লেখক- আতিকুল ইসলাম ইমন – ১৯৭১’সালে পৃথিবী জুড়ে সবচেয়ে বড় আলোচিত ঘটনা ছিলো বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সঙ্গত কারণেই বিশ্ব গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ হতো মুক্তিযুদ্ধের খবর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে তখন প্রকাশ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অসংখ্য প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কলাম, চিঠি ইত্যাদি। এসবই বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের একেকটি অকাট্য দলিল— যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিমেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সে সময় খবরের কাগজে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ বা চিঠিপত্র ৫০ বছর পরেও বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়।
যদিও বিভিন্ন দেশের আর্কাইভে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এসব সংরক্ষিত রয়েছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সব কন্টেন্ট পুর্ণাঙ্গভাবে হাতের নাগালে পাওয়া বাংলাদেশে সহজ নয়। তবে আশার কথা হলো— মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ডিজিটাল আর্কাইভ ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ এসব দলিল ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করার কাজ করছে। ফলে যে কেউ চাইলেই ঐতিহাসিক দুর্লভ এসব কন্টেন্ট পড়তে বা গবেষণা কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ মূলত একটি ডিজিটাল সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালাকে বলা চলে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ক একটি ডিজিটাল পাবলিক লাইব্রেরি। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অসংখ্য বই, দলিল-দস্তাবেজ, ছবি, তথ্যচিত্র, অডিও ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের পথচলা ২০০৭ সাল থেকে। এর প্রতিষ্ঠাতা সাব্বির হোসাইন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কন্টেন্ট ডিজিটাইজ করার এ বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। সারাবাংলাকে তিনি জানান, এই সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে। প্রায় তিন বছর পর গত অক্টোবরে প্রথম খণ্ড প্রকাশ হয়েছে। মোট পাঁচ খণ্ডে ভাগ করে প্রকাশিত হবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কন্টেন্টের বিশাল ডিজিটাল ভাণ্ডার।
সাব্বির হোসাইন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৫৬টি প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ, কলাম, সাক্ষাৎকার, চিঠি সহ বিভিন্ন কন্টেন্ট প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত এসব কন্টেন্ট সংগ্রহ করে ডিজিটাল সংরক্ষণের কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ। ইতিমধ্যে আমরা প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেছি। প্রথম খণ্ডে আমরা ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলো যেমন— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন কন্টেন্ট অন্তর্ভুক্ত করেছি। এই খণ্ডে মোট পাতার সংখ্যা ২৬ হাজার ৭৯২টি। এই খণ্ড এতোটাই বিশাল যে— এর ডেটার আকার হচ্ছে পাঁচ টেরাবাইট।”
আগামী বছরের মধ্যে আরও চার খণ্ড প্রকাশ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ। সাব্বির হোসাইন জানান, প্রথম খণ্ডে প্রকাশ হয়েছে— যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ডের স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ। দ্বিতীয় খণ্ডে থাকবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত কন্টেন্ট। তৃতীয় খণ্ডে থাকবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত বাঙালি গণহত্যা নিয়ে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পত্রিকার সংবাদ। চতুর্থ খণ্ডে ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি শরণার্থীদের নিয়ে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক পত্রিকার সংবাদ। আর পঞ্চম খণ্ডে থাকবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অ-ইংরেজিভাষী বিভিন্ন দেশে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের কাটিং।
কোনো সময় বুঝতে হলে বা সে সময় সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাণ্ডার হলো সে সময়ের পত্রিকাগুলো। ১৯৭১ সালে বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। কারণ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত বাঙালি গণহত্যা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভয়াবহতম গণহত্যা। সারাবিশ্বেই মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বহুল আলোচিত। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের খবর, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি হুবহু জানা যাবে সে সময়কার পত্রিকা পড়লে। তাই এই সংগ্রহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আগ্রহী যে কোনো ব্যক্তি বা গবেষকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিশাল এই সংগ্রহের গুরুত্ব ঠিক কতখানি? এমন প্রশ্নের জবাবে সাব্বির হোসাইন বলেন, “আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে বা ব্রিটেনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার আর্কাইভ আছে। কিন্তু সমস্যা হলো— বাংলাদেশে বসে কেউ সেগুলো পড়তে পারবেন না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকরা তাদের গবেষণার কাজে ইতোমধ্যেই অনেক পত্রিকার কাটিং সংগ্রহ করেছেন কিন্তু তা কন্টেন্ট সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। বিদেশি পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কন্টেন্টের অধিকাংশই এখনো বাংলাদেশের মানুষের নাগালের বাইরে। তাই মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ সেগুলো সংগ্রহ করে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। এর ফলে এই তথ্য ভাণ্ডার এখন যে কারো হাতের নাগালে। আমরা চাই তথ্যগুলা নিয়ে গবেষণা হোক। গবেষণা কাজে যদি কারো সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তবে মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ সেই সহযোগিতা করতেও সদা প্রস্তুত।”
সাব্বির হোসাইন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ক গবেষকরা এই কনটেন্ট বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়া আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে এই সংগ্রহ বিনামূল্যে দেওয়ার কাজ করছি। প্রাথমিকভাবে আমরা চাই, এই সংগ্রহ গবেষণামূলক কাজে ব্যবহার হোক। ইতিমধ্যে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সাংবাদিক তাদের গবেষণায় এই সংগ্রহ ব্যবহার করছেন।”
বিদেশি পত্রিকার কন্টেন্ট সংগ্রহ করার চিন্তা কিভাবে এলো? সাব্বির হোসাইন বলেন, “রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, বসনিয়া গণহত্যার তথ্যগুলো খুব পূর্ণাঙ্গ ও সুসংগঠিতভাবে সংগ্রহ করা আছে। এসব গণহত্যা সম্পর্কে যে কেউ জানতে চাইলে সহজেই তা পেয়ে যায়। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দলিল-দস্তাবেজ, বই, পত্রিকা কাটিং ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এখনো তা সহজলভ্য নয়। নিউইয়র্কের একটি লাইব্রেরির আর্কাইভে আমি ১৯৭১ সালের কিছু পত্রিকা দেখি। তারপর ভাবলাম বিদেশি পত্রিকায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নিউজগুলো সংগ্রহ করে রাখি। হয়তো ভবিষ্যতে কাজে দেবে। সেই ভাবনা থেকে সংগ্রহ করা শুরু করি। তারপর আমেরিকার অনেক পাবলিক লাইব্রেরি থেকে পত্রিকা সংগ্রহ শুরু করি। পাবলিক লাইব্রেরিতে আবার সবকিছু পাওয়া যায় না। আমরা কিছু পত্রিকা বিভিন্ন বাণিজ্যিক আর্কাইভ থেকে ক্রয় করেছি। যেমন: লেক্সাস নেক্সাস, আমেরিকান নিউজপেপার আর্কাইভ, ব্রিটিশ নিউজপেপার আর্কাইভ থেকে আমরা বহু কন্টেন্ট সংগ্রহ করেছি। পরে সেগুলো বাংলাদেশের মানুষদের জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করে প্রকাশ করেছি।”
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের ওয়েব পোর্টালে (www.liberationwarbangladesh.org) পত্রিকা বিষয়ক এই বিশাল সংগ্রহের প্রথম খণ্ড সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া আছে।
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ
মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকটা পাবলিক লাইব্রেরির ধারণায়। অর্থাৎ এখানে পাঠকরা বই, পত্রিকা, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি অনলাইনে পড়তে পারবেন, কিন্তু ডাউনলোড করতে পারবেন না। সাব্বির হোসাইন বলেন, “২০০৭ সাল থেকে মূলত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দুর্লভ বই, ছবি ও পত্রিকা কাটিং সংগ্রহ করতাম। পরে ২০১৩ সালে যখন গণজাগরণ মঞ্চে রাজাকার বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে— তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু দুর্লভ বইয়ের প্রয়োজন পড়ে। একটি বইয়ের নাম মনে আছে— মুশতারী শফী’র লেখা রক্তে ঝরা দিন। তখন এ বইটির খোঁজ করছিলাম, কিন্তু কোনো লাইব্রেরিতেই পাইনি। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তার কাছেও মাত্র এক কপি আছে। তখন এক বন্ধু জানালো এ বইটি শুধু ঢাকার নীলক্ষেতে পুরাতন বইয়ের একটি দোকানে পাওয়া যাবে। আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে এ বইটি সংগ্রহ করি। তখন ভাবলাম— মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা কাজ করেন বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে পড়তে আগ্রহী তাদের কাছে এরকম দুর্লভ বইয়ের প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে। এরকম ভাবনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের সূচনা হয়।
তবে বই, পেপার কাটিং ইত্যাদি ডিজিটাইজ করলেও তা কেউ ডাউনলোড করতে পারবেন না মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ থেকে। এ বিষয়ে সাব্বির হোসাইন বলেন, যেহেতু বইয়ের ব্যাপারে কপিরাইটের বিষয় আছে তাই আমরা পাবলিক লাইব্রেরির ধারণা অনুসরণ করলাম। পাবলিক লাইব্রেরিতে যেমন কেউ গিয়ে যে কোনো বই পড়তে পারবেন কিন্তু বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন না, ঠিক একইভাবে আমাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে যে কেউ শুধুমাত্র অনলাইনে পড়তে ও দেখতে পারবেন কিন্তু ডাউনলোড দিতে পারবেন না।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও ইতিহাসের যে বিকৃতি ঘটেছিল— তা রুখে দিতে ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ।
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ