৬০ ঘণ্টার ব্যবধানে আরো পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছে৷ তাঁদের অন্তত চারজন যে উগ্রবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন, তা নিশ্চিত৷ কলাবাগানে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে এলজিবিটি ম্যাগাজিন রূপবানের সম্পদক জুলহাস মান্নানসহ দু’জনকে।
জুলহাসসহ দু’জনকে সোমবার বিকেলে হত্যা করা হয়৷ এর আগে সকালেই গাজিপুরের কাশিমপুর কারাগারের সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান কারারক্ষী রুস্তম আলীকে ফটকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামন কামাল ঢাকায় সাংবাদিকদের এ সব হত্যাকাণ্ডকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘‘‘নিরাপত্তাহীনতা’ বোধ করার কোনো কারণ নেই৷”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথার কয়েক ঘণ্টার মাথায় কলাবাগনে নিজ বাসায় খুন হন জুলহাস মান্নান এবং তার বন্ধু মাহবুব তনয়৷ জুলহাস এলজিবিটি ম্যাগাজিন রূপবানের সম্পদক ছাড়াও বাংলাদেশে ইউএসএইড-এর কর্মকর্তা ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন৷ তাঁদের হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেয়৷
জুলহাস বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতা নিয়ে কাজ করতেন৷ তার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র এলজিবিটি ম্যাগাজিন রূপবানের সম্পাদনা করতেন তিনি৷ ২০১৪ সাল থেকে তিনি বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে লিঙ্গ সমতার প্রতীক হিসেবে ‘রেইনবো ব়্যালি’-র আয়োজন করে আসছিলেন৷ পরপর দু’বছর এই ব়্যালি করতে পারলেও এ বছর পহেলা বৈশাখে ব়্যালি করতে দেয়নি পুলিশ৷ ব়্যালি বের করার চেষ্টা করলে চারজনকে আটক করা হয়৷ এই ঘটনার পর থেকেই জুলহাস অনেকটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন বলে জানা যায়৷
গত শনিবার সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যা করা হয় রাজশাহীর শালবন এলকায় তাঁর বাসার সামনে৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস তাঁকে হত্যার দায় স্বীকার করে৷ অধ্যাপক রেজাউল সংস্কৃতি এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন৷ ছোট কাগজ বের করতেন ৷ সোমবারের তিন-তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ রবিবার, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় একইভাবে পরমানন্দ রায় নামে এক হিন্দু সাধুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়৷
কাশিমপুর কারাগারের সাবেক কারারক্ষীকেও সাম্প্রতিক বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের মতো মোটরসাইকেল আরোহীরাই হত্যা করে৷ পুলিশ বলছে, এখনো হত্যাকাণ্ডের পিছনে কোনো জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি ৷ এর আগে এ মাসের শুরুতেই ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিম উদ্দীন সামাদেকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়৷ সেই হত্যারও দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিরা৷
বাংলাদেশে এখন সেক্যুলারিস্ট বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা হামলা ও হত্যার শিকার হচ্ছেন৷ তাঁদের কখনো ‘নাস্তিক’, কখনো ‘ইসলাম বিরোধী’ আবার কখনো ‘ধর্মের অবমাননাকারী’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে৷ পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট যে, যাঁরা উগ্রপন্থিদের হামলার শিকার হচ্ছেন তাঁরা মুক্তচিন্তা, ভিন্নধর্মের, ভিন্ন ধর্মীয় চিন্তা, বিদেশি বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী৷ হামলা ও হত্যার সংখ্যা ও পরিধি বাড়ছে৷ কিন্তু একটি মাত্র ব্যতিক্রম ব্লগার রজীব হায়দার হত্যা ছাড়া আর কোনো ঘটনায় অপরাধীকে গ্রেপ্তার বা বিচারের আওতায় আনার নজির নেই৷
একের পর এক হত্যা
বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক হুমায়ূন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করার মধ্য দিয়ে প্রথম জঙ্গিদের মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু হয়৷ এরপর ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী এবং ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ঢাকার পল্লবিতে ৷
২০১৪ সালের ১ আগস্ট সাভারে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আশরাফুল আলমকে৷
১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার অভিজিত্ রায়কে৷ হামলায় গুরুতর আহত হন তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ৷
৩০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় খুন হন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু৷
১২ মে সিলেটে খুন হন আরেক মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ৷ তিনিও গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷
৭ আগস্ট ঢাকার বাসায় ঢুকে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের আরেক কর্মী নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে৷
২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানে তাভেল্লা সিজার নামের এক ইটালীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়৷
৩ অক্টোবর রংপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে৷
৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’-এর ফাদার লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়৷
৩১ অক্টোবর ঢাকায় অভিজিত্ রায়ের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে লালমাটিয়ায় কুপিয়ে জখম করে জঙ্গিরা৷ একই দিনে অভিজিতের আরেক প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয়৷
১৮ নভেম্বর দিনাজপুরে পিয়েরো পারোলারি নামে এক ইটালীয় পাদ্রিকে হত্যার চেষ্টা হয়৷
২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত হন, আহত হন আরও চারজন৷
২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হন৷
২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল রাতে ঢাকার সূত্রাপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে৷
২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷
একইভাবে আক্রমণ, তারপর হত্যা
প্রায় প্রতিটি ঘটনায় জঙ্গিরা দায় স্বীকার করেছে৷ এছাড়া ব্যক্তি আক্রমণের ক্ষেত্রে একই স্টাইলে মোটর সাইকেল আরোহীরা কুপিয়েছে বা গুলি করেছে৷ অন্যান্য আক্রমণের ক্ষেত্রে বোমা বা গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়৷ হত্যার স্টাইল খুবই নৃশংস৷ পুলিশ প্রধানত জেএমবি বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের দু’টি জঙ্গি সংগঠনকে এ সব হামলা এবং হত্যার জন্য দায়ী করছে৷ তবে তাদের গ্রেপ্তার বা আইনের আওতায় আনার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই৷
বাংলাদেশের মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সেক্যুলার, ভিন্নমতের মানুষ বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আজ আক্রান্ত৷ যারা আক্রমণ এবং হত্যা করছে, তারা মনে করছে তাদের চিন্তার সঙ্গে যাদের মিল নেই তাদেরই হত্যা করতে হবে৷ এবং তারা তা অব্যাহতভাবে করে যাচ্ছে৷ এটা সম্ভব হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে৷ এই অপরাধীরা ধরা পড়ছে না, তাদের বিচারও হচ্ছে না৷”
তিনি বলেন, ‘‘উগ্রপন্থিরা যে কোনো অজুহাত তৈরি করছে হত্যার জন্য, কারণ, তাদের চিন্তার সঙ্গে যারা একমত নয় তাদেরকে তারা ধ্বংস করে দিতে চায়৷ একটি উগ্রগোষ্ঠী তাদের উগ্রপন্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়৷ সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়, তাহলে এই দেশে ভিন্নমত, ভিন্ন চিন্তা ধর্মনিরপেক্ষতা – যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, তা বজায় রাখা কঠিন হবে৷”