কথাও কম, কাজও বেশি নয়। ‍আবার কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। কাজ কম, কথা বেশি, এই ফর্মুলায় চলছে বাংলাদেশ। চারদিকে উন্নয়ন আর উন্নয়ন। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে! ‍আজ সকালে অফিসে ‍এসে ফেসবুক খুলতেই দেখি ‍আমার ‍এক পুরোনো কলিগের ‍একটি পোস্ট। পোস্টটি পড়ে বুঝতে পারলাম যে সে বাংলাট্রিবিউন নামে ‍একটি ওয়েব পোর্টালে কাজ করে। কৌতুহল বসত সাইটে ঢুকে ‍একটু নাড়াচাড়া করছি হঠাৎই চোখে পড়লো এগিয়ে যাওয়া এই উন্নয়নের কিছু বিষয় নিয়ে গোলাম মোর্তোজা ভাইয়ের কিছু লেখা।

১# বাংলাদেশে গাড়ি ডান হাতে চালিত। রাস্তার সব ট্রাফিক নির্দেশনাগুলো ডান হাতে চালিত গাড়ির জন্য। মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারটি নির্মিত হচ্ছে বাম হাতে চালিত গাড়ির জন্য! ‍এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, দেশ এগিয়ে যাওয়ার মতোই নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০০৩ সালে আমেরিকার একটি কোম্পানিকে দিয়ে এই ফ্লাইওভারের নকশা করানো হয়। আমেরিকায় গাড়ি বাম হাতে চালিত। তারা নকশাও সেভাবেই করেছে। নির্মাণ কাজ শুরু হলো, এতদিন ধরে চলছে, সাড়ে ৩ শ’ কোটি টাকার কাজ সাড়ে ১২ শ’ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে—এত বড় ত্রুটির দিকে নজর দেওয়া হয়নি। এখন ত্রুটি সংশোধন করতে হলে কমপক্ষে ৬০টি পিলার ভাঙতে হবে। এতে খরচ বাড়বে কয়েক শ’ কোটি টাকা? জনভোগান্তির অবস্থা কেমন হবে? ফ্লাইওভার প্রকল্প পরিচালক নাজমুল আলম বলছেন, যা হয়েছে সবার সামনেই হয়েছে। ভুল হওয়ার কথা নয়।

এ কেমন রসিকতা? জনঅর্থের কেন এমন অপব্যবহার? ডান হাতে চালিত গাড়ি, কিভাবে বাম হাতে চালিত নকশার ফ্লাইওভার দিয়ে চলবে? কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কোনও সমস্যা হবে না। এই বক্তব্যও কি রসিকতা নয়?

২# মেট্রোরেল দীর্ঘ সময় নিয়ে গবেষণা-পরিকল্পনা করে নকশা করল জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। বিমান-বাহিনীর আপত্তি তেজগাঁও বিমানবন্দর তারা ব্যবহার করতে পারবে না, মেট্রোরেল হলে। কোনও সমস্যা হবে না, তথ্য-যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেন দেশীয় বিশেষজ্ঞরা। তারপরও রুট বদলে গেল। এখন মেট্রোরেল যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে। যেখান দিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়, সেটা বন্ধ করে দিল বিমান-বাহিনী। এখন আপত্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদেরও। এমন আপত্তি যে আসবে, জানা থাকা উচিত ছিল কর্তৃপক্ষের। পরিকল্পনার সময়ই কথা বলা প্রয়োজন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। এর কোনও কিছুই না করে রুট করে ফেলা হয়েছে। ‘শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাসহ কোনও সমস্যা হবে না’—বলা হলেও ছাত্র-শিক্ষকরা কতটা মেনে নেবেন, তা এখনও পরিষ্কার নয়।

মেট্রোরেলের পুরো প্রকল্পই এখন ঝুঁকির মুখে। অথচ এ বাবদ ইতোমধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।

৩# মেট্রোরেল যদি হয়ও তাতেও ঢাকার খুব একটা উপকার হবে বলে মনে করেন না বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামসুল হকসহ অন্য বিশেষজ্ঞরা। কারণ, অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে উঠলে, তা আর পরিকল্পনায় আনা যায় না। ঢাকা মহা-অপরিকল্পিত শহর। এই অবস্থায় পরিকল্পনা হওয়া দরকার ছিল ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার। মেট্রোরেল পরিকল্পনার গবেষণার সময় জাপানি বিশেষজ্ঞ, দেশীয় বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা এ কথা অনেক আগেই সরকারকে বলেছেন।

পৃথিবীর অনেক দেশ এমনটা করেছে। দিল্লি থেকে নয়া দিল্লি হয়েছে। পাকিস্তান রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদ নিয়ে গেছে। মালয়েশিয়া কুয়ালালামপুরের পাশে গড়ে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন পুত্রজায়া। মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাও রাজধানী সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের এ বিষয়ক কোনও পরিকল্পনাই নেই। প্রশ্ন আসবে রাজধানী সরিয়ে নেবে কোথায়, আমাদের তো জায়গা নেই। সমস্যা জায়গার নয়, সমস্যা পরিকল্পনার।

৪# রাজধানী সরিয়ে নেওয়ার জন্যে বন্যামুক্ত শক্ত মাটির জায়গা প্রয়োজন। সাভার, পূর্বাচল, ভাওয়াল গড় এলাকা ছিল রাজধানী সরানোর সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। এর মধ্যে পূর্বাচলে যে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটা না করে খুব সহজে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া যেত। মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ার আয়তন ৭ হাজার একর, আমাদের পূর্বাচলের আয়তন ৬ হাজার ৫০০ একর। কিন্তু সরিয়ে নেওয়া হবে কিভাবে?

আমাদের তো কোনও জনস্বার্থপন্থী পরিকল্পনা নেই। ব্যক্তিস্বার্থ-কেন্দ্রিক পরিকল্পনা করে প্লট ভাগ বাটোয়ারা করে দেওয়া-নেওয়া হয়েছে।

৫# বাংলাদেশে জায়গা কম, মানুষ বেশি। যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে উপযোগী রেলপথ। যা সবচেয়ে অবহেলার শিকার। সড়কের পেছনে প্রত্যেক সরকার হাজার-হাজার কোটি টাকা সব সময় ব্যয় করে। আর রেলের লোকসানের হিসাব ফলাও করে প্রচার করে।

প্রচারে সমস্যা নেই। জনসেবা নিশ্চিত করে, চুরি বন্ধ করে বছরে যদি রেলের পেছনে ১ হাজার কোটি টাকা সরকার ভর্তুকিও দিত, তবু উপকার হতো। সেদিকে কোনও পরিকল্পনা নেই। রেলের জমি ১ টাকায় লিজ নিয়ে রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীরা কোটিপতি হয়েছেন, হচ্ছেন। আর রেলখাতকে দেখানো হচ্ছে দেউলিয়া হিসেবে। অথচ খুব সহজে রেলের সম্পদ রক্ষা করে, পুরো প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা যায়।

চুরি-ডাকাতি ছাড়া এ বিষয়ে কোনও চিন্তাভাবনাই নেই। আছে শুধু কথা। সব সরকার বলে, ‘আমরা রেলকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’ এই রসিকতা শুনতে-শুনতে মানুষের কান ঝালাপালা।

৬# আবার রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে ফিরে আসি। ঢাকাকে বাঁচানোর জন্যে ইতোমধ্যে বেশকিছু ফ্লাইওভার দৃশ্যমান হয়েছে। মেট্রোরেল এখনও আলোচনার পর্যায়ে। বুয়েট বিশেষজ্ঞদের গবেষকরা বলছেন, ফ্লাইওভার ঢাকার উন্নয়নে বা বাঁচানোর ক্ষেত্রে প্রায় কোনও ভূমিকা রাখতে পারবে না। ফ্লাইওভার কোনও সমাধান নয়।

পরিকল্পিতভাবে মেট্রোরেল করলে কিছুটা উপকার পাওয়া যেত। কিন্তু আমাদের অবকাঠামো উন্নয়ন যতটা জনস্বার্থে, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণে। মেট্রোরেল নির্মাণে অনেক বেশি অর্থ এবং সময় প্রয়োজন হয়। ফ্লাইওভার তুলনামূলকভাবে কম অর্থ ও সময়ে দৃশ্যমান করা যায়। সরকার সেদিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। এবং এই ফ্লাইওভারগুলোর কারণেই ঢাকা সর্বশেষ স্থায়ী সমস্যার মুখে পড়েছে।

তেজগাঁও-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের কারণে এই অঞ্চলে মেট্রোরেল করা যাবে না। গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কারণে মেট্রোরেল বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এসে আটকে থাকবে। মেট্রোরেল কোথাও ওপর দিয়ে, কোথাও মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া যায়। পৃথিবীর অনেক দেশ এমন করেছে। কিন্তু এতে খরচ বহুগুণ বেড়ে যায়। ঢাকার রাস্তা-লোকসংখ্যা-অর্থ সবকিছু মিলিয়ে এমন কিছু করা বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়। তার মানে এখন ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল যা করছি, যা করতে চাইছি, তা যদি হয়ও, সমস্যার তেমন একটা সমাধান হবে না।

৭# উন্নয়ন রসিকতার আর একটি টার্গেট গরিব মানুষ। এটাও সব সময়ের চিত্র। চা শ্রমিকদের বেঁচে থাকার অবলম্বন ধানি জমি নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল করবে সরকার। অথচ এর চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ জমি বড়লোকদের দখলে আছে। কিন্তু টার্গেট গরিবরা।

ঢাকার মেয়র সাঈদ খোকনের টার্গেট ফুটপাতের অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ছোট-ছোট দোকানের মালিকেরা। মতিঝিলসহ সারা ঢাকা শহরের রাস্তার অর্ধেকের বেশি জায়গা গাড়ি রেখে দখল করে রাখেন বড়লোকেরা। গাড়ি উচ্ছেদে নজর নেই। ছোট-ছোট দোকান ভেঙে দিচ্ছেন বুলডোজার দিয়ে। কিন্তু ১০০% অবৈধ বিজিএমইএ ভবন দাঁড়িয়ে আছে হাতিরঝিলের মাঝখানে। মেয়র সাহেব বিজিএমইএ ভবন ভেঙে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন না!

৮# সর্বশেষ এখন ভারতীয় ঋণে উন্নয়নের পাহাড়ি ঢল নামবে। ঋণের অর্থের ৬৫% বা ৭৫% ব্যয় করতে হবে ভারত থেকে জিনিসপত্র কিনতে! ইট-সিমেন্ট-রডও কিনে আনতে হবে ভারত থেকে। বিশেষজ্ঞ, ঠিকাদারও হবে ভারতীয়।

অথচ বাংলাদেশে এর চেয়ে ভালো মানের বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। বিশ্বমানের ইট-সিমেন্ট-রড বাংলাদেশে তৈরি হয়। বাংলাদেশ থেকে ইট নিতে চায় ভারত। চোরাই পথে বাংলাদেশের ইট-সিমেন্ট ভারতে যায়। ভারতের ইট-সিমেন্ট বাংলাদেশে আসে না। তারপরও আমরা ভারত থেকে কিনে আনব!

লেখকঃ গোলাম মোর্তোজা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে