বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত জাতিসংঘের একটি আন্তঃসংস্থা নথিতে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে কভিড-১৯ মহামারীর শুরুতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা “সম্পূর্ণ ন্যুজ্ব” হয়ে পড়বে, স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হবেন “ব্যপকহারে”।
জাতিসংঘের ফাঁস হওয়া একটি আন্তঃসংস্থা নথি মোতাবেক, করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রশমন ও অবদমনে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া না হলে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে “৫ লাখ থেকে ২০ লাখ” মানুষের মৃত্যু হতে পারে। “জাতীয় প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা” (সিপিআরপি ভি১) শীর্ষক এই নথিতে এই সংখ্যাকে “ভয়াবহ” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহে ঢাকায় বিদেশী কূটনীতিকদের এই নথিটি দেওয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশ প্রতিনিধি বারদন জং রানা বিষয়টি নিশ্চিত করে নেত্র নিউজকে বলেছেন যে, আমাদের হাতে আসা এই নথি “ডব্লিউএইচও’র নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত আন্তঃসংস্থা নথি। [জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক] এতে সহযোগী হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২৬’শে মার্চের এই নথিতে বলা হয়, “বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যধিক হওয়ায়, বৈশ্বিকভাবে প্রযোজ্য মডেলিং পদ্ধতি ও পরামিতি অনুমান অনুযায়ী, কভিড-১৯ রোগের প্রভাবের পূর্বাভাস হলো, মহামারী চক্রে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটবে। অন্যান্য দেশে ব্যবহৃত মডেলিংয়ের বিপরীতে চিন্তা করলে এই সংখ্যা ও মাত্রা খুব আশ্চর্য্যজনক কিছু নয়। কিন্তু এই সংখ্যা অত্যন্ত ভয়াবহ। এই সংখ্যাকে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো উচিৎ। এই নথির লেখকরা কোনো রাখঢাক করেননি। সরাসরিই বলেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে কভিড-১৯ ভাইরাস কিংবা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত মারাত্মকভাবে অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসা পাবে না। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন যে, “মহামারীর প্রথম দিকেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ন্যুজ্ব হয়ে পড়বে। তারা আরও পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, দুর্বল “সংক্রমণ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ চর্চা, পিপিই’র (পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) অপ্রতুলতা এবং মাধ্যমিক ও পরিণত পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চাপ অত্যাধিক বেশি” হওয়ার কারণে কভিড-১৯ ভাইরাসে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা “ব্যাপকহারে” সংক্রমিত হতে পারেন।
২৬’শে মার্চ ঢাকা বন্ধ করে দেওয়ার আগে শহর থেকে আনুমানিক ৯০ লাখ মানুষকে বের হতে দেওয়ার যেই সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে এই সিপিআরপি নথিতে। এতে বলা হয়, সরকারের ওই সিদ্ধান্তের কারণে “খুব সম্ভবত ঝুঁকিপূর্ণ ও সংক্রমণশীল লোকজন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে… ফলে রোগের বিস্তার আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।” তবে নথিতে এও বলা হয় যে, ঢাকা থেকে লোকজন বের হয়ে যাওয়ায় রাজধানী শহরের ওপর কভিড-১৯ রোগীদের বোঝা হয়তো কমেছে এবং তা দেশজুড়ে বিন্যস্ত হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে কভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা এখনও অজ্ঞাত, “তবে সরকারী প্রতিবেদন, মৌখিক প্রমাণ ও মডেলিং পূর্বানুমান মিলিয়ে এই সংখ্যা বেশি হবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে।” এতে আরও বলা হয়, “স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মাঝে পিপিই’র সরবরাহ এখনও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে।” সন্দেহভাজন ও নিশ্চিত কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় মেডিকেল “স্থাপনাসমূহ সাধারণ অর্থে অপ্রস্তুত, যদিও জাতীয় পর্যায়ে বাছাই করা কিছু স্থাপনায়” সম্প্রতি কিছুটা উন্নতি সাধন করা হয়েছে।
কম্যুনিটি পর্যায়ে সংক্রমণ বিচ্ছিন্ন করা ও স্বাস্থ্য স্থাপনাসমূহ যেন প্রস্তুত হওয়ার কিছুটা সময় পায়, সেজন্য জাতিসংঘের এই নথির লেখকরা একটি অবদমন (suppression) কৌশল অবলম্বনের সুপারিশ করেছেন। “গুরুতর ও মারাত্মকভাবে অসুস্থ কভিড-১৯ রোগীদের ঢল নামবে বলে যেই আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাদের [চিকিৎসার জন্য] স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় পর্যাপ্তভাবে সরঞ্জাম ও বিভিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য বড় আকারের ক্রয়ের প্রয়োজন” মেটাতে তাৎক্ষনিক ৩০০ মিলিয়ন ডলার (২৫৪৫ কোটি টাকা) অনুদান চেয়েছেন তারা।
জাতিসংঘের এই আন্তঃসংস্থা নথিতে উল্লেখ করা হয় যে, শুধুমাত্র “লকডাউন” করে বাংলাদেশে কভিড-১৯ সংক্রমণ খুব বেশি কমানো যাবে না। শুধুমাত্র ভাইরাসের অবদমনই এর সংক্রমণ হার পর্যাপ্তভাবে কমিয়ে মহামারীর প্রকোপকে ভোঁতা করে দিতে পারে।
বাংলাদেশে কভিড-১৯ রোগের বিস্তার অবদমন ও প্রশমনের জন্য ৬-দফা কর্মপরিকল্পনার কথা নথিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এগুলো হলো: অনতিবিলম্বে দেশজুড়ে কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী খোঁজা ও শনাক্ত করা; কভিড-১৯ পরীক্ষা শুরুর জন্য বর্তমানে যেসব পরীক্ষাগার আছে তাদের সামর্থ্য যাচাই করা; জরুরীভিত্তিতে পিপিই, হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মেডিকেল সরঞ্জাম ক্রয় করা; “রোগী অগ্রাধিকার, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও রোগী ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণের লক্ষ্যে” দেশজুড়ে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের প্রশিক্ষণ শুরু করা; কম্যুনিটি পর্যায়ে ঝুঁকি যোগাযোগ; এবং সামাজিক দূরত্ব সংক্রান্ত পদক্ষেপ বজায় রাখতে সচেতনতামূলক প্রচারণা। এই নথিতে যেসব কর্মপরিকল্পনার কথা প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই ব্যাপারে ডব্লিউএইচও’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি বারদন জং রানা নেত্র নিউজকে বলেন, “[কভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে] জিততে হলে আক্রমণাত্মকভাবে ও নিশানা ঠিক করে এই ভাইরাসকে আক্রমণ করতে হবে — নতুন রোগী খুঁজে বের করতে হবে, প্রত্যেক যাচাইকৃত রোগীকে পৃথক করতে হবে, সেবা দিতে হবে, এবং প্রত্যেক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে খুঁজে করে কোয়ারান্টিনে নিতে হবে।” তিনি আরও নিশ্চিত করেন যে, এই কর্মপরিকল্পনা “সরকারের অংশগ্রহণে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও উন্নয়ন আংশীদারদের সঙ্গে যৌথভাবে” প্রস্তুত করা হয়েছে।
জাতিসংঘের এই নথিতে আরও বলা হয়, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্কুল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণ দেশজুড়ে বন্ধ করা সহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমন্বিত প্রভাবের কারণে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কভিড-১৯ রোগের বিস্তারের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকবে।
সম্প্রতি, নেত্র নিউজ একদল বাংলাদেশী ও যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষকদের পূর্বাভাস নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে কভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে ৫ লাখের মতো মানুষ মারা যেতে পারে। তবে জাতিসংঘের এই আন্তঃসংস্থা নথিতে সর্বোচ্চ ২০ লাখ মানুষ কখন মারা যেতে পারেন, সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হয়নি।/ নেত্রনিউজ থেকে
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ