ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ২০ দিন বয়সী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপের আর মাত্র কয়েকঘণ্টা বাকি। আজ বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যায় এই সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ঐক্যফ্রন্টকে স্বাগত জানাবে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোট ১৪ দল। ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি হওয়ায় এই সংলাপ নিয়ে মানুষের আগ্রহের পারদটা একটু উঁচুতেই। তাই সবার চোখ এখন গণভবনে।

আজ সন্ধ্যা ৭টায় আওয়ামী লীগ-ঐক্যফ্রন্ট সংলাপের দিন-ক্ষণ নির্ধারিত হয়ে আছে। এরই মধ্যে উভয় পক্ষ থেকেই সংলাপের অংশগ্রহণের সব ধরনের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। এখন কেবল অপেক্ষা, কখন গণভবনের দরজা খুলে ঢুকবেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। একইসঙ্গে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই সংলাপ থেকে কী ফল বেরিয়ে আসে, তা নিয়েও চলছে ভাবনা। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংলাপ বলতে গেলে ছিল একদমই অপ্রত্যাশিত। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধাক্কায়, গত ১৩ অক্টোবর জন্ম নেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে এই জোটের। আত্মপ্রকাশের তিন সপ্তাহের মধ্যেই একাধিক সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে জোটটি রয়েছে শুরু থেকেই আলোচনায়। ৭ দফা আর ১১ লক্ষ্য নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যেই ঘোষণা আসে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংলাপে বসতে চায় তারা। এরপর খুব দ্রুতই ঘটে যায় ঘটনা— চূড়ান্ত হয়, ১ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল সংলাপে বসছে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে।

গত ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ চেয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় ঐক্যফ্রন্ট। সেদিন সন্ধ্যায় ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়ে দলের দফতর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপের কাছে এ সংক্রান্ত দুইটি চিঠি হস্তান্তর করেন।

পরদিন সোমবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ওবায়দুল কাদের জানান, শিগগিরই ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসা হবে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর কন্যার দরজা কারও জন্য বন্ধ থাকে না। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, আমরা সংলাপে বসতে রাজি।’কেবল সংলাপে বসাই নয়, সে সময় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সামনে তাদের পছন্দের কোন খাবার করা যেতে পারে, সেটাও জেনে নেওয়ারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। সোমবার বিকেলেই ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নিজের বিশেষ সহকারী ও দলের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের মোবাইল ফোন করে এই নির্দেশ দেন তিনি। এরপর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে সংলাপের পর রাতের খাবারে কী কী পরিবেশন করা হবে সেই তালিকাও।

পরদিন মঙ্গলবার (৩০ অক্টোবর) সকালে আবদুস সোবহান গোলাপ প্রধানমন্ত্রী চিঠি নিয়ে হাজির হন ড. কামালের বাসায়। জানা যায়, ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায়  ঐক্যফ্রন্টকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হঠাৎ করেই সংলাপের আহ্বান ও তাতে সরকারি দলের সম্মতিতে সবাই খানিকটা স্বস্তি বোধ করছিলেন। তবে এর মধ্যে মঙ্গলবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় হাইকোর্টের রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা ৫ বছর থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ বছর। আওয়ামী লীগের শীর্ষ একাধিক নেতাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, সংলাপ হবে সংবিধানসম্মত। তাতে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি তোলার সুযোগ থাকবে না।

এসব বিষয় মাথায় রেখে সংলাপ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে আশঙ্কা জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের নেতার। এর মধ্যে ‍বুধবার (৩১ অক্টোবর) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কি আমাদের সংলাপের জন্যে ডেকেছেন? আলোচনার নামে তিনি লোক দেখানো সংলাপের আয়োজন করেছেন কি না, সেটাও ভাবার বিষয়।’ প্রায় একই সুর জোটের অন্যতম শরিক বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরেরও। বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানবন্ধনে তিনি বলেন, ‘তারা একদিকে সংলাপের কথা বলছে, অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ বাড়িয়েছে। সাজানো মামলায় তিনি জামিন পেলেও জামিন দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় সংলাপের আহবান করা সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ পায় না। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সংলাপ ফলপ্রসূ হতে পারে নাহ। তাকে কারাগারে রেখে এ দেশে কোনো নির্বাচনই হতে পারে না।’

অবশ্য সংলাপ নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা ভাবছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। বুধবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীর বাসায় নৈশভোজ শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন চায়। অর্থবহ পরিবর্তনের লক্ষে গনভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।’ তবে সংলাপ নিয়ে নেতাদের মধ্যে সংশয় বা শঙ্কা যাই থাকুক না কেন, গোটা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছেন এই সংলাপের দিকে। কেননা, শুধু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গেই নয়, একে একে জাতীয় পার্টি, বিকল্প ধারাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের খবর প্রকাশ হচ্ছে। এসব সংলাপ দেশের রাজনীতিতে ফলপ্রসু পরিবর্তন নিয়ে আসবে এমনটাই আশা সবার।

যারা বসবেন সংলাপে
বৃহস্পতিবারের সংলাপে গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোটের ২৩নেতা অংশ নেবেন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৯ জন, জাসদের দুই নেতা, সাম্যবাদী দলের একজন ও ওয়াকার্স পার্টির একজন উপস্থিত থাকবেন।

সংলাপে আওয়ামী লীগের ১৯ নেতার মধ্যে রয়েছেন— প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, আবদুল মতিন খসরু, কাজী জাফরুল্লাহ, ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। এছাড়াও আওয়ামী লীগের ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, আব্দুর রহমান, ড. আবদুস সোবাহান গোলাপ, ড. হাছান মাহমুদ ও অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন।

অন্যদিকে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও মঈনুদ্দিন খান বাদল, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া এবং ওয়াকার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বৈঠক অংশ নেবেন।বিএনপি থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস থাকবেন সংলাপে। অন্যপক্ষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলে বিএনপির পাঁচ জন, গণফোরামের তিন জন, জেএসডির তিন জন, নাগরিক ঐক্যর দুই জন, ঐক্য প্রক্রিয়ার দুই জন ও স্বতন্ত্র হিসেবে একজন মিলিয়ে মোট ১৬ জনকে চূড়ান্ত করা হয়েছে।

নাগরিক ঐক্য থেকে থাকবেন সংগঠনটির মাহমুদুর রহমান মান্না ও এস এম আকরাম। এছাড়া গণফোরাম থেকে সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুব্রত চৌধুরী; জেএসডি থেকে সভাপতি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন ও সহসভাপতি তানিয়া রব; ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সুলতান মনসুর ও আ ব ম মোস্তফা আমিন ও স্বতন্ত্র হিসেবে থাকবেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

নিউজ ডেস্ক।। বিডি টাইম্‌স নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে