দলবদ্ধভাবে নির্বাচনে আসছে না বিএনপি। এখন পর্যন্ত দলটির এমনই ঘোষণা। কিন্তু তারপরেও বিএনপির অনেক নেতাই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসছেন। নির্বাচনে আসতে অনেকেই আবার যোগ দিয়েছেন অন্য দলে।
সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বেশ আগে থেকেই আন্দোলন করছে বিএনপি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনসহ কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই অংশ নেয়নি দলটি। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবেন না তারা। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাদের একটি বড় অংশকেই দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিএনপির চলমান আন্দোলনের মধ্যেই গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী ভোট হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। বিএনপি এই তফসিল প্রত্যাখান করেছে। আগামী ৩০ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ সময়। অর্থাৎ নির্বাচনে আসতে বিএনপির হাতে আছে আর মাত্র একদিন। তবে বিএনপি যে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসছে না সে বিষয়টিও পরিস্কার। অবশ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে আসলে ভোটের তফসিল পরিবর্তন করা হবে। তবে এক্ষেত্রে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দলটিকে জানাতে হবে। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশে সহিংসতার পর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ছাড়াও দলটির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাই এখন কারাগারে। এ ঘটনার পর থেকে নয়া পল্টনের বিএনপি কার্যালয়টিও তালাবদ্ধ। দলীয় নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তারের ভয়ে আর সেখানে যাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যারা বাহিরে আছেন তারাও খুব একটা প্রকাশ্যে আসছেন না। হরতাল–অবরোধের মতো কর্মসূচিগুলোর ঘোষণা আসছে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ্য। শারীরিক নানা জটিলতায় আক্রান্ত খালেদা চিকিৎসাধীন আছেন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে। দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অন্যদিকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানও বেশ কয়েকটি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী। ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি লন্ডন চলে যান। এরপর আর ফেরেন নি। বর্তমানে লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন তারেক। বিএনপি ভোট বর্জন করলেও দলটির অনেক নেতাকর্মীই নির্বাচনে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। এরইমধ্যে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনজুর আলম। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুর আলম চট্টগ্রাম-১০ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন। মনোনয়ন পত্র কিনেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা সৈয়দ এ. কে. একরামুজ্জামান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে তাঁর পক্ষে মনোনয়নপত্র কেনা হয়। এছাড়াও মনোনয়নপত্র নিয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য মোহাম্মদ শোকরানা, সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরকার বাদল এবং জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বিউটি বেগম। এর মধ্যে আখতারুজ্জামান কিশোরগঞ্জ–২ আসনের জন্য, শোকরানা বগুড়া–১, বিউটি বেগম বগুড়া–২ ও বাদল বগুড়া–৭ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।
আখতারুজ্জামান সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে এই আসন থেকে নির্বাচন করেন। তবে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদের কাছে হেরে যান। আখতারুজ্জামান ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরআগেও কয়েকবার তিনি দল থেকে বহিস্কার হয়েছেন আবার ফিরেও এসেছেন। সর্বশেষ বহিষ্কার হন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য দলীয় নেতাদের সমালোচনা করে। মোহাম্মদ শোকরানা বগুড়া-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সরকার বাদল বগুড়া-৭ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়তে মনোনয়নপত্র তুলেছেন। আর বিউটি বেগম বগুড়া-২ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন। শোকরানা ২০১৯ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। এই আলোচিত ব্যবসায়ী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বগুড়াকে বিএনপির ঘাঁটি বলেই মনে করা হয়। এই দলের নেতারা নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে বলে স্থানীয় রাজনীতিবিদের মনে করছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিএনপি থেকে বহিস্কার হয়েছেন দলটির বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ–তাঁতী বিষয়ক সম্পাদক রাবেয়া সিরাজ এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. মাহাবুবুল হাসান।
অন্যদিকে দলটির অনেক নেতাকর্মীই নির্বাচনে প্রার্থী হতে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। এরই মধ্যে বিএনএমে যোগ দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য সি.এম. সাফি মাহমুদ ও বিএনপি-পন্থী সঙ্গীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী। এর আগে আরো পাঁচজন সাবেক সংসদ সদস্য বিএনএমে যোগ দিয়েছেন। এরা হলেন জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, আবদুল ওহাব, আবু জাফর, দেওয়ান শামসুল আবেদীন, আবদুর রহমান। গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন জানান, বিএনপির অনেক নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে পারেন। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির যে রাজনীতি, যে লিডারশিপ, যে নেতৃত্ব, এটা বিএনপির অনেক নেতার কাছেই পছন্দ হচ্ছে না বলেই তারা দল ছেড়ে নতুন দল তৈরি করেছেন। এবং সেখান থেকেই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য সচেষ্ট হচ্ছেন। আমরা এমনও শুনছি বিএনপির অনেকেই নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। এদিকে গত সেপ্টেম্বরে বিএনপির সাবেক দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারকে চেয়ারপারসন ও মহাসচিব করে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে নতুন রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপি। এই দুই নেতার নেতৃত্বে তৃণমুল বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।
শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও। অবসরের পর ২০০৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। এর পরের বছরই দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মনোনিত হন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি হঠাৎ করেই বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে আসেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে যোগ দেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সাথে। তিনি এখনও দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন। তৈমুর আলম খন্দকার দীর্ঘসময় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাও হন। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটির প্রথম নির্বাচনের তিনি বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। ২০২২ সালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটালকে বলেন, ‘সরকার বিএনপি ভাঙার চেষ্টা করছে। কিন্তু অতীতে তারা সফল হয়নি। এবারও হবে না। যারা দল থেকে বেরিয়ে ভোটে যাচ্ছেন তারা এখন আর বিএনপির কেউ নন। অনেককে আগেই বহিস্কার করা হয়েছে। দু–একজন যারা যাচ্ছেন এতে বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না।