সভ্যতার ইতিহাস আর রোগ বালাই সংক্রমণের ইতিহাস যেন সমানতালে, সমানতালে আছে যুদ্ধের ইতিহাস। মানুষ যখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি বুঝে ফেললো তখন থেকেই  মূলত গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় তৈরি হতে শুরু করলো। গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সাথে  অন্য গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের দন্দ বা যুদ্ধ ও চলছে সমানতালে। মানুষের পাশাপাশি অবস্থান বা বসবাস থেকেই রোগ সংক্রামকের উৎপত্তি।

মানব সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে  ধীরে ধীরে শহর, গ্রাম গড়ে উঠেছে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েছে ফলে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় সম্ভাবনা ও তৈরি হয়েছে।মানুষ পশুপাখি কে যখন গৃহপালিত করতে শিখলো, তখন সেই গৃহপালিত পশু পাখি থেকেও মানুষ সহজে সংক্রমিত হয়েছে। নগর সভ্যতায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা একটা জটিল কাজ। সেই কারণেও মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করে।অন্য দিকে রাষ্ট্র রাষ্ট্রকে দখলে নেয়।

ইতিহাস বলে প্রায় প্রতি শতাব্দীতে পৃথিবী কোন না কোন ভাইরাসের আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় প্রথমে কোন এলাকা বা জাতি পরে সারা পৃথিবী ব্যাপী মহামারি হিসেবে দেখা দেয়। চল আমরা দেখি পৃথিবীর কত সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন সময় যুদ্ধে এবং মহামারীতে মারা গেছে। প্রতিটি রোগ বালাই বা যুদ্ধ থেকে মানুষ উত্তরণের ভাষা বুঝেছে বিকশিত হয়েছে সভ্যতা।বেশি দূরে না যাই,আঠারো শতক থেকে দেখা শুরু করি,১৮১৭ সাল কলেরা রোগের প্রথম মহামারির শুরুটা হয়েছিল।উৎপত্তি রাশিয়ায়, কলেরায় সারা পৃথিবীর বাইশ–তেইশ লক্ষ মানুষ মারা যায়।

এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী আরও দেড় শ বছর ধরে কলেরা বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিল। ১৮৫৫ সালে প্লেগে পৃথিবীর দেড় কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। যার উৎপত্তি ছিল চীনে।অবশ্য এটাকে তৃতীয় প্লেগ বলা হয়। ১৮৮৯-১৮৯০ সালে রাশিয়ায় উৎপত্তি রাশিয়ান ফ্লুতে তিন লক্ষ ষাট হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।১৯১৪-১৯১৮ প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে মারা যায় আনুমানিক দুই কোটি বিশ্ব লক্ষ মানুষ। ১৯১৮ -১৯১৯ স্প্যানিশ ফ্লু তে আক্রান্ত হয় প্রায় পঞ্চাশ কোটি মানুষ,যদিও উৎপত্তি ছিল চীনে। তখন পর্যন্ত কোন ড্রাগস বা পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়নি।১৯৩৯-১৯৪৫ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ৬-৮ কোটি মানুষ মারা যায়।১৯৫০-১৯৫৩ কোরিয়ান যুদ্ধে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ১৯৫৫-১৯৭৫ ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় সাতচল্লিশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ১৯৫৭ সালে এশিয়ান ফ্লুতে মারা যায় এগারো লক্ষ মানুষ। উৎপত্তি হংকং থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধে মারা যায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ। ১৯৮১ সাল থেকে এইচআইভি ভাইরাসের নাম জানা গেলেও শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। এইচআইভি সংক্রমণ শুরু পশ্চিম আফ্রিকা থেকে, এ পর্যন্ত তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, এখনো পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি।

করোনা ভাইরাস কোনো নির্দিষ্ট ভাইরাসের নাম নয়, বরং এটি ভাইরাসদের এক ফ্যামিলিকে নির্দেশ করে। এই ভাইরাস একটি এক সূত্র বিশিষ্ট আরএনএ নিয়ে গঠিত, যে আরএনএ’র মিউটেশন-এর কারণে করোনাভাইরাস গোত্রের ভাইরাসগুলো প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে ঘটা এই মিউটেশনের কারণে ভাইরাস নিজেকে বদলে ফেলে, সে কারণেই নতুন নতুন মহামারি দেখা দেয়, ২০০২ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৩ সালের জুলাইয়ের মাঝে এই করোনাভাইরাস গোত্রেরই আরেক সদস্য সার্স (সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাস ১৭টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে,  সাতশো চুয়াত্তর জন মানুষ মারা যায়। ২০১২ সালে সৌদি আরব থেকে উৎপন্ন এই গোত্রেরই আরেকটি ভাইরাস মার্স (মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) মধ্যপ্রাচ্যে মহামারী সৃষ্টি করেছিলো। বিজ্ঞানীদের সুত্রে  সার্স ভাইরাসটি ছড়িয়েছিলো বাদুড় থেকে, আবার মার্স এসেছিলো উট থেকে। নভেল করোনা ভাইরাসটি চীনের উহান প্রদেশে একটি পশুপাখির বাজার থেকে ছড়িয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। ২০১৯ এর ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস সংক্রমণে এ পর্যন্ত (০৫/০৫/২০২০)মারা গেছে পৃথিবীতে দই লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশত পঁচানব্বই জন।

ক্যান্সার, এইচআইভি রোগগুলোর সঙ্গে  মানুষ যেমন যুদ্ধ করে বেঁচে আছে তেমনি করোনা ভাইরাসের সাথে ও বিভিন্ন ঔষধ ব্যবহার করে মানুষ বেঁচে থাকবে। প্রতিবছর কলেরা, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া ইত্যাদি প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা, ইনজেকশন ইত্যাদি নেয়, করোনার জন্যও অনুরূপ টিকা বা ইনজেকশন বছর বছর নিতে হবে এবং তা শিগগিরই আবিষ্কৃত হবে বলে আশা করছে বিজ্ঞানীরা,তারা ধারনা করছেন এই বছরই শেষে কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক টিকা বা ইনজেকশন বেরিয়ে যাবে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব হবে। অবশ্য বিজ্ঞানীদের আরেক দল বলছেন কভিড-১৯-এর পর তার একটা সেকেন্ড ওয়েভ আসতে পারে আরো মারাত্মকভাবে। এই ওয়েভ আসার আগে যদি এর প্রতিষেধক আবিষ্কার এবং বিশ্বময় ব্যবহার নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে আরো অকল্পনীয় বিপর্যয়ের জন্য বিশ্ববাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রতিটি রোগ বালাই সংক্রমণের পর বা যুদ্ধের পর শুরু হয় খাদ্য সংকট,শুরু হয় অর্থনৈতিক মন্দা মুদ্রা স্ফীতি, উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান।যাকে বলে সভ্যতার মহামারি -এই মহামারি থেকে বিশ্ব যে খাদ্য সংকটে পড়বে তা থেকে অর্থনৈতিক মন্দার যে ধাক্কাটা আসছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ মন্দা রোধে  এবার তেমন কোনো বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে না।কারণ মন্দা ইউরোপ আমেরিকার মতো বড় দেশগুলোতেই বড় আঘাত হানবে।আইএমএফের মতে এ বছর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ইতালি, স্পেন-সব দেশের জিডিপিই অনেক নিচে থাকবে। ভারত, চীনের জিডিপি জিরোতে না নামলেও থাকবে একদম তলানিতে। ১৯৭৬ সালের পর এবারই চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হবে।

বিশ্ব মন্দার আঘাত বাংলাদেশ অনেকটাই সামলে উঠতে পারবে বলে আশা করা যায়। কারণ এবার শস্য উৎপাদন ভালো হয়েছে। এই আশাবাদ ‘ইকোনমিস্ট’ কাগজেও সম্প্রতি ব্যক্ত হয়েছে। ইকোনমিস্টের জরিপে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংকটে সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে থাকা দশ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।বাংলাদেশের জন্য যে সকল সংকট মোকাবিলা করতে হবে -বহির্বিশ্বে কর্মরত অনেকে কর্ম হারাতে পারেন। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ, বেকার সমস্যা বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি খাতে ধস বড় সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

পৃথিবীতে এমনিতেই ছয় কোটি ৫৬ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া। করোনা-পরবর্তী আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিপরীতে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটার সম্ভাবনা। করোনার ক্রান্তিকাল শেষ হলে লোকেরা নিশ্চিত জীবনের আশায় দেশান্তরী হবে।খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ, শস্য রপ্তানি ইত্যাদি কারণে জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দেবে। দেশে দেশে শরণার্থী শিবিরগুলোয় করোনার কারনে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। ভবিষ্যতে এমন ও হতে পারে দেশে দেশে অভিবাসীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে স্থানীয় জনসাধারণ। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে বিশ্ব পরাশক্তি হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতিতে চীনের বিরুদ্ধে চলমান স্নায়ুযুদ্ধ আরও তীব্র করবে। বিশ্বনেতৃত্বে আগামীতে পরিবর্তন আসতে পারে।বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে কেবল পুঁজির স্বার্থ দেখার দীর্ঘ ঐতিহ্য এবার কেবল নৈতিকভাবেই নয়, কার্যকারিতার দিক থেকেও চ্যালেঞ্জে পড়েছে।

তাইতো বলতে ইচ্ছে করছে –
“একটি অসাধারণ সাফল্যের ঝড় আজ মানব মননে
যে বিতর্ক আলোচনার অঙ্গনকে নিয়ে গেছে
তা ছিল কল্পনাতীত কিছু দিন আগে ও
তা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ”
চল কাব্যিক ভাবেই শেষ করি-
” মননের ঝড় বাহিরের ঝড়
সৃষ্টি হয়েছে এক মহা প্রলয়ের।
প্রলয়ের পর অপেক্ষা করছে নতুন কাব্য
পৃথিবী আবার হবে শান্ত
ছুড়ে ফেলবে পিছনের জঞ্জাল আগাছা
নতুন রুপে ফিরে আসবে সভ্যতা
প্রকৃতি ফিরে পাবে তার প্রাণ
নির্মল বাতাসে আসবে মনের প্রশান্তি
যে ভাবে তুমি বিকশিত হয়েছো অনন্ত কাল”।।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া,ডিজিজ অ্যান্ড হিস্ট্রি,প্রথম আলো,কালের কন্ঠ,বাংলাদেশ প্রতিদিন।

লেখক : কাজী বর্ণ উত্তম, লেখক ও কলামিস্ট
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্‌স নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে