায় চিন্তা ও মানসিকতায় অনেক দূরদর্শী ছিল। তিনি মুখতার ইলাহীর লেখা কিছু কবিতা যথাক্রমে ‘১৪ই আগষ্ট একটা পতাকার নাম’ আবৃতি করার পাশাপাশি স্মৃতিচারণের মাধ্যমে শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর জীবনবৃন্তান্ত তুলে ধরেন এবং স্মারক বক্তৃতা সম্পন্ন করেন। আইরখামার গণহত্যা দিবসে যে সকল নিরীহ বাঙালী হত্যা করা হয়েছে, শহিদ খোন্দকার মুখতার
ইলাহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। গত ০৯ নভেম্বর আইরখামার গণহত্যা দিবস ও এ ঘৃণ্যতম ঘটনার ৫০ বছর। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ০৯ নভেম্বর শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীসহ ১১৯ (একশত উনিশ) জন নিরস্ত্র বাঙালীকে হত্যা করা হয়। আইর খামার গণহত্যার স্থানটি লালমনিরহার জেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের আইরখামার গ্রামে অবস্থিত। এখানে বর্তমানে আইরখামার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যা ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানেই শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর সমাধি ও স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। বাংলাদেশে লালমনিরহার জেলার বড়বাড়ি ইউনিয়নের আইরখামার গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের যে বিশেষত্ব রয়েছে তা অন্য কোন
ইউনিয়নে নেই। কারণ এখানে উপর্যুক্ত গণহত্যা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কারণে আলাদা গুরুত্ব ও ইতিহাস রয়েছে।

দীর্ঘদিন অবহেলার পরে হলেও শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শের জন্য ২০২১ সালে লালমনিরহাট একটি সমাধি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ স্থানকে ঘিরে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। আইরখামার গণহত্যার শিকার যে ৯৫ (পচান্নব্বই) জনের নাম পাওয়া গেছে। সে সকল শহিদের নাম সম্পর্কিত একটি নামফলক স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য আহŸান জানিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এর উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ হাসিবুর রশীদ। এ বছর তিনি আইরখামার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরবর্তীতে উত্তরবঙ্গ যাদুঘর, কুড়িগ্রাম কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায়
তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উপস্থাপন ও শহীদদের আত্নার মাগফেরাত কামনা করেন এবং নামফলকটি স্থাপনের আহবান জানান। এ নামফলক সম্পর্কিত স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের কাজ সুন্দরভাবে সম্পাদনের জন্যে শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী-এর পরিবার, উত্তরবঙ্গ জাদুঘর,কুড়িগ্রাম থেকে স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতা নিতে পারে। পাশাপাশি দশনার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বসার স্থান, একশত উনিশ জনের সমাধি স্থান পরিবেষ্টন এবং এ স্কুলের উন্নতির জন্য অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। ফলত, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের
মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হবে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার ব্যাপারে তারা আরোও আগ্রহী হবে। শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শের জন্য রংপুর শহরে তাঁর নামে সড়ক, চত্বর, ছাত্র বিশ্রামাগার ও হলের নামকরণ করা রয়েছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, রংপুর এ ‘শহীদ মুখতার ইলাহী হল’ নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও তাঁর নামে রংপুর শহরের প্রধান সড়কের নাম ‘ শহীদ মুখতার এলাহী সরণী’ নামকরণ করা হয়েছে যা রাজা
রামমোহন মার্কেট/পায়রা চত্বর থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃত। সম্প্রতি এ সরণী পরিদর্শনে দেখা গিয়েছে যে, অধিকাংশ দোকান ও প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডের নাম ‘শহীদ মুখতার এলাহী সরণী’ এর পরিবর্তে শহীদ মুখতার এলাহী সরণী (স্টেশন রোড), স্টেশন রোর্ডে ইত্যাদি নামে লেখা আছে যা অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। তাঁর নামে যে সরণী রয়েছে তার যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ন্যুনতম সম্মান প্রদর্শন ও স্মৃতি রক্ষা করা সময়ের দাবী ও আমাদের দায়িত্ব। সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রয়াত শরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু-এর উদ্যোগে
মেডিকেল মোড়ের নামকরণ করা হয় ‘শহিদ মুখতার ইলাহী চত্বর’।

অন্যদিকে কারমাইকেল কলেজ, রংপুর-এর ছাত্র বিশ্রামাগারটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর স্মৃতির প্রতির সম্মান প্রদর্শন ও তা রক্ষা করার জন্যে তাঁর নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো নামকরণ করা প্রয়োজন। এ বছর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, ৫০ বছরের ইতিহাসে শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী এর স্মৃতিতে এ প্রথম বারের মত কোন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর পরিবার তাঁর স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। উল্লেখ্য যে, এ বছর আইরখামার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও শহীদদের মাগফেরাত কামনায় উপস্থিত ছিলেন শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, স্থানীয় জনসাধারণ, বেরোবি, রংপুর-এর ছাত্র উপদেষ্টা মোঃ নুরুজ্জামান খান, বেরোবি, রংপুর-এর বহিরাঙ্গন কার্যক্রমের পরিচালক সাব্বীর আহমেদ চৌধুরী,বেরোবি, রংপুর-এর বঙ্গবঙ্গু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মশিউর রহমান, শহিদ মুখতার ইলাহী হল, বেরোবি, রংপুর-এর সহকারী প্রাক্ষধ্য মোঃ আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ, এবং জনসংযোগ,তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মোঃ আলী। শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহীর স্মৃতিসহ উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করছে উত্তরবঙ্গ জাদুঘর যা কুড়িগ্রামে অবস্থিত। পাবলিক প্রসিকিউটর এস এম আব্রাহাম লিংকন ২০১২ সালে এ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নিজস্ব প্রচেষ্টায় বসবাসের স্থান হয়ে উঠেছে এক প্রাণবন্ত জাদুঘর যা বাংলাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ জাদুঘরের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের আরো বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কারণ এ জাদুঘরের মধ্যে যে মূল্যবান সংগ্রহ রয়েছে তা আমাদের দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি জানতে সহায়তা করবে। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের জন্যে ইতোমধ্যে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত একটি ৪তলা ইমারত নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে যার জমি দান করেছেন এসএম আব্রাহাম লিংকন নিজেই। শহিদ খোন্দকার মুখতার ইলাহী যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি ও অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি রংপুরসহ দেশকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারতেন। তাঁর অসামান্য লেখনি ও আত্ত্বজবনী বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে তিনি একজন মহান নেতা, দেশপ্রেমিক, কবি ও দার্শনিক ছিলেন। এটা চিরন্তন সত্য যে গুণিজনকে সম্মান প্রদর্শন করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে গুণিজনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি। এতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্‌স নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে