প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী ব্যাংক থেকে নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে জামায়াত-শিবির চক্র। ২০১৭ সালে নতুন পরিচালনা পর্ষদ আসার পরও তা বন্ধ হয়নি। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপ। যাদের পিওন থেকে শুরু করে বেশ ক’জন কর্মচারীর নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। একাত্তরের টেলিভিশনের অনুসন্ধানে বলছে- একটি দোকানের ম্যানেজারের নামেও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। অথচ নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপানা পরিচালকের দাবি তিনি এসবের কিছু জানেন না।
মোটরবাইক দোকানের ম্যানেজার সুলতান অ্যাসোসিয়েটসের মালিক সুলতান আহমেদ সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনি ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংকের কাগজপত্র এসব হলেও বাস্তবের সুলতান মাত্র ২০ হাজার টাকায় চাকরি করেন। যার কোনো কোম্পানি নেই, আর ব্যাংক ঋণের কথা শুনে তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। ৩৮০ কোটি টাকার ঋণ পাওয়া কথিত এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের ঠিকানা হিসেবে দেখানো হয়েছে রাজশাহীর স্টেশন রোডে সদ্য নির্মাণ হওয়া একটি ভবন। সুলতান আহমেদের মতো আর একজন রোকনুজ্জামান মিঠু। তিনি ১২ হাজার টাকা বেতনে একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। ঋণ নিয়েছেন ৯৫০ কোটি টাকা। রাস্তার মোড়ের একটি চায়ের দোকানে দেখা হয় এই প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া মিঠুর সাথে। কথা বলতেই কোন উত্তর না দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে যান রোকনুজ্জামান মিঠু।
রাজশাহীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিসাব রক্ষকের কাজ করেন শাজাহান আলী। তার নামে করা প্রতিষ্ঠান এসএস স্ট্রেট লাইন ঋণ নিয়েছে ৯০০ কোটি টাকা। প্রায় হাজার কোটি টাকার মালিকের বাড়ি রাজশাহীর নওহাটা ইউনিয়নে। তার স্ত্রী জানান, ৯০০ কোটি টাকার ঋণ দূরের কথা শাহজাহানের কোনো ব্যবসাই নেই। সামান্য বেতনে চাকরি করা তিন ব্যক্তির সন্দেহজনক এমন ঋণের খবর সম্পর্কে দুই সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে অনুসন্ধান চালায় একাত্তর টেলিভিশন। নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঋণ পেতে মিঠু আমানত হিসেবে জমা দিয়েছে ৫০ কোটি আর শাজাহান ১০০ কোটি টাকা আর সুলতান দিয়েছে ৪০ কোটি টাকা।
জামান সিন্ডিকেটের মালিক রোকনুজ্জামান মিঠুকে ঋণ দেয়া হয়েছে পাবনা জেলা সদর শাখা থেকে। ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ি, জামান সিন্ডিকেটের অফিস পাবনা জেলার হেমায়েতপুর উপজেলার ইসলামপুর। প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া অফিস ঘরটি ভাড়া নেয়ার পর কয়েকবার শুধু রাতের বেলা খোলা হয়েছে। একজন অফিস সহকারীর নামে কিভাবে ৯৫০ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হলো এমন প্রশ্নে ইসলামী ব্যাংকের ম্যানেজার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আর জামান সিন্ডিকেটের এই কথিত অফিস ভাড়া ও সাইন বোর্ড টানানোর কাজ করেছে ইসলামী ব্যাংকের ম্যানেজার মোহাম্মদ শাহজাহান এবং সিনিয়র অফিসার জাহিদ হাসান।
মোটরসাইকেল দোকানের ম্যানেজার সুলতান আহমেদের নামে ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে রাজশাহীর নিউমার্কেট ব্রাঞ্চ থেকে। এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি। তবে জানান, যা হয়েছে সব ‘উপরের নির্দেশে’। নথি বলছে, শুধু নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানই নয় এর বাইরেও ব্যাংক ঋণের শর্ত ভঙ্গ করে প্রায় আরো দুই হাজার ৯ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার বড় শর্ত হলো প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট রেটিং, কর্পোরেট রেটিং, পাস্ট পার্ফমেন্স। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এগুলোর কিছুই নেয়া হয়নি। এমন তুঘলঘি কাণ্ড কীভাবে হচ্ছে তা জানতে জোনাল হেড মিজানুর রহমান মিজির কাছে গেলে তিনি একাত্তরের উপস্থিতি টের পেয়ে রাজশাহী অফিস থেকে সটকে পড়েন। তাকে তিন দিন অনুসরণ করে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় পাবনার চাটমোহর উপজেলার একটি ব্রাঞ্চে। কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে বরাবর ঘামছিলেন এই কর্মকর্তা। একপর্যায়ে স্বিকার করেন, কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্টর কর্মকর্তার নির্দেশে এসব করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, রোকনুজ্জামন মিঠু, মো শাহজাহান আলী দুই জনই নাবিল গ্রুপে কাজ করেন। মিঠু অফিস সহকারী আর মোঃ শাহজাহান হিসাবরক্ষক। তবে সুলতান আহমেদ সরাসরি নাবিল গ্রুপের কর্মচারি না হলেও তার ঋণের টাকাও গিয়েছে এদের হাতেই। এর বাইরেও ৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া এন অ্যান্ড এন ট্রেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক নাবিল গ্রুপের কর্মচারি রায়হানুল ইসলাম। ঋণ প্রস্তাবে দেয়া প্রতিষ্ঠানের দেয়া ঠিকানায় নাবিল গ্রুপের আরো দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নামফলকও দেখা যায়। এ’বিষয়ে নাবিল গ্রুপের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম স্বপনের সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি একাত্তরের সাথে দেখা করতে অপারগতা জানান। কিন্তু মুঠোফোন বলেন, তার কর্মচারিদের নামে ওঠানো হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণের দায় তার না।
আনোয়ার ইসলাম স্বপনের এই বক্তব্য যে অসত্য তার প্রমাণ মেলে রাজধানীর বনানীতে নাবিল গ্রুপের ঢাকা অফিসে। ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া এসএস স্ট্রেটলাইনের অফিস আর নাবিল গ্রুপের অফিস একই ভবনে। বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে কীভাবে লোনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, এর পেছনে কারা কারা কাজ করেছে এমন প্রশ্ন নিয়ে আমরা হাজির হই ইসলামী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পুরো প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। ইসলামী ব্যাংকে আনোয়ারুল ইসলাম স্বপনের প্রভাব উৎস কোথায়? আমাদের অনুসন্ধান বলছে, ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহীর দুটি ব্রাঞ্চের কমপক্ষে পাঁচ জন কর্মকর্তা এমন ঋণ নেবার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। আর তারা জানান ঊর্ধ্বতনদের কথা।
অনুসন্ধান বলছে, ২০১৭ সালেও প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কাজ করতেন মিফতা উদ্দীন। পাঁচ বছরে সাতটি প্রমোশন হয়েছে তার। বর্তমানে এসএভিপি হিসেবে কর্মরত পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্ট উইং-১ এর প্রধানের দ্বায়িত্ব পালন করছেন। এমন আরো ছয় জন কর্মকর্তার নাম এসেছে অনুসন্ধানে, যারা গেলো পাঁচ বছরের মধ্যে তিন থেকে আটটি পদোন্নতি পেয়েছেন। যার জন্য কাজের ক্ষেত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রত্যেকই কর্মজীবনে রাজশাহী ও চট্রগ্রামে ছিলেন। সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য পাঁচ বছরে কীভাবে তিন থেকে আটটি পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন? উর্ধতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ সম্পর্কে জানতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কার্যালয়ে গেলে তিনি জানান, এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে এক সময়ের জামায়ত শিবিরের নেতা আমিনুল ইসলাম স্বপন আমদানি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করার পর ২০০৮ সালে রাজশাহী ইসলামী ব্যাংকের নিউমার্কেট শাখায় প্রথম পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নেন। আমিনুল ইসলাম স্বপনের অন্যতম ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়েত নেতা মীর কাসেম আলীর ট্রাস্ট। এরপর ধীরে ধীরে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তা আর রাজনৈতিক প্রভাবেই মূলত নির্ধারিত হতো ঋণের পরিমাণ। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন হবার পরও তার সখ্যতা আরো বৃদ্ধি পায়। এরপর পর বিদ্যুৎ গতিতে তার ঋণ ও বেনামে নেয়া অস্বাভাবিক ঋণ বাড়তেই থাকে।
একাত্তর টেলিভিশন থেকে নেয়া।