কত গুলো ঘটনা ভাবনার দাবি করছে – মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন স্থগিত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে “প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ” হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। চীনে ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর জাতিসংঘের এই সংস্থাটির অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করার পাশাপাশি তারা সত্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে বলেও অভিযোগ ডোনাল্ড ট্রাম্পের। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন যে, এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন কমানোর সঠিক সময় নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার নিজের দেশের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ সামলানোর বিষয়টি নিয়ে সমালোচিত হতে শুরু করার পটভূমিতে এরকম সিদ্ধান্ত। যখন আমেরিকানরা হাজারে হাজারে আক্রান্ত হচ্ছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণে। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়ে গেছে মৃত্যুর মিছিল।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে আগেই তথ্য ছিল বলে মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নাম প্রকাশ না করে এ খবর প্রকাশ করেছে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট। মার্কিন গোয়েন্দারা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে করোনাভাইরাসের বিস্তার ও মহামারী হওয়ার আশঙ্কা মার্কিন সরকারকে জানিয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া বক্তব্যে জানিয়ছেন, গত জানুয়ারি মাস থেকেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করে আসছে। তারা ট্রাম্প প্রশাসনের পাশাপাশি কংগ্রেসের সদস্যদের কাছেও এসব বার্তা দিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। এ রকম বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত থেকে সাদা চোখে মনে হতে পারে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরানোর প্রয়াস।নিজের সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করার চেষ্টা। শুধু কি তাই কখনও নয় সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর একক মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে নতুন করে তাদের যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) গ্রহণ করে, সেখানে চীনকে তারা তাদের প্রধান শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। যে কোন সুযোগেই চীনকে কোণঠাসা করা, দুর্বল করার চেষ্টা এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীনে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ওয়াশিংটনকে নতুন আরেকটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিং লিউ নামের এক চীনা করোনা গবেষকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকৃতি এবং সংক্রমণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করছিলেন তিনি। পুলিশের ধারণা, ওই গবেষককে তারই পরিচিত ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করেছে।সম্প্রতি তিনি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গবেষণায় ‘বড় কিছু সম্ভবত পেয়ে গেছি’ বলে জানিয়েছিলেন।বিং লিউ শঙ্কা প্রকাশ করে আগেই বলেছিলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণায় অগ্রগতির কারণে তাকে প্রাণে মেরে ফেলা হতে পারে।
ভাইরাস ইমেজিংয়ে গোটা বিশ্বে অগ্রণী ছিলেন জুন আলমেইডা। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গোটা বিশ্বে যখন মৃত্যু মিছিল,তখন আলোচনায় জুন আলমেইডা ও তাঁর গবেষণা।কোভিড-১৯ একটি নতুন ধরণের ভাইরাস, তবে সেটি করোনা ভাইরাসেরই একটি প্রজাতি। ১৯৬৪ সালে লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালের গবেষণাগারে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত করেছিলেন ডঃ আলমেইডা।
২১ জুলাই, ১৯১৮, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ অন্যতম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাশিয়াতেই প্রথম সবার জন্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলা হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবা কোনো অনুগ্রহ নয় অধিকার- সবার জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা, বিনা মূল্যে ওষুধ চালু করে।১৯৫৩ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে উঠতে পারেনি কোনো স্বাস্থ্য দপ্তর। আসলে সভ্যতার ইতিহাসে সমাজতন্ত্র কতটুকু সফল না ব্যর্থ এ বিচার করার অনেক পন্ডিত আছেন, কিন্তু সাধারন চোখে বলা যায় সমাজতান্ত্রিক দর্শন- বিশ্ব কে তার নাগরিকের দ্বায়িত্ব নিতে হবে এই চিন্তার বা দ্বায়িত্ব বোধ তৈরিতে অবশ্যই একটা মাইলফলক যা সভ্যতাকে বিকশিত করেছিল।
উপরের ঘটনা বলি বিশ্লেষণ করার আগে রবি ঠাকুরের ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধের একটি বাক্য স্মরণ করি যেখানে লেখক লিখেছেন – “ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষমাত্র, তাহারা বাহ্যলক্ষ্মণমাত্র—মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য ধরে রাখতে চায় বরাবরের মত।
সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পরবর্তী পৃথিবী পুঁজির স্বার্থকেই বড় করে দেখতে দেখতে খোদ আমেরিকা তার নিজের জনগণের জীবন নিয়ে খেলে ফেললো। পৃথিবীর মানুষ যে ভাইরাসটি সম্পর্কে কমবেশি জ্ঞাত বা আগেই জেনেছিল তার পরও প্রতিকারের জন্য উদ্যোগ নেয়নি পুঁজির স্বার্থ বিবেচনা করে। এখনতো ব্যবসা হবে আগে তৈরি হলে এরকম ব্যবসা হতো না।গবেষক বিং লিউের মৃত্যুর পিছনে ও পুঁজির স্বার্থের লড়াই ভুল বলা হল?
উনিশ শতক মানব সভ্যতার বারবার ভাঙা গড়ার সম্মুখীন হয়েছে, ভিন্ন অর্থে বলা যায় আধুনিক সভ্যতার স্বর্ণ সময়। যে সময় অতিক্রম করেছিল দুইটি বিশ্ব যুদ্ধ, অতিক্রম করেছিল অনেক গুলো সংক্রামক রোগ বালাই মহামারি। ক্ষয় জয় ক্ষয়িষ্ণু আবারও ক্ষয় জয় ক্ষয়িষ্ণু মানুষ কে নতজানু হতে শিখিয়েছিল। জাতিসংঘ গঠন ও হয় এই শতকেই। তারপরই আবার শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্নায়ুযুদ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর সভ্যতা তার অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত করতে পেরেছে তবে সে অর্থ কত শতাংশ মানুষের পকেটে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি যোগ হয়েছে মানব জীবনে সেই সাথে মানুষ হয়েছে যন্ত্র।আকাশ চুম্বি আকাঙ্খা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের মগজে তুমি ভালো চাকরি করো ভালো বেতন , ব্যাংক ঋন নেও বাড়ি গাড়ি ক্রয় করো, জীবন শেষে দেখা যাবে সারা জীবন দৌড়ে না জুটলো জীবনের আনন্দ অন্য দিকে ঋনের বোঝা -এই হচ্ছে আজকের শতাব্দী।
উনিশ শতক পৃথিবীকে পুঁজির বিকাশ যতটা না শিখিয়েছিল তার চেয়ে বেশি মানবিকতা দ্বায়িত্ব বোধ শিখিয়েছিল।তাইতো দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ আর কয়েকটি রোগ বালাই মহামারি জয় করে সভ্যতা বিকশিত হতে পেরেছিল। ওই সময় যারা জন্মেছিলেন সাধারণ নাগরিকদের একটি অংশ যারা সারা পৃথিবীতেই সাম্যের জন্য, মানবিক মূল্য বোধের জন্য যার যার অবস্থান থেকে লড়াই করেছিলেন লোভ সংবরণ করে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যবস্হায় যেই থাকুক শাসক গোষ্ঠী চাপে ছিল এই মানবিক দ্বায়িত্ব বোধ সম্পন্ন নির্লোভ মানুষদের দ্বারা পৃথিবী জুড়ে।
এ ধরনের মানুষ সম্পর্কে পৃথিবীতে হাজারো উদাহরণ পাওয়া যাবে। আজকে আমি এমন মানুষের কথা লিখতে চাই উদাহরণ হিসেবে তাদের কথা লেখা আমার দ্বায়িত্বের মধ্যে পরে। ১৯৬৭-৬৯ সাল চিত্তরঞ্জন কটন মিল এবং লক্ষী নারায়ণ কটন মিলের চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ছিলেন কাজী এলহামুল হক। তখন মিল গুলো চলতো কয়লা দিয়ে। ভারতে কয়লা বাইশ টাকা মূল্য হওয়া সত্ত্বেও আশি টাকা করে চীন থেকে কয়লা আনতে বাধ্য করেছিলো তৎকালীন পাকিস্তান(পশ্চিম) সরকার। ফলে মিল গুলোর লাভ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তার উপর বাৎসরিক ট্যাক্সের নামে আয়ের একশত ভাগ যা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেত। ফলে শ্রমিকদের বেতন সংকট দেখা দিত। কাজী এলহামুল হক এই ট্যাক্স তিন ভাগের এক ভাগের দাবি এবং ট্যাক্সের টাকা পূর্ব পাকিস্তানের কোষাগারে থাকবে এই মর্মে পশ্চিম পাকিস্তানের কোর্টে মামলা করেন। মামলায় তিনি জয় লাভ করেন। মামলা চলাকালীন সময়ে কাজী এলহামুল হকের কাছে গোপন প্রস্তাব আসে এই মামলা থেকে সরে গেলে তাকে ঢাকা শহরে ছয়টি বাড়ি প্লটসহ দেওয়া হবে, উল্লেখ্য তখনকার প্লট গুলো কমপক্ষে একবিঘা করে ছিল।
ডাঃ কাজী রবিউল হক, কাজী এলহামুল হকের দ্বিতীয় সন্তান। এমবিবিএস শেষ করে লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার বৃত্তি পেলেন। এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কি হতে পারে জীবনে কিন্তু ডাঃ কাজী রবিউল হক তখন সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকেই বেছে নিলেন, লন্ডন আর যাওয়া হল না কমরেড অনিল মুখার্জির পরামর্শে চলে গেলেন যশোর। বাকি টুকু ইতিহাস, তবুও সংক্ষেপে বলতে গেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ কাজী রবিউল হক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নিজ দলের বাহিরে তার সমসাময়িক যশোরের বহু দলের নেতাদের আদর্শ ছিলেন, অনেকেই তাকে নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন, অনেকেই বলেছেন তিনি ছিলেন নেতাদের নেতা। যশোরের শিল্প সংস্কৃতি বিকাশে তার ভূমিকা বহু দিন যশোরের মানুষের হৃদয়ে থেকে যাবে।
ডাঃ কাজী রবিউল হক আমার পিতা, আর কাজী এলহামুল হক আমার দাদা। উনিশ শতকের সভ্যতা এরকম অসংখ্য মানুষের জন্ম দিয়েছিল বিশ্বময়। তাই সভ্যতা এক মানবিক গুন সম্পন্ন সম্ভাবণাময় সুন্দর সমাজের স্বপ্ন তৈরিতে সফল হয়েছিল মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিলো ত্যাগের মহিমায়। উনিশ শতকের শেষাংশ বিশ শতক বলা চলে পুঁজির নিরাপত্তা ঐতিহ্য সম্বলিত যেখানে মানুষকে একদিকে যন্ত্র বানিয়েছে অন্য দিকে লোভী করে তুলেছে। মূল্য বোধ দ্বায়িত্ব বোধ সম্পন্ন মানুষ আজ অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাইতো বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক ব্যবসায়ীকে, পায়নি মানবিক গুন সম্পন্ন মানুষ কে।
করোনা ভাইরাস পরবর্তী পৃথিবী কি সেই জাগরণ সৃষ্টি করতে পারবে- যেখানে শক্তি সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং শক্তি কে পূণ্যের পথে পরিচালিত করতে পারবে। যে পূণ্য শুধু পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেনা, নিরাপত্তা দিবে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য পরিবেশ প্রকৃতিকে। যেখানে আর বলতে হবে না –
“মাথা পিছু গড় আয় প্রবৃদ্ধি
ভালো ফলাফল পাচ্ছি
কিন্তু মানুষ পাচ্ছি না”।
তথ্য সুত্রঃ বিবিসি বাংলা/ডেইলি মেইল/প্রথম আলো/আনন্দ বাজার/নিউজ ১৮ বাংলা
লেখক : কাজী বর্ণ উত্তম, লেখক ও কলামিস্ট
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ