লেখক – ডালিম হাজারী(আরামবাগ,ফেনী)।। আমার এক পরিচিত হঠাৎ করে ফোন দিলেন। কুশল বিনিময় হলো অনেক কথাও হলো। তিনি যেন আরও কিছু বলবেন কিন্তু বলতে পারছেন না। সংকোচ করছেন। আমি বললাম সংকোচ করবেন না, বলে ফেলুন। অনেক্ষণ পর অনেক ইতস্ত হয়ে তিনি জানতে চাইলেন আগামী কুরবারের ঈদের আগে তাকে হাজার বিশেক টাকা ঋণ দিতে পারব কিনা। বলে- রাখি এই মানুষটি সচরাচর ঋণ করে চলার মানুষট না। শিক্ষক মানুষ যা বেতন পান তা দিয়ে কোন রকমে সংসারটা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

টাকা চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ক’দিন আগেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ঈদের আগে একটা ছাগল হলেওতো দেয়া দরকার, নাহলে যে মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে ছোট হবে। শুধু এই একজন বাবা নন অধিকাংশ বাবা-ভাইয়েরা মেয়ের-বোনের শ্বশুর বাড়িতে কুরবানীর পশু দিতে গিয়ে এভাবেই ঋণ করেন। বাধ্য হয়ে অন্য মানুষের কাছে হাত পাতেন। কিন্তু এই গরু বা ছাগল উপহারের ভিত্তি কি? কুরআনের পরিস্কার নির্দেশনা হলো, যাদের সামর্থ্য আছে কুরবানি একমাত্র তাদের জন্যই প্রযোজ্য। আর যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের কুরবানি করা জরুরি নয়। তাই এই উপহার দেওয়া না দেয়ায় কিছু আসে যায় না। অন্যের উপহারে কারো উপর ওয়াজিব হওয়া কুরবানি গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা অনেকটা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সরকারি খয়রাতে হজ করার মতো।

যার গরু ছাগল কেনার সামর্থ্য নেই সে হাঁস মুরগী খেতে পারে। নইলে বাজার হতে খোলা মাংস কিনতে পারে। অথবা যারা কুরবানি করেছে তাদের কাছ থেকে উপহার বা হক হিসেবে নিতে পারে। শ্বশুরবাড়ির টাকায় কেন পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে পরোটা মাংস চিবাতে হবে? এটাও এক ধরনের যৌতুক, এবং ইসলামী রীতিতে বর্জনীয়। আমরা বাঙালি মুসলিমরা সত্যিকার ইসলাম চর্চা হতে বহু বহু দূরে। মেয়ের ফ্যামিলি হতে যত কিছু ফ্রি পাওয়া যায় ততই আমাদের দাঁতের পাটি চওড়া হতে থাকে। ফ্রি পেতে কে না ভালবাসে। এই জঘন্য সংস্কৃতি প্রচলনের উৎস কোথা থেকে? অনেকেই ধারকর্জ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এসব গরু ছাগল উপঢৌকন পাঠাতে। নইলে মেয়েকে অনেক আজেবাজে কথাবার্তা শুনতে হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে শারীরিক নির্যাতনও হয়ে থাকে। পরিবারের গন্ডিতেই তুলনা দিয়ে বলা হয়, অমুক বউয়ের বাপেরবাড়ি হতে তো ঠিকই বড় গরু পাঠিয়েছে। আমাদের আর কাউকে মুখ দেখানোর উপায় রইল না।

আবার কিছুসংখ্যক মেয়েকেও দেখা যায় অগ্রবর্তী হয়ে বাবা মায়ের কাছ থেকে এসব গরু ছাগল উপহার নিতে। এরা বিয়েতেও নিজ বাবাকে অপব্যয় করানোতে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। যদিও এজন্য মেয়ের বাবা মায়েদেরও কিছুটা দায় আছে। বেশিরভাগ পরিবার মেয়েদের প্রাপ্য সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয় না। তাই এসব মেয়েরা অন্যভাবে আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করে। আবার অনেক মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য হলেও নিজ বাবা মায়ের উপর চাপ প্রয়োগ করে।

অনেক ধনী ছেলের পরিবারও ফকিরের মত এই আচরণ করে থাকে। অনেকে আবার পাড়া প্রতিবেশিকে গর্ব করে বলে বেড়ায় তাদের বেয়াই বাড়ি হতে গরু আসছে। আরে, এদের মত গরু থাকতে বেয়াই বাড়ি হতেও গরু লাগে? নিজেদের গর্ব করার মত কিছু নেই, তাই ছেলের বউয়ের বাপের বাড়ি হতে নেয়া উপঢৌকনই হয়ে দাঁড়ায় গর্বের বিষয়। এরা বুঝে না, ছেলের মাধ্যমে নিয়ে যে অসুস্থ রীতি চালু করেছে, মেয়ের মাধ্যমে সেই একই গরু ফেরত পাঠাতে হবে। এই জোরজবরদস্তির উপহার মেয়ের পরিবারের উপর একটা ভয়াবহ চাপ ছাড়া কিছুই না। বাংলাদেশের মানুষের উচিত এই কুপ্রথা এই মুহূর্ত হতে বর্জন করা এবং এই অসুস্থ কালচারকে চিরতরে দাফন করে ফেলা।(ছবি ও লেখাটি লেখক ডালিম হাজারী’র ফেসবুক থেকে নেয়া)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে