দেশের নদ-নদী দখলদারদের তালিকা তৈরিতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। এর কাজ শেষ হয় গত ডিসেম্বরে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ৩৭ হাজার ৩৯৬ নদ-নদী দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়, যা এনআরসিসির ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরেই এক সভায় নেয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সে তালিকা ওয়েবসাইট থেকে মুছে দিয়েছে এনআরসিসি নিজেই। এমনকি প্রকল্পের প্রতিবেদনও গ্রহণ করেনি কমিশন।

এ’বিষয়ে কমিশনের সদস্যদের বক্তব্য হলো, হাইকোর্টের এক রায়ে সিএস রেকর্ডের ভিত্তিতে অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে পানি আইন ২০১৩-এর ভিত্তিতে। এ কারণে প্রকল্পে চিহ্নিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ও তালিকা কমিশনে দেয়া প্রতিবেদনে এবং ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না এবং তা প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু ১৯৪০’সালে করা সিএস রেকর্ডে চিহ্নিত সব নদ-নদীর অবস্থান এখন আগের জায়গায় নেই জানিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি আইনে নদীর সীমানা ও ফোরশোরকে (তীরবর্তী ভূমি) সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আবার আলোচিত প্রকল্পটিতে দখলদারদের চিহ্নিত করতে শুধু পানি আইন নয়, বন্দর আইন ও ভূমি আইনেরও সহায়তা নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি দখলদার চিহ্নিত করতে জিপিএস ব্যবহার এবং সরজমিন পরিদর্শনও করা হয়েছিল।

আইনগুলোর সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের কোনো বিরোধ নেই জানিয়ে পরিবেশ আইনবিদরা বলছেন, এগুলো বরং একটি আরেকটির পরিপূরক। আবার সিএস রেকর্ডেও দেশের সব নদ-নদীর সীমানার হালনাগাদ তথ্য নেই। সুতরাং কমিশনের দখলদারদের তালিকা মুছে দেয়ার বিষয়টিকে যৌক্তিক বলা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। কমিশনের এমন সিদ্ধান্তকে দেশের নদ-নদীর ওপর স্মরণকালের সবচেয়ে বড় আঘাত উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বৈঠকে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দখলদারদের পক্ষ নিয়ে তথ্য মুছে দেয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা এই প্রথম দেখলাম আমরা। হাইকোর্ট জাতীয় নদী রক্ষার কমিশনের রিপোর্ট আমলে নিয়ে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেটি বাস্তবায়ন না করে দখলদারদের বাঁচানোর পাঁয়তারা ভয়াবহ রকম অন্যায় বলে মনে করি। কমিশনের এমন জনবিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড যদি আরো বেশি দিন চালু থাকে, তাহলে দেশে নদ-নদীর অস্তিত্ব বিলীন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। পানি আইন, বন্দর আইন ও ভূমি আইনের সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের কোনো বিরোধ নেই বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেকও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট তো পানি আইনকে অবৈধ ঘোষণা করেননি। বন্দর আইন, পানি আইন, ভূমি আইন—সব জায়গায় নদীতীরের সংজ্ঞা একই। আমরা যে উচ্ছেদ অভিযান চালাই, তা ফোরশোর-সংশ্লিষ্ট আইনের ভিত্তিতে করা হয়।’

নদী দখলদারদের তালিকা তৈরিতে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটির কাজ শুরু করে নদী রক্ষা কমিশন। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। কিন্তু কভিডের কারণে এক বছর পিছিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয় গত ডিসেম্বরে। প্রকল্পটি হাতে নেয়ার সময়ে এনআরসিসির চেয়ারম্যান ছিলেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মুজিবুর রহমান হাওলাদার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পানি আইন ২০১৩-এ নদীর ফোরশোর ও বন্যাকালীন পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ পর্যন্ত কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আলোচিত প্রকল্পটি আমার সময়েই নেয়া। এর বড় অংশও আমার সময়েই হয়েছে। এর পরেও আমি এটির সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলাম। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা নিজেদের মনগড়া কোনো তালিকা জমা দেননি। তারা জেলা প্রশাসক, তহশিলদার, মৌজা ম্যাপ, স্পারসোসহ সব ধরনের তথ্য যাচাই করে প্রতিবেদন করেছে। এ প্রতিবেদনের একটি তথ্যও ভুল বলার কোনো সুযোগ নেই।

প্রতিবেদন গ্রহণ না করা এবং ওয়েবসাইট থেকে তথ্য মুছে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কমিশনের উচিত ছিল এটি যাচাই করা। জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কোথায় ভুল আছে, সেটা খুঁজে বের করা। কিসের ভিত্তিতে এত পরিশ্রমলব্ধ একটি প্রতিবেদন বাতিল করা হলো? এটি প্রকাশের পর যদি মানুষ আপত্তি করত, তাহলে বাতিল করা যেত। এনআরসিসি এটি বাতিল করে দখলদারদেরই পক্ষ নিয়েছে। আমি দাবি জানাচ্ছি, দ্রুত এ হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে কমিশন ফিরে আসুক।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ পরিশ্রম শেষে দেশের নদ-নদী দখলদারদের তালিকাটি তৈরি করেছিলেন তারা। ৩৭ হাজার ৩৯৬ দখলদারের তথ্য কমিশনের ওয়েবসাইটেও সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু গোটা তালিকাটি সিএস ম্যাপ অনুযায়ী না হওয়ায় কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওয়েবসাইট থেকে এ-সংক্রান্ত তথ্য মুছে ফেলেন। এ নিয়ে রীতিমতো সভা করে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নদী দখলদারদের এ তথ্য কমিশন গ্রহণ করবে না এবং তা কমিশনের ওয়েবসাইটসহ অন্য কোথাও প্রকাশও করা হবে না। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের প্রতিবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। মূলত কিছু প্রভাবশালীকে বাঁচাতেই এ তথ্য গায়েব করা হয়েছে। দেশের সব নদ-নদীর সীমানা সিএস রেকর্ডে হালনাগাদ নেই। ফলে আমরা নদী ও নদীতীরবর্তী স্থানে আইনে নিষিদ্ধ এলাকায় দৃশ্যমান যেসব স্থাপনা পেয়েছি, সেগুলোকেই দখল বলে তালিকাভুক্ত করেছি। কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উচিত ছিল প্রয়োজনে আমাদের কাজটি আরো যাচাই করা। কোনো বাছবিচার না করেই আমাদের দখলদারদের লিস্ট গ্রহণ না করা চেয়ারম্যানের অসাধু উদ্দেশ্য বলেই প্রতীয়মান হয়। এনআরসিসির গত ২২’ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণীর একটি কপি বণিক বার্তার কাছে এসেছে। এতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সভায় এনআরসিসির সদস্য মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের আলোকে সিএস রেকর্ড মোতাবেক অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত হয়নি বিধায় প্রকল্পে চিহ্নিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ও তালিকা কমিশনে প্রদেয় প্রতিবেদন ও ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না এবং তা প্রকাশও করা যাবে না।

সভায় প্রায় একই কথা বলেন এনআরসিসির চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক সিএস অনুযায়ী না করে পানি আইন ২০১৩ অনুযায়ী নদীর অবৈধ দখল বা নদীতীরবর্তী স্থাপনার তালিকা করা হয়েছে। এ তালিকা প্রকাশ করলে আইনগত ও প্রশাসনিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ৩০০ কপিতে নদীর অবৈধ দখল, নদীতীরবর্তী স্থাপনার নাম, তথ্য অথবা সংখ্যা কোনোটিই প্রকাশ করা যাবে না। ওয়েবসাইটেও ওই অংশ বাদ দিয়ে প্রকাশ করতে হবে। ওয়েবসাইট থেকে তথ্য মুছে ফেলার বিষয়টি স্বীকার করে এনআরসিসির চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে এটি আমাদের একটি গোপনীয় বিষয়। এখানে ওয়েবসাইট থেকে তথ্য ডিলিটসহ নানা বিষয় রয়েছে। যিনি এ তথ্য লিক করেছেন, তিনি অন্যায় করেছেন। প্রতিবেদন গ্রহণ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদী দখলদারদের তথ্য করতে বলেছেন। কিন্তু প্রকল্পের লোকজন করেছেন পানি আইন অনুযায়ী। আমার পরিষ্কার কথা হলো, পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দখলদার বলা যাবে না। এ কারণেই আমরা প্রতিবেদন জমা নিইনি। ফলে প্রকল্পের পুরো টাকাটাই জলে গেছে।

নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নদ-নদীর অভিভাবক এনআরসিসি। উচ্চ আদালতের ঘোষণায়ও এ কথা বলা হয়েছে। নদ-নদীর দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুপারিশ করাই এনআরসিসির প্রধান কাজ। যদিও দেশের নদ-নদীর দখল ও দূষণ রোধে সংস্থাটির সফলতা প্রায় শূন্যের কোটায়। এর মধ্যে সিএস ম্যাপের অজুহাতে ৩৭ হাজারের বেশি দখলদারের তথ্য মুছে দিয়ে তাদের দায়মুক্তি দিয়েছে এনআরসিসি। অতীতে দেশের নদ-নদীর ওপর এত গুরুতর আঘাত আর আসেনি। কমিশন বর্তমানের ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে থাকলে অল্পদিনের মাথায় দেশের বড় বড় নদীও মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাবে।

প্রকল্পের প্রতিবেদন গ্রহণ না করে এনআরসিসি দখলদারদের দায়মুক্তি দিয়েছে উল্লেখ করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ এজাজ বলেন, ‘হাইকোর্ট শুধু সিএস রেকর্ড নয়, আরএস খতিয়ান ও পানি আইন আমলে নিয়ে নদী ও নদীতীরবর্তী স্থানে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে বলেছিলেন। ভূমি আইন, পানি আইন, ফোরশোরের আইনি সংজ্ঞা বং ফৌজদারি আইন অনুযায়ী নদী ও নদীতীর দখল করা অপরাধ। কিন্তু এখন কমিশনের দাবি মেনে নিলে কোনো দখলদারকেই আর দখলদার বলার সুযোগ থাকবে না। এ’বিষয়ে জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নদ-নদীর সীমানায় দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে হাইকোর্ট কেবল সিএস খতিয়ানকে আমলে নিতে বলেননি। বরং আরএস, পোর্ট অ্যাক্ট, পোর্ট রুলস, পানি আইনসহ সংশ্লিষ্ট সব আইন-বিধিকে বিশ্লেষণ করে রায় দিয়েছেন। পানি আইনে ফোরশোরে যে সীমানা দেয়া হয়েছে, নদীর সর্বনিম্ন পানির স্তর থেকে সর্বোচ্চ পানির স্তরের পরও আরো ১০ মিটারের পুরো জায়গা নদীর জায়গার অন্তর্ভুক্ত। বিআইডব্লিউটিএ এ আইনের আলোকেই দখল উচ্ছেদ করে। সুতরাং এভাবে দখলদারদের চিহ্নিত করা তো ভুল বা বেআইনি কিছু নয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে