কে এম শাহীন রেজা, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি।। প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার দূর্গম চরাঞ্চল রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়ন। এই দুই ইউনিয়নে অর্ধলক্ষ মানুষের বসবাস। ভারত সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলো পদ্মা নদীর কারণে মুল ভু-খন্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। বর্ষাকালে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে নৌকা যোগে যাতায়াত সুবিধা হলেও শুকনো মৌসুমে বাড়ে বিড়াম্বনা। গ্রীস্ম মৌসূমে চারিদিকে ধু-ধু বালুচর। আর সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে গ্রামগুলো পরিনত হয় ভুতুড়ে জনপদে। চারিদিক যেন অন্ধকার চাদরে ঢাকা। আলোর ব্যবস্থা না থাকায় স্থানীয় বাজারগুলোও প্রায় জনশুন্য হয়ে যায়। দিনে সূর্যের আলো থাকলেও রাতের অন্ধকার দুর করতে বিদ্যুতের আলো তাদের কাছে স্বপ্নের মত। দীর্ঘদিন পরে হলেও গত ৩ জানুয়ারি কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য এ্যাড. আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন এ অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের। আলোকিত হয় দূর্গম চরের মানুষ। কিন্ত চরাঞ্চলের মানুষের কাংখিত স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে প্রভাবশালী স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট। তাদের মাধ্যমে কাজ না করলে মিলবে না সংযোগ।
জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর দুই ইউনিয়নের সাড়ে ৮ হাজার পরিবার বিদ্যুতের আওতায় আসবে। পর্যায়ক্রমে দুই ইউনিয়নে বসবাসরত সব মানুষ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হবে। ৩ জানুয়ারি রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হওয়ার পরে, গ্রাহকরা নিজের মত নিজে ওয়ারিং এর মালামাল ক্রয় করে পল্লী বিদ্যুতের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে কাজ শুরু করে । যেখানে গ্রাহক নিজে মালামাল ক্রয় করে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগানো পর্যন্ত সর্বোচচ ২৫ শত টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু তাতে বাধসাধে স্থানীয় এই প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। গ্রাহকদেরকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংযোগ লাগাতে ৩৫ শত টাকার মালামাল ক্রয় করতে হচ্ছে। ফলে প্রতি গ্রাহকে এই সিন্ডিকেট চক্রটি অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে ১ হাজার টাকা। ৮ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে এই সিন্ডিকেট প্রায় কোটি বাণিজ্যের পশরা সাজিয়ে বসেছে। ক্ষমতা আর প্রভাবের কাছে চরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ দীর্ঘ নি:শ্বাসে পরিনত হয়েছে।
এ বিষয়ে এলাকাবাসী জানান, গত ৩ তারিখে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এমপি ঘোষণা দেন গ্রাহক যে যার মত মালামাল ক্রয় করে যত কম টাকায় পারে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগিয়ে নিবে। তাই এমপির কথা মত আমরা মালামাল ক্রয় করে পল্লী বিদ্যুতের লাইসেন্সকৃত টেকনিশিয়ান এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ করতে গেলে সিরাজ চেয়ারম্যানের ক্যাডার বাহিনী, জানু মন্ডলের ছেলে মনিরুল ( মনি), জিয়াউল এর ছেলে টেক্কা দফাদার, লুৎফরের ছেলে রকিবুল সহ আর ৫ থেকে ৭ জন। ৮/০১/২১ তারিখে বেলা অনুমানিক ১২ টার পরে ইনসাফ নগর গ্রামের মৃত কছিম উদ্দিন মন্ডলের ছেলে আমির মন্ডলের বাড়িতে ওয়ারিং এর কাজ করার সময় তারা এসে বাধা প্রদান করে। তারা দাবি করে এই এলাকায় কাজ করতে হলে আমাদের মাধ্যম দিয়ে করাতে হবে এবং তাদের মাধ্যম দিয়ে না করলে কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে না। পরে টেকনিশিয়ান কথা বলতে চাইলে চেয়ারম্যানের ক্যাডার বাহিনী টেকনিশিয়ান কে মারধর করে তাড়িয়ে দেয়।
এ বিষয়ে পল্লী বিদ্যুতের লাইসেন্সকৃত ইলেকট্রিক টেকনিশিয়ান রকিবুল ইসলাম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি পল্লী বিদ্যুতের লাইসেন্সকৃত একজন টেকনিশিয়ান আমি রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে গ্রাহকের বাড়িতে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ করতে গেলে প্রথমে সিরাজ চেয়ারম্যানের লোকজন আমাকে একটি প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি হল ওয়ারিং এর মালামাল তাদের কাছ থেকে ক্রয় করতে হবে। কিন্তু তারা যে মালামাল দিচ্ছে তা খুবই নিম্নমানের যার সর্বোচ্চ মূল্য ৯ শত টাকা। কিন্তু সেই মালামাল তাদের কাছ থেকে নিলে গ্রাহকের সংযোগ লাগানো প্রর্যন্ত ৩৫ শত টাকা খরচ হবে । যেখানে গ্রাহক সরাসরি ১ হাজারের অধিক টাকা করে প্রতারিত হচ্ছে । আমি তাদের শর্তে রাজি হলে এই খাত থেকে ৮ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে । আমি তাই তাদের কথাতে রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে মারধর করে এ বিষয়ে দৌলতপুর থানায় আমি একটি লিখিত অভিযোগ করেছি।
এ বিষয়ে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সিরাজ মন্ডল এর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যাপারে আমার ক্যাডার বাহিনী নিয়োগ করে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এমন অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আপনাদের কাছে কে বক্তব্য দিয়েছে তার কাছে আমাকে নিয়ে চলেন আমার সামনে জিজ্ঞাসা করেন দেখেন তারা কিছুই বলবেনা। সামনে নির্বাচন তাই আমার প্রতিপক্ষরা আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য মিথ্যা কথা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এ বিষয়ে দৌলতপুর থানা অফিসার ইনচার্জ জহুরুল আলম জানান, থানায় একটি লিখিত অভিযোগ হয়েছে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এ বিষয়ে দৌলতপুর পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিসের ডিজি এম মির্জা তুহিন জানান, আমরা উদ্বোধনের দিনই ঘোষণা দিয়েছি চর এলাকার প্রান্তিক মানুষের জন্য ওয়ারিং এর মালামাল যার যেখান থেকে ইচ্ছা ক্রয় করে পল্লী বিদ্যুতের লাইসেন্সকৃত টেকনিশিয়ান দিয়ে কাজ করিয়ে নিলে আমরা সংযোগ লাগিয়ে দিব। সেখানে দুর্নীতি হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। তবে কোনো ধরনের অনিয়ম যদি আমার কোন স্টাফ অথবা ইলেকট্রিক টেকনিশিয়ান করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। অথবা কোন জনপ্রতিনিধি অথবা স্থানীয় জনগণ কোন দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকে তাহলে আমরা এমপি মহোদয় এর মাধ্যমে সে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদ মামুন জানান, আমি এবং এমপি মহোদয় উপস্থিত থেকে চরাঞ্চলের বিদ্যুৎ সংযোগ উদ্বোধন করেছি। সেখানে কোনো গ্রাহক যদি হয়রানি হয় তাহলে অবশ্যই আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ জানান, চরবাসী যত কম টাকায় নিজে মালামাল ক্রয় করে কাজ করতে পারে সেই কথা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলে এসেছি। সেখানে বেশী নেওয়ার সুযোগ নেই। বেশী নিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা ডেস্ক।। বিডি টাইমস নিউজ