ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষায় ঢুকে পড়েছে উদ্ভট উদ্ভট শব্দ। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা এসব শব্দের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তারা শব্দগুলো সংগ্রহ করেছে পত্রিকাটির পাঠকদের কাছ থেকে। এসব শব্দ দেখে স্পষ্ট বুঝা যায় পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা অনেকটা বিকৃতির দিকে চলে যাচ্ছে। এর পেছনে বাংলিশ, হিংলিশ ও মিডিয়ার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে।
এমনিতেই বলা হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা মূলত ব্যবহৃত হয় তিন জায়গায়। আড্ডায়, মদের ঠেকে ও মিডিয়ায়। ব্যক্তিজীবনে কলকাতা শহরের মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাকিরা উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলে।
তার-কাটা: দোকানে ক্যাশে বসে আছি। এক সহকর্মী অন্য এক জনকে ভুল শোধরানোর জন্যে বলল, ‘আরে তার-কাটা, মালটা দেখে দে।’ সিরিয়াল দেখছি, হঠাৎই বামাকণ্ঠে উচ্চারিত হল, ‘ওই তার-কাটা তোমার বন্ধু?’ নড়েচড়ে বসলাম। না, এ বার এর ঠিক মানেটা উদ্ধার করতেই হবে। নেড়েঘেঁটে বুঝলাম, এর অর্থ হল ছিটিয়াল। মানে, মাথার মেশিনে কোনও তার কেটে গেছে। ভালবেসে ফেললাম শব্দটাকে। টুকটাক ব্যবহার শুরু করলাম। বউ এক দিন বলল, তোমায় তো কোনও দিন রিকশওয়ালার ভাষায় কথা বলতে শুনিনি। মদন রিকশওয়ালা খুব ‘তার-কাটা’ বলে। সে দিন বলল, জানলেন দিদিমণি, জামাইটা তার-কাটা। নাতনিসুদ্ধ মেয়েটাকে আমার বাড়ি রেখে ভেগেছে।
ছ্যাকাট: ছোটবেলায় স্কুলে হপ্তাখানেক ছুটি মানেই মামার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ছিল বাঁধাধরা। দাদু-দিদা ও-পার বাংলার। ঘরে সকলে বাঙাল ভাষাতেই কথা বলে। কোমর সমান পাঁচিল দেওয়া একটা একতলার ছাদ ছিল আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। গলির ও-পারে বেশ কয়েকটি পঞ্জাবি পরিবার একটা বিশাল বাড়িতে একসঙ্গে থাকত। সে বাড়ির গন্ডাখানেক পুত্তর-এর সঙ্গে এ-পাশের বাঙাল বাড়ির কিশোরীদের হামেশাই চোখ বিনিময় হয়ে যেত। তেমনই এক গাব্রু জোয়ান, সে বার তুখড় গ্রীষ্মের দিনে, অষ্টম শ্রেণির এই কিশোরীর দর্শন-প্রেমে ওই পঞ্জাবি-বাড়ির ছাদে চিরস্থায়ী খাটিয়া পাতল। চলছিল বেশ। এক দিন দুই ছাদের বিনিময় দিদার চোখে পড়ে গেল। কারনিসের ধারে, আমাকে কান ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে, ‘ওই ছ্যাকাট-টারে এত দ্যাখনের কী আসে রে!’ বলে চোখ-পাকানি। বুঝলাম, আশপাশ সম্পর্কে অসচেতন হয়ে, অন্যকে হাঁ করে দেখে যে, তাকে ‘ছ্যাকাট’ বলে। এখনও যদি এক-আধটা এমন চোখ নজরে আসে, বোনেরা একসঙ্গে থাকলে ‘দ্যাখ দ্যাখ, ছ্যাকাট’ বলে তার সামনেই মজা করি, সে কিচ্ছু বুঝতে পারে না!
হ্যাল: স্কিন যেন মাখন, নরমে-গরমে শরীর। জেব্রা ক্রসিং পেরিয়ে সে আসছে আমার দিকেই। আমি নিথর। দূরত্ব কমছে। হঠাৎ কানে এল ‘হ্যাল দিয়েছিস তো!’ ‘হ্যাল’টা আবার কী! এটা বিশেষণ? মানে, মেয়েটির রূপের গুণগান? তা-ই হবে। তার বন্ধুই এ কথা বলল যখন। শপিং মলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, শুনলাম, ‘নিউ হেয়ার কাট, চোখে লেন্স, ফুল হ্যাল প্যাকেজ মাইরি।’ হ্যাল মানে কী? যা দেখে মনে হচ্ছে, বাস্তব নয়, হ্যালুসিনেশন? যা নেশা ধরিয়ে দেয়? আমিই ভাবছি বলব, ‘ফিতুর’-এর গানগুলো পুরো হ্যাল!
পেট বানানো কথা: ছোটবেলায় অনেক শুনেছি বাড়িতে— মা-কাকিমাদের মুখে। কেউ মিথ্যে বলে ধরা পড়ে গেলে, অথবা মিথ্যে বোঝা গেলে, তাঁরা বলতেন, ‘পেট বানানো কথা বলিস না তো’, বা ‘এত পেট বানিয়ে কথাও তুই বলতে পারিস!’ বন্ধুরা আমাদের বাড়ির এই কথাটা নিয়ে অশ্লীল ইয়ার্কি মারত, ‘এই, তোরা দিনে কত বার পেট বানাস রে?’ আমি বোঝাতাম, পেট বানিয়ে কথা বলা মানে ‘গুল মারা’। যে কথার উৎপত্তি পেটে, মাথায় নয়। মিথ্যে কথা লোকে মাথা খাটিয়ে বললেও তার ঠাঁই ঠিক ‘সত্যি’র কাছাকাছি নয়, অনেকটা নীচে। তাই মাথা থেকে নেমে এসেছে পেটে।
কাটার কাপ: মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমায় আমার বাড়ি। ছোটবেলা থেকে শুনেছি, কেউ কোনও অদ্ভুত আচরণ করলে বা উদ্ভট পোশাক পরলেই সবাই বলত ‘কাটার কাপ’। গ্রামের দিলীপদা অদ্ভুত অদ্ভুত পোশাক পরত। কখনও হাফ প্যান্ট, খালি গা, পায়ে মোজা, মাথায় টুপি। কখনও ধুতি, গলাবন্ধ কোট, চোখে রোদ-চশমা, মাথায় গামছা। আমার মা, বড়মা-রা ওকে এই ধরনের পোশাকে দেখলেই বলত ‘কাটার কাপ’। গ্রামের পাঁচু পাগলা তার ছাগলছানাটাকে মাথায় নিয়ে যখন নাচ দেখাত, অঙ্গভঙ্গি দেখে অনেকে বলত ‘কাটার কাপ’। আমার ছোটভাই টিভি-তে ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে যে-সব ফিল্ডার মুখে সাদা দুধের মতো ক্রিম মেখে থাকত, ওদের দেখলেই বলত, ‘কাটার কাপ’!
ঝাপসা: নাটক-সিনেমা-সিরিয়ালে পরিচালনার কাজে যুক্ত আছি। এক দিন শুটিং-ফ্লোরে, আমার এক সহকারী এ কথাটা অদ্ভুত ভাবে ব্যবহার করল। এক অভিনেতা অনেক বারের চেষ্টাতেও একটি দৃশ্যে ঠিক মতো অভিনয় করতে পারছেন না। যখন আমরা ইউনিটের প্রত্যেকেই বিরক্ত, সহকারীর মুখ থেকে আলটপকা বেরিয়ে এল, দাদা, এ তো পুরো ‘ঝাপসা’, একে দিয়ে হবে না।
ডিসপ্লে: সে দিন বসের ঘরে ঢুকেছি। স্যর গুম মেরে বসে আছেন। কপালে কালশিটে, নাকের ডগা ছুলে গেছে। দু’গালে আঁচড়। ফাইল রেখে চলে যাচ্ছিলাম। তার পর জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘স্যর, আপনার মুখের অমন দশা কেন? পড়ে গিয়েছিলেন নাকি?’ শুনে স্যর খিঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘আমার ডিসপ্লে-ডুসপ্লে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি আপনার ডিসপ্লে নিয়ে মাথা ঘামান।’ স্যরের কথাটা মাথায় স্পার্ক করল। অফিসের কলিগদের বললাম, আজ বসের মেজাজ সপ্তমে। ডিসপ্লে পালটে বসে আছেন। অফিস চত্বরে শব্দটা এখন আমরা খুব বলি। ক’দিন ধরে ডিসপ্লে দেখাও না, থাকো কোথায়? বা, ডিসপ্লে মনমরা, শরীর খারাপ নাকি?
বুংচাং: আমার এক সহপাঠীর ভোরে ম্যাচ থাকায় অসমাপ্ত ঘুমটা তাকে ক্লাস চলাকালীন লাস্ট বেঞ্চেই লুকিয়ে সারতে হয়েছিল। ক্লাস শেষ হতে চোখ রগড়ে আমায় বলল, ‘তোর খাতাটা দে তো, ঘুমের ঘোরে কী সব বুংচাং শুনছিলাম।’ প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষার দিন অনীককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে, ভাইভা কেমন হল?’ ‘ভাল’ বলে কলার তুলে অনীক চলে যাবার পরই মেঘনা ফাঁস করল, ‘ধুর, লবডংকা। আমি আড়ি পেতে শুনেছি, কী সব বুংচাং উত্তর দিচ্ছিল।’
অস্টা: ছোট থেকেই বাড়ির লোকেদের মুখে ও স্যরেদের মুখে শুনে আসছি। বোধহয় এর মানে ‘বিরক্ত’, বা ‘বিরক্তিকর ব্যাপার।’ এক দিন টিউশনে একটা বিষয় নিয়ে বলে উঠলাম, ‘এ রকম করলে কার না অস্টা লাগে?’ সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। আর এক দিন টিউশনে স্যর পরীক্ষা নিচ্ছেন। অনেকেই স্টেপ্লার নিয়ে যায়নি। স্যর তাদের খাতা নিজের স্টেপ্লার দিয়ে স্টেপ্ল করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমার এক বন্ধু স্যরকে খাতা দিতে ভুলে গেল। পরে যখন অর্ধেক পরীক্ষা হয়ে গেছে, তখন বলল, ‘স্যর, আমার স্টেপ্ল করা হয়নি।’ স্যর বললেন, ‘উফ, অস্টা-টা দেখতে পারিনে।’
ফুলটুস: শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম মেয়ের এক বন্ধুর কাছে। ছেলেটি বলেছিল, ‘কাকিমা, আজ একটা ফুলটুস সিনেমা দেখলাম।’ তার পর থেকে আমি শব্দটার যথেচ্ছ প্রয়োগ শুরু করলাম। শ্রদ্ধেয়া বউদিদের সাজগোজ থেকে শুরু করে আমার ছাদের বাগানের ফুল— সবেতেই ওই একটি শব্দ ব্যবহার করে অসাধারণ ফল পেয়েছি। কোনও ভাল জায়গায় বেড়াতে গেলে বলতাম ‘ফুলটুস’ জায়গা। সবাই বুঝত। যখন প্রায় পেটেন্ট নেব ভাবছি, তখনই শব্দটির ব্যবহার আমায় বন্ধ করে দিতে হল। কেননা, এখন ওই সব তেল-টেলের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকছে ‘ফুলটুস মস্তি’।
ঝিংকু: ‘পাগলু ২’ দেখতে গিয়ে হিরোর সংলাপে শব্দটা শুনে থমকে গেলাম। নায়ক একটা মেয়েকে বলছে, ‘তোমাকে দেখতেও ঝিংকু’! রূপের স্তুতিতে এমন একটা শব্দ বিশেষণ হয়ে বসতে পারে! তবে কোনও এক সভায় টলি-সুন্দরীদের দেখে তাঁদের ‘ঝিংকু মামণি’ বলে ডেকে, মীর খামকা তাঁদের বিরাগভাজন হয়ে পড়লেন কেন, বুঝিনি।
হ্যান্টাই: ‘ফুলগুলো হ্যান্টাই ফুটে আছে।’ মানে? বন্ধু বলল, ‘মানে আর কী, এখানে কেউ ওদের দেখবে না, কেউ শুঁকবে না, তবে ফুটে কী লাভ?’ চাকরিসূত্রে তখন সবে এসেছি মালদায়। রাস্তায় জটলা, সবাই উৎসুক কী হয়েছে দেখতে, এমন সময় পাড়ার মাতব্বরের বাজখাঁই হাঁক- ‘হ্যান্টাই দাঁড়িয়ে ভিড় করবেন না তো, যান নিজের কাজে…’ ভাড়া নিয়ে দরাদরি, তাতে দাঁড়ি টেনে রিকশওয়ালার সোজাসাপটা জবাব— ‘সক্কাল সক্কাল হ্যান্টাই ঝামেলা করবেন না…’ ‘খামকা’ বলার চেয়ে, ‘হ্যান্টাই’ বলায় ঝাঁজ কত বেশি!
কিচাইন: অনেকে একে ‘কেলো’-র প্রতিশব্দ বলে মনে করেন, কিন্তু ‘কিচাইন’-এর গভীরতা বা ব্যাপ্তির কাছে ‘কেলো’ দাঁড়ায় না। বাচ্চাকে কাজের লোকের জিম্মায় রেখে সস্ত্রীক ‘দিলওয়ালে’ দেখতে যাবেন, এ দিকে ছেলে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। স্ত্রী বলবেন, ‘যাবে কি আর? বাপি বড় কিচাইন করছে।’ আগের দিন সবজিওয়ালা আপনাকে কানা বেগুন গছানোয় আপনি তাকে ঝাড় দিলেন। পাশের লোক বলবেন, ‘এত কিচাইন কীসের?’ তবে কিচাইন বললে যে শুধু অসুবিধা বা ঝামেলাই বোঝায়, তা নয়। দৌড় প্রতিযোগিতায় বটতলার অরুণ অনেক পদক জিতেছে। বন্ধুরা বলবে, ‘অরু মাইরি কিচাইন করে দিয়েছে। থ্রি চিয়ার্স ফর অরু, হুহা-হুহা-হুহা।’
চাটা: বাক্যবাণে কাউকে বিদ্ধ বা অপদস্থ করাও যে আসলে ‘চাটা’, জানলাম কলেজে গিয়ে। সিনিয়র দাদারা র্যাগিং করলে সেটাও ‘চাটা’, আবার প্র্যাক্টিকালে প্রোফেসরদের কঠিন প্রশ্নবাণের কোমল স্পর্শও ‘চাটা’। এখন অফিসে পেট গুড়গুড় করে, যেই শুনি, লন্ডন থেকে ক্লায়েন্ট আসছে, খুব কড়া ধাতের মানুষ, প্রেজেন্টেশনের পর নাকি গুছিয়ে চাটবে সবাইকে ধরে ধরে!
জাউখাউ: ঘর মুছতে মুছতে মাসি বলল, ‘হাজার টাকা হইব তোমার কাছে?’ মিউমিউ করে বলি: ‘গেল মাসেও তো অ্যাডভান্স নিলে।’ ‘আমি তো ধার চাই নাই। মাইনা নিয়া যদি ধার নিতাম, তাইলে তো জাউখাউ বাজবো।’ ‘জাউখাউ’? বুড়িকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, এর মানে: উলটোপালটা, মাথামুন্ডুহীন। স্বামীকে বলতেই সে বলল: ‘এ তো চালু শব্দ আমাদের ক্লাবে। কেউ ফালতু বকলেই আওয়াজ যায়, জাউখাউ বকিস না।’
হেয়ার ক্র্যাক: রতনমামার চায়ের দোকানের আড্ডায় কেউ একটু উদ্ভট কিছু বললেই মামা বলে, আপনার কি একটু ‘হেয়ার ক্র্যাক’ আছে? প্রায়ই কিছু খদ্দের হাফ-কাপ চা নিয়ে কোটি কোটি টাকার আলোচনা করে, আর উঠে যাওয়ার সময় দামটা খাতায় লিখে রাখতে বলে। তখনই রতনমামা রেগে বলে, হেয়ার ক্র্যাক! সে দিন এক বয়স্ক খদ্দের মামাকেই বলে ফেললেন, ‘তোরও কি একটু হেয়ার ক্র্যাক আছে?’ কারণ, মামার দোকানের খাস্তাগজার সাইজ এত ছোট হয়ে গেল কেন, তার উত্তরে মামা বলেছিল, ‘নতুন প্লেট আনিয়েছি বড় সাইজের, তাই গজা ছোট দেখাচ্ছে।’
স্যাটি: গাঁজার কলকেয় টান মেরে হালকা ধোঁয়া ছেড়ে অভীক বলল ‘স্যাটি’। পরের টান শুভেন্দুর। ও চোখ বুজে বলল: ‘স্যাটি, গুরু, স্যাটি।’ রণজয় পর পর দুটো টান মেরে লাল চোখে বলল: ‘দারুণ টুল্লি হয়েছে। স্যাটি লাগছে।’ এ বার আমার পালা। আমিও কেতা করে কলকেটা ধরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, ‘স্যাটি, স্যাটি।’ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, আমাদের কলেজজীবন তখন মাঝ আকাশে। বন্ধুদের সঙ্গে কলকে নিয়ে বসেছি ‘তিন টানেতে রাজা-উজির, চার টানেতে সুখী’ হবার জন্য। কিন্তু মাথার ভিতর ঘুরছে ওই ‘স্যাটি’। মানে জানি না। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলে প্রেস্টিজ যাবে। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘বন্ধুগণ, আমি গার্লস হস্টেল চললাম।’ হস্টেল থেকে বান্ধবীকে নিয়ে, পাশের মাঠের বিশাল অশ্বত্থ গাছটার নীচে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যাটি মানে কী রে?’ ‘এটাও জানিস না! থার্ড ইয়ারে পড়ছিস! স্যাটি হল স্যাটিসফ্যাক্টরি-র শর্ট ফর্ম। কোনও কিছু করে ভাল লাগলে সবাই স্যাটি বলে।’ শুনে ওকে জড়িয়ে ধরে দু’গালে দুটো চুমু খেয়ে বললাম, ‘তোকে পেয়ে আজ জীবন খুব স্যাটি লাগছে।’ ও-ও আমায় জড়িয়ে ধরে মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে হেসে বলল- ‘চুলের যত্ন নে পাগলা। যে-ভাবে উঠে যাচ্ছে, পাঁচ বছর পর কিন্তু মাথাজোড়া স্যাটি টাক পড়ে যাবে।’
পেগ্লে যাওয়া: শুনেছিলাম স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে পুরুলিয়ায় নেচার ক্যাম্পে গিয়ে। তাঁবুতে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ এক বন্ধু চরম অপ্রাসঙ্গিক কিছু একটা বলে হা-হা করে হেসে উঠল। ব্যস, সব্বাই মিলে বলল ‘পেগ্লে গেছিস নাকি?’ আশ্চর্য হলাম, মজাও পেলাম। পাগলামি করার চেয়ে পেগ্লে যাওয়ার মধ্যে মজা অনেক বেশি।
ক্যালালে ক্যালাব: টিফিনে দুই বন্ধুর ঝগড়া হচ্ছে। এক জন আর এক জনকে বলছে, ‘তুই বেশি পেঁয়াজি করবি না। বহুত ক্যালাব।’ শুনেই ফিক করে হেসে ফেলেছিলাম। পর ক্ষণেই আমার উদ্দেশে ভেসে এল, ‘এই যে, তুমি দাঁত ক্যালাচ্ছ কেন? তোমাকেও ক্যালাব।’ একই শব্দ পর পর দুটো আলাদা অর্থে কেমন প্রয়োগ করা হল! প্রথম ক্যালানো মানে ‘পেটানো’, দ্বিতীয়টি অকারণে দন্ত বিকশিত করাকে ইঙ্গিত করছে। আবার দেখি, উৎপল দত্ত বলছেন, ‘দাঁতক্যালানে বাঞ্ছারাম!’ বন্ধুরা বলছে ‘আতা ক্যালানে’। আতা-র সঙ্গে সাদা দাঁতের কোথাও মিল আছে? হঠাৎ বাঞ্ছারাম কেন? ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবির পর কি এর উদ্ভব? এ ছাড়াও ইংরাজি ‘ক্যালাস’-এর সূত্র ধরে ‘ক্যালানে’ শব্দের মানে করা হয় ক্যাবলা। কে জানে, এমন দিন আসবে কি না, যখন ক্যালকাটার লোক দেখলেই ধোপদুরস্ত মুম্বই-বেঙ্গালুরুওয়ালারা ‘ক্যালানে’ ডেকে বসবে!
কলে বাটি: সাতসকালে কড়া নাড়ার শব্দ। গৌতম। হাতে নিজের পুকুরে ধরা জ্যান্ত বাটা, পুঁটি, কুচো চিংড়ির পলিথিন ব্যাগ। আহা, লাউ-চিংড়ির ইচ্ছেটা অনেক দিনের! গিন্নি উৎসাহে জল ঢেলে চড়া গলায় বললে: ‘কলে বাটি! শুধু লাউ নয়, তেল-মশলা- সবই চাই।’ সঙ্গে আরও চোখা বাক্যবাণ। হঠাৎ দরজা ঠেলে কলেজপড়ুয়া শ্যালিকাপুত্রর প্রবেশ। বললাম, ‘আর একটু আগে এলি না বাপধন, এক জন দেবীর দুর্দান্ত রূপ দেখাতাম!’ ও বলল, ‘সে তো আমি তোমাকে দেখাতুম। কিন্তু কলে বাটি। আমাদের জাঙ্গিপাড়ায় সাতাশ ফুটের সরস্বতী ঠাকুরে ঝামেলা করে দিল!’ বাজারের পথ ধরলুম। রাস্তায় নেদোর প্রশ্ন, ‘হনহনিয়ে চললে কোথায়?’ ‘বাজারে।’ হে-হে করে হেসে বললে, ‘কলে বাটি। ফুলওয়ালির অকালমৃত্যুতে আজ শোক দিবস, বাজার বন্ধ।’
হুকেল: তদানীন্তন বিদ্যুৎ পর্ষদ কর্তৃক প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম শারদ পত্রিকায়। তা হল, সিঁদ কেটে যারা চুরি করে, তাদের বলা হয় সিঁধেল, আর হুক করে যারা বিদ্যুৎ চুরি করে, তাদের বলা যেতে পারে ‘হুকেল’। এদের শনাক্ত করুন বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে অথবা ট্রান্সফর্মার পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে।
অসা: আমার হাতের লেখা ভাল নয়। কলেজের এক জন আমার লেখা প্রশ্নপত্র দেখে হেসে বলে উঠল, ‘অসা!’ ঠিক তখনই আমার আর এক সহকর্মী ইন্দ্রাণী সেন ঘরে ঢুকলেন এবং তাকে দেখেও সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কী লাগছে তোমায় দেখতে— অসা!’ বুঝলাম, এই তাড়াহুড়োর জমানা ‘অসাধারণ’-এর শেষ তিনটি অক্ষর আর ধারণ করার প্রয়োজন বুঝছে না।
প্রেমকু: মহা হুল্লোড়ে রাতের মেস যখন জমজমাট, তখন আমার রুমমেট পরাগকে দেখতে না পেয়ে তপনদা বলে উঠল, ‘আরে প্রেমকুটা কোথায় গেল?’ প্রেমকু! তার মানে? ‘আরে, তুই জানিস, ছেলেটার কাছে দিন দিন কত মেয়ে আসে? এমনি এমনি কারও কাছে মেয়ে আসে না। প্রেমকু হতে হয়। বুঝলি?’ বুঝলাম, প্রেমকু মানে শুধু প্রেমিক নয়। ওর মধ্যে একটু ‘কু’-ও আছে, মানে প্রেমের ফাঁদ পাতার ক্ষমতা। আবার, ঘন ঘন প্রেমে পড়ে যাওয়ার অভ্যাস। অচিরে পাশের মেসের দীপককেও ‘প্রেমকু’ অভিধা দেওয়া হল। কারণ চোখে-মুখে তার সর্বদাই কবি-কবি ভাব, মেস-পাড়ার দোলা আর রূপার প্রকৃত প্রেমিক সে-ই, ভেবে কত কবিতা যে লিখেছিল, ইয়ত্তা নেই।
চুনিয়া মুনিয়া: সবে সন্ধে নেমেছে। কাছেই গড়িয়াহাট মোড়। ব্রিজের দিকে এগিয়ে আসছেন এই শহরের নানা বয়সের সেরা সুন্দরীরা। শাড়ি-সালোয়ার কামিজ-টপ স্কার্ট-টি শার্ট ট্রাউজার্স। পাঞ্জাবি গায়ে ছেলেদের এক জন বলল, ‘উঠবে?’ ‘ট্রাই কর। তবে চান্স কম’, অন্য জন জবাব দিল। তৃতীয় ছেলেটি বলল, ‘ছেড়ে দে, চুনিয়া-মুনিয়া।’ পরে নন্দন চত্বর, মেট্রো স্টেশন, শহরের ফুটপাতে ছেলেদের মুখে চুনিয়া-মুনিয়া অনেক বার শুনেছি। যার তর্জমা, আমার মতে, অপরিণত কিশোরীর দল, যারা এখনও ঠিক প্রেম নিবেদনের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি।
চুমাচাটি: ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। দমদমে আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছি। সন্ধ্যার মুখে বাবুঘাট থেকে ৩০ডি বাসে উঠতাম। ঘন গাছেদের ফাঁকে একটা জায়গায় জোড়ায় জোড়ায় অনেক যুবক-যুবতী বৃত্তাকারে বসত। তাদের ঘিরে দেহাতি লোকেদের আর একটা বৃত্ত হত। কী ব্যাপার, জিজ্ঞাসা করায় চা-ওয়ালা বলল, ‘ছোকরা-ছুকরি এইখানে আইস্যা চুমাচাটি করে আর এই দেহাতি লোকগুলি বাড়িতে বউ ফেলাইয়া আইছে, অহন এই দেইখ্যাই সুখ করে।’ বুঝলাম, একটা সামান্য আবডালে যুবক-যুবতী চুম্বন-আলিঙ্গনে দেহ-মনের ভাব বিনিময় করে, তারই নাম ‘চুমাচাটি’। প্রেম করার শখ আমারও ছিল। কিন্তু রোগাভোগা বাঙালকে কেউ পাত্তা দেয়নি। বিয়ের পর বউকে নিয়ে বাবুঘাটে এক দিন প্রেম করার জন্য বসেছিলাম, কিন্তু লজ্জায় অমন খোলা জায়গায় ‘চুমাচাটি’ অবধি এগোনো গেল না।
খোঁচড়: খোঁচড়-এর জন্ম ১৯৬০-এর শেষ এবং ’৭০-এর প্রথম পর্বে। যখন কলকাতা উত্তাল, উত্তেজিত, উদ্বেলিত, তখন জন্ম নিল খোঁচড়। সময়ের অব্যর্থ শব্দফসল। সমস্ত ক্ষণ কলেজপাড়া উত্তাল। পুলিশের তাড়া, মানুষের দৌড়, ছাত্রদের অবরোধ, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ, বোমা-পিস্তল, কলেজ স্কোয়্যার, বইয়ের দোকান, ভবানী দত্ত লেন, ট্রাম-বাস পুড়ছে, উৎপল দত্তর ‘ব্যারিকেড’, বিদ্যাসাগরের মর্মর মূর্তি এবং কফিহাউস, আমাদের হাতে ফাইটিং ভিয়েতনাম, স্কুল-কলেজ বয়কট— এই রকম ঐতিহাসিক সময় বোধহয় মর্কট লগ্নে ‘খোঁচড়’ অর্থাৎ পুলিশের ইনফর্মার-এর কু-নাম জন্মাল। এবং তার সঙ্গে যুক্ত হল চন্দ্রবিন্দু। অভিধান অনেকক্ষণ ধরে খোঁচাখুঁচি করেও ওই খোঁ-তে এসেই দাঁত খিঁচিয়ে থামতে হল। শব্দটি কিন্তু বিনা বাধায় জনগণের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
হুব্বা: সে দিন শুনি, এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলছে, ‘আরে, তুই এত সহজে হুব্বা হয়ে যাস না…আমি তো ইয়ার্কি মারছিলাম বাবু।’ তার পর এক দিন মোকাম্বো-তে বসে লাঞ্চ খেতে খেতে শুনলাম দুই ছাত্রের কথোপকথন: ‘আরে পাগলা, বাবাকে একটা কিছু বানিয়ে বলে দিবি, চিল্ ব্রো, এত সহজে তুই হুব্বা হয়ে যাস না!’ এমনকী এক দিন কলেজে শুনলাম, এক ছাত্র অন্য এক প্রেম-বিচ্ছেদে বেদনার্ত বন্ধুকে ধমকের সুরে বোঝাচ্ছে, ‘করো…আরও হুব্বামো করো, এ রকম করেই পাখি উড়ে পালাবে, বুঝলে?’ বোঝাই যাচ্ছে, কথাটার মানে হল, বোকা বনে যাওয়া বা ভেঙে পড়া।
হ্যাঁত-ক্যাঁত: কলিগ প্রায়ই বলে, ‘আমার বরের হ্যাঁত-ক্যাঁত বলতে কিছু নেই। দোকানদার যেমন মাছ গছিয়ে দেয়, তেমনই আনে।’ প্রথম প্রথম অবাক হলেও, এখন দিব্যি মানে বুঝি। আমি বলি, ‘কোনও বরেরই কোনও দিন হ্যাঁত-ক্যাঁত বলে কিছু ছিল না।’
ফুট: ধন্যবাদ ‘জলু’কে। মানে, জলপাইগুড়ি গভঃ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-কে। জলুর ভাষাটাই ছিল বিচিত্র নতুন শব্দের সম্ভার। তারই একটা, ‘ফুট খাওয়া’— মানে ‘বাড় খাওয়া’ বা ‘তোল্লাই খাওয়া’, কিন্তু ফুট খাওয়ানো সব সময় ক্ষতিকারক নয়। ভাল-ফুট হয়, বাজে-ফুটও হয়। বন্ধুদের ফুট খেয়ে আমরা প্রেমে পড়ি, বাবা-মা’র ফুট খেয়ে বিয়ে করি, বিবেকের ফুট খেয়ে মোমবাতি মিছিলে হাঁটি, আবার অপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনি বিজ্ঞাপনের ফুট খেয়ে। নিজে নিজে ফুট খাওয়া হল অটো-ফুট।
খনি: কলেজে এই শব্দটা চলত। মানে, ‘রত্নভাণ্ডার’। কেউ কোনও সাবজেক্টে ভীষণ ভাল, অন্যরা নাকানি-চোবানি খাচ্ছে, ইয়ার ব্যাকের ভয় পাচ্ছে, তারা ভাল ছেলেটিকে ইঙ্গিত করে বলবে, ‘ও তো খনি রে, ওর পেছনেই বসতে হবে।’ পরে দেখেছি, এর ঠিক উলটো অর্থে, ‘অপদার্থ’ হিসেবেও প্রয়োগ হচ্ছে ‘খনি’র। যে ফিল্ডার লোপ্পা ক্যাচ ধরতে পারে না, সে পুরো ‘খনি’! তেমনই, যে বোলার বেদম পেটানি খায়, তাকে দুয়ো দেওয়া হয়, ‘কী খনি মাইরি’! মানে, ব্যাটসম্যান এদের কাছ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি রত্ন (রান) পাবে।
চপ্সি: মফস্সল থেকে প্রথম কলকাতার কলেজে পড়তে এসেছি। কাউন্সেলিং-এর দিনেই আমারই সহপাঠী ঈপ্সিতার হেব্বি পছন্দ হয়ে গেছে থার্ড ইয়ারের একটা হ্যান্ডসাম দাদাকে। এক সপ্তাহ পর ‘ইন্ট্রো সেশন’। ঈপ্সিতাকে মামুলি কয়েকটা ‘নন-ভেজ’ প্রশ্নের পর বলা হল, আমাদের সহপাঠী অনীকের সঙ্গে ডিস্কো ড্যান্স করতে। কে ওকে এটা করতে বলল? ওর সেই হার্টথ্রব দাদা-ই! ঈপ্সিতার মুখ লাল। হঠাৎ অনীক ডায়াস থেকে নেমে দাদাটির কাছে গিয়ে বলল, ‘দাদা, ঈপ্সিতার পার্টনার একমাত্র তুমি-ই হতে পারো।’ ওর দিকে তাকিয়ে ঈপ্সিতা চেঁচিয়ে উঠল, ‘দিলি তো আমার চপ্সি করে!’ জীবনে কখনও কথাটা শুনিনি, পরে বুঝলাম, ওর মানে, কাউকে বিচ্ছিরি ভাবে অপ্রস্তুত করা। তবে অনীক ঈপ্সিতার চপ্সি করে ভালই করেছিল। তিন দিন পরেই দেখি, ঈপ্সিতা আর দাদাটা বসন্ত কেবিনে চপ খাচ্ছে।
চব্ব: গিয়েছি হরিদ্বারে। বাঙালি দেখলেই বাঙালির স্বভাব গুছিয়ে অথবা গায়ে পড়ে গল্প করা। আর বলবেন না দাদা, কী ‘চব্ব’! আমাদের ট্যুর অপারেটর বলেছিল, আজ রাত্রে ডিমের ঝোল খাওয়াবে। এই নিরিমিষ জায়গায় তাতে যে এত ‘চব্ব’ হবে, কে জানত! পরে নানা জায়গায় শুনে বুঝেছি, ‘ঝামেলা’ বোঝাতে ‘চব্ব’ ব্যবহার হয়।
নোংরা: এনআইটি দুর্গাপুরে পড়তে এসে প্রথম যে শব্দটা শুনে বিস্মিত হলাম: ‘নোংরা’। মানেটা পুরো উলটো। অসাধারণ রেজাল্ট, ভীষণ সুন্দর জামাকাপড়, ক্লাসে স্যরের দুর্দান্ত পড়ানো, এমনকী ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে কেমন দেখতে ব্যাখ্যা করতে— একটাই শব্দ বিরাজমান! ‘নোংরা’! ‘মেয়েটাকে নোংরা দেখতে’— এই মন্তব্যে আমাদের কলেজের মেয়েরা আহ্লাদে আটখানা! কিংবা ‘আজ মেসের খাবারটা জাস্ট নোংরা ছিল’— মানে অসাধারণ স্বাদের খাবার হয়েছিল।
আংবাং: নতুন স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়েছি। গ্রামের ভেতরে হাইস্কুল। প্রথম দিনে থার্ড পিরিয়ডের স্যর বেরোবার পর ক্লাস জুড়ে ছাত্রদের একটা হল্লা শুরু হল। হঠাৎ হেডস্যর ক্লাসে দ্রুত ঢুকলেন। অমনি ছাত্ররা চুপ। ভদ্রলোক বাঁজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন— ‘কে কে আংবাং করছ্যাল?’ সবাই চুপ। ‘অ্যাই… মনিটর ক্যা?’ মনিটর উঠে দাঁড়াল এবং কাঁপা গলায় ক’জন ছাত্রের নাম বলল। ভদ্রলোক তাদের ‘আংবাং’ করার জন্য প্রত্যেকের পিঠে তাঁর বিখ্যাত ‘পাঞ্জা অটোগ্রাফ’ দিলেন এবং দ্রুত ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
লে ঝিল্লি: মুর্শিদাবাদের খাগড়া (বহরমপুর) অঞ্চলে ‘লে ঝিল্লি’ শব্দটা খুব প্রয়োগ করা হয় বিরক্তি প্রকাশের জন্য। যেমন, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কারও সাইকেলের চেন পড়ে গেল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে ‘লে ঝিল্লি!’ খুব বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ভেসে গেছে। রিকশ-চালক বলবেই, ‘লে ঝিল্লি! রাস্তায় এত জল, যাব কী করে!’ বাজারে আনাজপাতির দাম এক লাফে অনেকটা বাড়লে, খদ্দেরের মুখ দিয়ে বেরোবে, ‘এত দাম! লে ঝিল্লি!’
বিষাক্ত: অনলাইনে ফোন কিনে, আত্মহারা হয়ে ছেলে আমার মোবাইলে এসএমএস পাঠাল— মা, বিষাক্ত ফোন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। ফোনের বিশেষণ যে ‘বিষাক্ত’ হতে পারে, সেই প্রথম জানলাম। বুঝলাম, ‘দারুণ’, ‘দুর্দান্ত’, ‘ভীষণ ভাল’- এ সব বিশেষণ এ যুগে অচল।
অস্থির: কিছু দিন আগে ঘুরে এলাম বাংলাদেশ থেকে। আমার ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, নিয়ে গেল খুব উৎসাহভরে। বিশাল ক্যাম্পাস। অনেকগুলো বড় বড় বিল। এ বারও অতিথি পাখিতে বিল ভরে গেছে। সবাই মিলে হইহই করে বলল, চলো তোমাকে ‘অস্থির’ পাখি দেখাব। আমি অবাক! এ তো খাঁচার পাখি নয়, বনের পাখি! তারা আবার শান্তশিষ্ট হবে নাকি? অস্থির-ই তো হবে। প্রচুর ছবি তুললাম সেই সব পাখির, আর নিজেদের। ক্যামেরার মনিটরে ছবিগুলো ফিরে দেখার সময় একটি মেয়ে (ওদের বন্ধুদের মধ্যে এক জন) জিজ্ঞাসা করল, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? আমার ভাই বলে উঠল, একেবারে ‘অস্থির’! ভাইকে চুপিচুপি ডেকে বললাম, ‘অস্থির’ ব্যাপারটা কী রে? ভাই বলল, যা কিছু সুন্দর… এমন সুন্দর যে দেখে মন আনচান করে ওঠে, নিজেকে আর স্থির রাখা যায় না!
ঝাঁকি: আমাদের কলেজে, যদি কোনও মেয়ে এমন সুন্দরী ও আবেদনময়ী হত, যে ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলে টানত, তা হলে তাকে ডাকা হত ‘ঝাঁকি’। এর মধ্যে মেয়েটির প্রতি খোঁচাও থাকত, মানে, সে একটু চরিত্রহীন গোছের, ছেলেদের ইচ্ছে করে নাচায়। প্রোপোজ করার পর রিফিউজ্ড হয়েই ছেলেরা ক্যান্টিনে এসে বলত, ধুর, ও তো একটা ঝাঁকি!
গুপি কেস: সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর থার্ড ইয়ার তখন। একটা পেপারের পরীক্ষা যাচ্ছেতাই দিয়েছি সকলে, কিন্তু স্যর সকলকেই ঢেলে নম্বর দিয়ে বললেন, ‘ক্যালকুলেশন কে দেখতে যাচ্ছে? সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পুরোটাই হল গুপি কেস। যত ভুলই করো, দশ তলা বিল্ডিং ধসে পড়লেও পুলিশ তোমার কিস্যু করতে পারবে না।’ আমরা কোরাসে বলে উঠলাম, ‘ওওও, গুপি কেস!’ পরে দেখি, শুধু ‘গোলমেলে’ অর্থে নয়, হাপিশ করে দেওয়া, কায়দা করে হাতিয়ে নেওয়া অর্থেও গুপি বা গুপি কেস ব্যবহার হচ্ছে। ‘কী রে, আমার বইটা পুরো গুপি করে দিলি!’ বা, ‘পল্টুর গার্লফ্রেন্ড দেখি রতনের সঙ্গে ঘুরছে!’ আরে বুঝলি না, পুরো গুপি কেস!
ফিলিংস নেওয়া: মামার বাড়ি গেছি। মামাতো ভাই বেশ দেরি করে বাড়ি ফিরল। এত ক্ষণ কোথায় ছিলি, জিজ্ঞেস করতে আড়মোড়া ভাঙল, ‘একটু ফিলিংস নিয়ে এলাম।’ সেটা কী রে? স্মার্টলি সকলের সামনেই বলে দিল, ‘ডেট’ করতে যাওয়াকেই আজকাল ওরা ‘ফিলিংস নেওয়া’ বলে। তবু, পুরোটা বোধহয় বলতে পারেনি। কারণ, এ সব ‘ফিল করা’র মধ্যে মন ছাড়াও হালকা শারীরিক গন্ধ পাচ্ছি যেন!
ম্যানপাত্তি: বাসে এক জনের সঙ্গে কন্ডাক্টরের জোর ঝগড়া লেগেছে। বেশ কিছু ক্ষণ ঝঞ্ঝাটের পর লোকটা চেঁচিয়ে কন্ডাক্টরকে বলে উঠল, পিটিয়ে ম্যানপাত্তি ভেঙে দেব। আমি স্তম্ভিত, সেটা আবার কী? অবাক হয়ে আশপাশে জিজ্ঞেস করলাম, সহযাত্রীরা হেসে বলে দিল, ম্যানপাত্তি মানে কোমর। মেরে কোমর ভেঙে দেবে বলছে!
খাম: ‘গেল! এত ভাল কাপ-প্লেটের সেটটা গেল খাম হয়ে!’ নতুন প্রতিবেশীকে এই বলে চিৎকার করতে শুনলেন? অবাক হবেন না। মুর্শিদাবাদ বা বীরভূমের মানুষ প্রায়ই বলে থাকেন এই শব্দটা। কোনও নিখুঁত জিনিসে কোনও কারণে খুঁত হয়ে গেলে বলা হয় ‘খাম হয়ে গেল।’ হাত থেকে পড়ে কাপের হাতল ভেঙে গেলে সেটা খাম হয়ে যায়, বাড়ির এক দিকে আর একটা বাড়ি উঠে আলোহাওয়া বন্ধ করে দিলে সে বাড়িও খাম হয়। হাত-পা ভাঙলে লোকটার শরীরও খাম, নুন দিতে ভুল গেলে সাধের সর্ষে-ইলিশও খাম!
মারে কিরকিরি: প্রথম শুনেছিলাম মাটিতে বোরিং করে টিউবওয়েল বসানো মিস্ত্রিদের মুখে। সারা দিন ঘাম ঝরিয়ে পাথরের কঠিন আস্তরণ ভেদ করতে নাজেহাল হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত যখন পাইপ বসাতে সমর্থ হল, আনন্দে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘মারে কিরকিরি!’ আমি অবাক, এই কথাটা কোত্থেকে এল? ‘কিরকিরি’ অর্থাৎ বালিপাথরের স্তরটাকে ‘মেরেছে’, মানে পরাস্ত করেছে বলেই কি এত উচ্ছ্বাস? পরে নানা জায়গায় সাফল্যসূচক শব্দ হিসেবে এর ব্যবহার শুনেছি। পরীক্ষার্থী ভাল পরীক্ষা দিয়ে বেরোবার পর লাফিয়ে উঠে অন্য বন্ধুদের বলেছে, মারে কিরকিরি! এই ধরনের অর্থ বোঝাতে আঞ্চলিক আরও একটি শব্দগুচ্ছ বহু দিন থেকে চালু, ‘পাথরে পাঁচ কিল! ’ বা, হতাশা বোঝাতে: আর কিছু করার নেই, ‘ঝোল শেষ!