বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সংবাদ জগতের সম্পর্কটি ছিল দীর্ঘকালের। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম জীবনে নিজেই সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইত্তেহাদ পত্রিকার তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি। [শেখ মুজিবুর রহমান: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউপিএল, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৮৮]। ফলে সংবাদপত্র, সাংবাদিক এবং গোটা সংবাদ জগতের ভেতরের বিষয়-আশয় সবটা তাঁর জানা ছিল।
পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক মঞ্চে তিনি যখন প্রায় একাই পাঞ্জাবি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সংবাদ জগতের কর্মীরাই ছিলেন তাঁর বড় সহায়ক শক্তি। ইত্তেফাক-এর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। বঙ্গবন্ধু যেমন ইত্তেফাকের জন্য লড়াই করেছেন, বিপদের দিনে ইত্তেফাকও বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
তাই সংবাদজগতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কটি ছিল দীর্ঘ ইতিহাসের টানাপোড়েনে আবদ্ধ। ১৯৭২ সালের ১৬ই জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা এবং প্রধানমন্ত্রীও। সেখানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আবেগ-আপ্লুতভাবে সেসব সম্পর্কের কথা প্রসঙ্গান্তরে উল্লেখ করেন,
সাংবাদিক ভাইয়েরা। আপনারা জানেন, আমি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আপনাদের অনেক সহকর্মী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তাঁরা আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। আমি অনেকদিন তাঁদের সঙ্গে জেলখানায় কাটিয়েছি। [ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম বার্ষিক সভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ১৬ই জুলাই ১৯৭২]।
বঙ্গবন্ধু তাঁর এই বক্তৃতাতেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনাদের সাংবাদিক ইউনিয়নের যে আদর্শ আছে, সেগুলো মানলে কি মিথ্যা কথা লেখা যায়’? আসলে স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশে নানা ঘটনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিদেশের টাকায় রাতারাতি সংবাদপত্র বের করার ঘটনাও ঘটেছিল। আর সেসব কাগজের প্রধান কাজ ছিল সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা। বঙ্গবন্ধুর কাছে এসব তথ্য ছিল। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, পাকিস্তানের জেনারেল আইয়ুব খানের দৈনিক পয়গাম যিনি চালাতেন, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রাতারাতি দৈনিক কাগজ বের করে সদ্য স্বাধীন দেশের নতুন সরকারকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছেন। বঙ্গবন্ধু এই বক্তৃতায় প্রসঙ্গান্তরে তাই এ প্রশ্নও করেছিলেন, ঐ কাগজের ‘মালিকের টাকা কোত্থেকে এল’?
প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে সেদিন এই অবস্থাই ছিল। বলা হতো, ব্যাঙের ছাতার মতো সংবাদপত্রে দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। তখন এদেশের সাক্ষরতার হার ছিল ১৭%। অথচ শত শত সংবাদপত্র বের হতো। বঙ্গবন্ধু এ জগৎটাকে একটা শৃঙ্খলায় আনতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি সাংবাদিকদের দিয়েই একটি কমিটি করে দিয়েছিলেন। এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন এনায়েতুল্লাহ খান। তাদের সুপারিশেই ছিল, চারটি পত্রিকা রেখে অন্যগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। যদিও বঙ্গবন্ধু সরকার সাপ্তাহিক ও অন্যান্য মিলে আরো ১২২টি পত্রিকা রেখে দিয়েছিলেন। কমিটিতে এনায়েতুল্লাহ খানের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনেকবারই সাংবাদিক ইউনিয়নের এককালীন নেতা নির্মল সেন লিখেছেন,
আমি বুঝতে অক্ষম, এনায়েতুল্লাহ খান কী করে বাকশালের সমর্থনে বিদেশে সাংবাদিক প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়েছিলেন। কী করে সে বিদেশ থেকে ফিরে এসে লিখল- now is the time to stand behind BAKSAL. আবার ১৫ আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর তার ভূমিকা আমাকে বিস্মিত করেছিল। হলিডে পত্রিকায় সে ও অচিন্ত্য সেন যৌথভাবে লিখল- now is the time for stand behind Khandoker Mostaq, no class struggle, now. [নির্মল সেন: আমার বন্ধু এনায়েতুল্লাহ খান]।
পরে আবার এ বিষয়ে উপসংহার টেনে নির্মল সেন লিখেছেন,… তবে এনায়েতুল্লাহকে অনেক সময় আমার বুঝতে অসুবিধা হয়েছে। সে কেন, কীভাবে বাকশাল গঠনের সময় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের জন্য আইন প্রণয়নের যে কমিটি হয়েছিল তার সদস্য ছিল তা আমি বুঝতে পারিনি। [নির্মল সেন : আমার বন্ধু এনায়েতুল্লাহ খান]।
দৈনিক ইত্তেফাক-এর ঈদ সংখ্যা ২০১২-তে লেখক ও কলামিস্ট আবু জাফর শামসুদ্দীনের ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছিল। এতে এনায়েতুল্লাহ খানকে সংবাদপত্র বিষয়ক কমিটিতে রাখায় তাঁর ক্ষুব্ধ মনের ছায়াপাত প্রকাশিত হতে দেখি। তিনি ৮ই মার্চ ১৯৭৫ তারিখে ডায়েরিতে লিখেছেন, … শুনলাম দেশের সংবাদগুলোকে একদলীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে ঢেলে সাজানোর প্ল্যান-প্রোগ্রাম তৈরি করছেন হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান এবং শহুদুল হক (Bangladesh Times)।
অন্যত্র, ১৭ই জুন ১৯৭৫ তারিখে আবু জাফর শামসুদ্দিন পত্রিকার সংবাদ দেখে ডায়েরিতে লিখেছেন, সকালে সংবাদপত্র সম্বন্ধীয় অর্ডিন্যান্সটি পড়ে দেখলাম। চাকরি কাদের থাকবে না থাকবে এ ব্যাপারে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। তাতে আছেন- ১. মিজানুর রহমান (লুপ্ত এনা-এখন বাসস- তার আগে ইত্তেফাক …), ২. অধ্যাপক এ. খালেদ এমপি, ৩. আনিসুজ্জামান খান এবং ৪. সলিমুজ্জামান (ডেপুটি সেক্রেটারি, প্রচার মন্ত্রক), ৫. গিয়াস কামাল চৌধুরী (সেক্রেটারি, ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস) ৬. আমানুল্লাহ খান এমপি, ৭. আব্দুল গণি হাজারি। [দেখুন, আবু জাফর শামসুদ্দীনের অপ্রকাশিত ডায়েরি, দৈনিক ইত্তেফাক-এর ঈদ সংখ্যা, ২০১২, পৃষ্ঠা ৬৬ ও ৭১]। এসব তথ্যে বোঝা যায়, গিয়াস কামাল, এনায়েতুল্লাহ খানরাই বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে এই চার পত্রিকা রাখার কাজটি করিয়ে নিয়েছিলেন। অথচ এখনো তাদের অনুসারীরা এজন্য লাগাতার বঙ্গবন্ধুকেই সমালোচনা করে যাচ্ছেন।
চারটি পত্রিকা রেখে অন্যসব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার এই ছিল পটভূমি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এখানে একেবারেই নির্দোষ। তবে এসব ছিল সেদিনের এক কঠিন বাস্তবতা। সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সাংবাদিক নেতারাও সংবাদজগতের এসব নৈরাজ্য থেকে উঠতে চেয়েছিলেন। ফলে তাঁদের কারো কারো সুপারিশে বঙ্গবন্ধু চারটি প্রধান পত্রিকা রেখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকাগুলোর সাংবাদিক কেউ বেকার হননি। এখানেই ছিল বঙ্গবন্ধুর অসাধারণত্ব, যা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকার সাংবাদিক যারা পত্রিকা থেকে নিয়মিত বেতনও পেতেন না, তাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে চাকরি পেয়ে গেলেন। এসব সাংবাদিকদের অনেকেই জীবনে উপ-সচিব, সচিব অথবা সমমানের চাকরি করে অবসর নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এই মানবিকবোধকে আজও একদল সাংবাদিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সম্পর্কে একজন সাংবাদিকের স্মৃতিচারণ স্মর্তব্য: … কোন কোন পত্রিকা ও সাংবাদিক শেখ মুজিবের বিরুদ্ধাচরণ, সমালোচনামূলক লেখা শুরু করে। … পরবর্তীতে যখন বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠিত হলো তখন ওই সাংবাদিকেরাই শেখ মুজিবের পরামর্শক হয়ে উঠলেন। তাদের পরামর্শে দেশে মাত্র চারটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক প্রকাশ রেখে অন্যসব কাগজ বন্ধ করে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের সরকারি চাকরি দেয়া হয়েছিল। চাকরি না দেওয়া পর্যন্ত সবাইকে বেতন দেয়া হতো। অথচ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘাতকের বুলেটে নিহত হবার পর এসব পরামর্শক সাংবাদিকরা তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়েছে। [বেবী মওদুদ: ‘সংবাদপত্র-সাংবাদিক ও শেখ মুজিব’, নিরীক্ষা, জুলাই-আগস্ট ২০১৩]।
সাংবাদিকের চাকরি নেই, তা বলে বেতন বন্ধ হয়নি, যতোদিন একটা সংস্থান না হয়েছে ততোদিন এই বেতন বঙ্গবন্ধু চালিয়ে গেছেন।
শুধু সম্পাদক, সাংবাদিকই নয়, সংবাদপত্রের প্রেসের কর্মচারীদের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কটি ছিল অনানুষ্ঠানিক। একবার বাংলাদেশ সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের নেতা এমএ করিমের নেতৃত্বে কর্মীরা দেখা করতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। যেদিন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকটি হলো, সেদিন একজন বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য তারিখ পেতে পেতে জুতার তলি খুলে গেছে- এই বলে তিনি জুতোটি উপরে তুলে ধরলেন। সকলে খুব অবাক! এভাবে জুতো তোলা সঙ্গত হলো কিনা! কিন্তু বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা হাল্কা করে দিলেন। হাসতে হাসতে পাশে দণ্ডায়মান তোফায়েল আহমেদকে বললেন, নিয়মিত দেখা করার জন্য যেন তাকে একটা লাল পাশ দিয়ে দেওয়া হয়।
গণতান্ত্রিক সমাজে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ আমরা সমর্থর করি না। কিন্তু সেদিনের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। প্রকৃত প্রস্তাবে গত শতকের সত্তর দশকের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ছিল, দুনিয়ার প্রায় সকল উন্নয়নশীল দেশ ও জাতি একটা নির্দিষ্ট উন্নয়ন মডেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই মডেলের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল স্থিতিশীলতা। আলজেরিয়ায় বুমেদিন, লিবিয়ায় গাদ্দাফি, ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, কিউবায় ফিডেল ক্যাস্ট্রো, মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ প্রমুখের নাম উল্রেখ করা যায়। যাঁর যাঁর দেশের উন্নয়ন মডেল নিয়ে কিন্তু তাঁরা এগিয়ে গেছেন। এই অবস্থায় সবকিছু খোলামেলা থাকে না, কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুও এরকম একটা উন্নয়ন মডেল নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর জন্যও প্রধান শর্ত ছিল দেশের স্থিতিশীলতা। আজকের প্রেক্ষাপটে হয়তো ব্যাপারটা অনেকের সঙ্গে মেলানো যাবে না বা বোঝাও কঠিন হবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত শতকের সত্তর দশকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তা ছিল বাস্তব। বঙ্গবন্ধু কখনো মিডিয়া বিরোধী ছিলেন না, যা পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণায় নিয়ে আসা হয়েছে।
আজকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে অপপ্রচারটা গণমাধ্যমে করা হয় তা কতো অমূলক ও একপেশে যা চিন্তা করলে খুবই যাতনা বোধ হয়। আর এটা যখন আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়, তখন এ পেশার পবিত্রতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যায়। আজ সময় এসেছে, এসব ভ্রান্তি আমাদর দূর করতে হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে ৪০ বছর পেরিয়ে আরো সামনে এগিয়ে চলেছে। ব্যাঙের ছাতার মতো পত্রিকার গতি আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কিন্তু সাংবাদিকতার পেশার মান কতোটুকু বেড়েছে, সাংবাদিকদের অধিকার সংবাদপত্রে কী পরিমাণ প্রতিফলিত হচ্ছে, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
(লেখাটি বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম গ্রন্থ থেকে নেওয়া)
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ