আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সেরা জীব রূপে মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। বনাঞ্চল ও বনজাত গাছপালার দ্বারা ভূমণ্ডলের পরিবেশ ও মনোরম প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্যলীলার মধ্যে বৃক্ষরাজি অন্যতম জীব, যা ছাড়া প্রাণিকুলের জীবন-জীবিকার কোনো উপায় নেই। মানুষ না থাকলে গাছের কোনো অসুবিধা হতো না, কিন্তু বনরাজি না থাকলে দুনিয়ায় আদম সন্তানের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে পড়ত। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে এবং তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদ্গত করেছি নয়নপ্রীতিকর সব ধরনের উদ্ভিদ। আকাশ থেকে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি এবং এর দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি এবং সমুন্নত খেজুরগাছ, যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ।’ (সূরা কাফ, আয়াত: ৭-১১)
বনাঞ্চল না থাকলে প্রাকৃতিক পরিবেশ হয়ে উঠত উষ্ণ, পৃথিবী হয়ে উঠত মরুভূমি এবং মানুষের অস্তিত্ব হতো বিপন্ন। তাই ইচ্ছেমতো গাছ কাটা ও বনভূমি উজাড় করা ঠিক নয়। অবশ্য জ্বালানি, গৃহ, আসবাব নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা মেটাতে প্রতিদিনই গাছ নিধন হচ্ছে; বনাঞ্চল নির্মূল ও উজাড় হচ্ছে। আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আহার, বাসস্থান, নিরাপত্তা এভাবেই বিঘ্নিত। বিশেষ করে জনসংখ্যা প্রতিরোধসহ বনভূমি নিধন না করে বরং এর বিপরীতে বনায়ন সৃষ্টির ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে এবং এখন থেকে সচেতন ও সাবধান না হলে পরিস্থিতি দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। অরণ্য নিধন করে মানুষ ও পশুপাখির জীবনধারণ অসম্ভব। তাই মহানবী (সা.) উর্বর ভূমির সুপরিকল্পিত ব্যবহারে গাছ রোপণ ও বনায়নের জন্য জোরালো তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের রোপিত গাছ থেকে কোনো ব্যক্তি ফল ভক্ষণ করলে তা পরোপকার হিসেবে বিবেচিত হবে, কোনো ফল চুরি হলে তা-ও পরোপকার হিসেবে বিবেচিত হবে, কোনো পাখি যদি ওই গাছের ফল ভক্ষণ করে, তবে তা জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (বুখারি)
প্রকৃতি ও পরিবেশরক্ষায় বনায়নের বিকল্প নেই। আধুনিক সুরম্য অট্টালিকা আর ইট-কাঠের নগরজীবন সত্ত্বেও বনাঞ্চল ছাড়া মানুষের বাঁচার উপায় নেই। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য জীববৈচিত্র্য থাকা অপরিহার্য। পৃথিবীতে লাখ লাখ প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাস হলেও গাছ কাটার কারণে গহিন অরণ্যের জীববৈচিত্র্য লোপ পাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত করার জন্য মানুষই যে একমাত্র দায়ী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছু স্বার্থপর ব্যক্তি বন-জঙ্গল উজাড় করছে। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মানুষের ঘরবাড়ি, চাষাবাদ ও শিল্পায়নের জন্য প্রচুর জমিজমা লাগছে। তাই বন-জঙ্গল কেটে এসব প্রয়োজন মেটানো হচ্ছে। ফলে পশুপাখি অন্ন ও বাসস্থান হারাচ্ছে এবং অন্য জীববৈচিত্র্য লোপ পাচ্ছে। পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা বাড়ছে। ফল-ফসল ও প্রাণহানি ঘটছে। এমন মহাবিপর্যয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক বনায়ন করা দরকার। পবিত্র কোরআনে সতর্ক করা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, ফলে তাদেরকে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা আর-রুম, আয়াত: ৪১)
মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নে সামাজিক বনায়ন ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। সরকারি উদ্যোগ কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়েও বৃক্ষরোপণ ও বনানী পরিচর্যায় সুদৃষ্টি দিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে গাছ নিধন নয়, সৃজনই হোক সবার লক্ষ্য। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহলে সে যেন সেই বিপৎসংকুল মুহূর্তেও তা রোপণ করে দেয়।’ (আদাবুল মুফরাদ)
প্রাণের অস্তিত্বের জন্যই সবুজ বৃক্ষরাজি ও বনায়নের প্রয়োজন অপরিসীম। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে বনায়নের জুড়ি নেই। বনাঞ্চল একদিকে নিসর্গের শোভা বাড়ায়, অন্যদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। বনভূমি বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও শীতল রাখতে সাহায্য করে। যেখানে গাছপালা ও বনভূমি বেশি, সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়। ফলে ভূমিতে পানির পরিমাণ বাড়ে, চাষাবাদ ও ফল-ফসল ভালো হয়। তা ছাড়া গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, ভূমির ক্ষয়রোধ করে। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা প্রতিরোধেও গাছপালা সহায়তা করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় ঠেকাতেও প্রয়োজন ব্যাপক বনাঞ্চল। যাদের অবস্থান এর বিপরীতে, তারা জাতীয় শত্রু। তাদের মূলোৎপাটনে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরি। দেশের প্রায় সর্বত্র বনভূমি জবরদখলের খবর পত্রপত্রিকায় চোখে পড়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব জলাভূমি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ যেকোনো বনভূমি শুধু রক্ষণাবেক্ষণ নয়, সম্প্রসারণও করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করা চাই। মহাবিপর্যয় ও দুর্যোগ থেকে পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায়, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে বনাঞ্চল সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য অক্ষুণ্ন রাখা। এদিকে নজর না দিলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে ওঠার আগে যেখানে সম্ভব বনাঞ্চল তৈরি করতে হবে। অন্যথায় প্রাকৃতিক মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। মোট কথা, প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছাচার থেকে মানুষকে বিরত থাকতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।