বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এক বৈচিত্র্যময় দেশ। এখানে স্মরণাতীত কাল থেকে বাঙালি জাতির বাইরে আরো ৫০টি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ বাস করছে। সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ ৫০টি ভিন্ন ভিন্ন জাতির নাম তালিকাভুক্ত করে একটি গেজেট প্রকাশ করে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে গেলেও আমাদের দুঃখের সাথে বলতে হয়, এই সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষেরা সকলের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যেতে পারছেন না।

ঐতিহাসিক ও উপনিবেশিক কারণে আদিবাসীরা নানা অবিচার ও নিপীড়নের শিকার। জাতিসংঘের হিসাব মতে, কোনো কোনো জাতি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। ইউনেস্কো বলছে, পৃথিবীর ৭,০০০ মাতৃভাষার মধ্যে আদিবাসীদের ভাষাই প্রায় ৫,০০০ হাজার। এদের মধ্যে ৩,০০০ ভাষা বিপন্ন। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি নৃবৈজ্ঞানিক ভাষা সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এই সমীক্ষায় জানা গেছে বাংলাদেশে মাতৃভাষা আছে ৪১টি। বাংলা ও উর্দু বাদে ৩৯টি ভাষাই হলো আদিবাসীদের ভাষা। এদের মধ্যে কমপক্ষে ১৪টি মাতৃভাষা বিপন্ন। তাই এই লেখা লিখতে গিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর কথাই মনে পড়ে। তিনি তার ‘গঙ্গা-যমুনা-ডুলং-চাকা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে ডুলং, নেংসাই, চাকা এ সব নদীকে মেলাবার কাজ তো শুরুই হয়নি। কবে হবে তা জানি না। শুধু এটা জানি যে পরিণামে মূলস্রোতকে, সমগ্র দেশকে ভীষণ দাম দিতে হবে এই উপেক্ষার। আর, কাদের উপেক্ষার? যারা সত্যিই তো অনেক, অনেক সভ্য আমাদের চেয়ে। মেয়ের বাপ পণ দেয় না, সতীদাহ বা পণের কারণে বধূহত্যা জানে না, কন্যা সন্তানকে হত্যা করে না, বিধবা বিবাহ স্বীকৃত, উপযুক্ত কারণ থাকলে বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত, এমন উন্নত সামাজিক প্রথা যাদের, তাদের উপেক্ষা করলাম। তারা যে সভ্য, উন্নত, শ্রদ্ধেয় মূলস্রোত সেটা জানার চেষ্টাই করল না। এর দাম আমাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে, হবে। কোনোদিন ভারতের সত্যি ইতিহাস লেখা হবে। সে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না, যদি আমরা এখনো না বুঝি।”

মহাশ্বেতা দেবী কথাগুলো ভারতের আদিবাসীদের বিষয়ে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের উদ্দেশ্যে বলেছেন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের জন্য কথাগুলো কি প্রযোজ্য নয়? জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪৮ কোটি আদিবাসী রয়েছে। প্রতি বছর অনেক আশা নিয়ে আমরা ৯ আগস্ট জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করি। মনে বড় আশা জাগে, প্রিয় জন্মভূমি একদিন আদিবাসীসহ সকল নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মানবিক ও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ কথাটি প্রতিফলিত হবে সমাজে। যারা দুর্বল, পিছিয়ে পড়া, যারা দলিত, শোষিত ও বঞ্চিত, শ্রমজীবী মানুষ, অসহায় গরিব কৃষক, হরিজন, চা বাগানের শ্রমিক, আদিবাসী, এই মানুষেরা রাষ্ট্রের নজরে থাকবে সবার উপরে। আজো এই আশায় চেয়ে থাকি।


আদিবাসী দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য হলো আদিবাসীদের জীবনধারা, মৌলিক মানবাধিকার, আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করে তোলা এবং আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করা। অনেক দেরিতে হলেও আমাদের দেশে এই গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদনে সরকারকে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজুলেশন ৪৯/২১৪ গ্রহণ করে ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং দিবসটি পালনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান জানায়। তারপর থেকে বৈশ্বিক পর্যায়ে অনেক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তম্মধ্যে ২০০০ সালে জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠন, ২০০১ সাল থেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার নিয়োগ, ২০০৫-২০১৪ সালের সময়কালকে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক হিসেবে পালন, ২০০৭ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র গ্রহণ, ২০০৭ সালে আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থা প্রবর্তন, ২০১৪ সালে সাধারণ পরিষদের বিশ্ব আদিবাসী সম্মেলন আয়োজন এবং এ সম্মেলনে ঐতিহাসিক ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ গ্রহণ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযাগ্য। ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ বা ‘Leave No One Behind’ শ্লোগান নিয়ে যে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০৩০ এজেন্ডা জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে, সেখানে আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। তাই আগামীতে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদিবাসী জনগণ এবং আদিবাসী সংগঠনসমূহ কিভাবে অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারে, তার উপায় খুঁজে বের করা জরুরি।

আদিবাসীদের কাছে ভূমি হলো তাদের অস্তিত্বের শেষ চিহ্ন। আমরা বলি, আমাদের নিকট থেকে ভূমি কেড়ে নেয়ার অর্থ হলো একটি বাগান থেকে ফুল ছিঁড়ে নেয়ার মত। ভূমি নেই তো আদিবাসীদের জীবন নেই। ভূমি নেই তো আনন্দ নেই, উৎসব নেই, সংস্কৃতি নেই। ভূমিহীন মানুষ সংস্কৃতিচর্চা করবে কোথায়? তার নৃত্য করার, কথা বলার, গান করার, ভালোবাসার, মনের কথা বলার জায়গা কোথায়? তাঞ্জানিয়ার এক মাসাই আদিবাসী জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে বলেছেন, ভূমিবিহীন মানুষ হলো স্ট্রাইপবিহীন জেব্রার মতো। আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, নদী, পাহাড়-পর্বত, ভূমি ও প্রকৃতির সাথে রয়েছে আদিবাসীদের নিবিড় সম্পর্ক। তাদের সংস্কৃতিতে ভূমি হলো মা। অরণ্যের মধ্যে তারা জননীর প্রাণের সন্ধান করেন, তারা প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারেন। তারা বন ও সম্পদকে কোনোদিন বেচাকেনার বিষয় হিসেবে দেখেন না, কিন্তু জীবনের অংশ হিসেবে দেখেন। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা বন, সম্পদ, প্রকৃতি সবকিছু ভোগ ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখে। বাগানের গাছ থেকে ফুল তুলে নিলে যেমন ফুল শুকিয়ে যায়, অরণ্য ধ্বংস হবার ফলে আদিবাসীদের জীবনও আজ বিপন্ন। আদিবাসীরা বনকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে জীবনের অংশ হিসেবে দেখার আহ্বান জানান। একটি স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার ২০০৮ সালে। এই নিয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবিলম্বে এই ভূমি কমিশন গঠন করা দরকার।

বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। আমরা বলছি যে, বাংলাদেশের সকল নাগরিক বাঙালি নয় এবং এ জন্য বাঙালি জনগণের দুঃখ পাওয়ার কারণ তো নেইই, বরং তারা খুশি হতে পারে। কারণ এদেশ অনেক জাতির, অনেক ভাষার ও সংস্কৃতির মানুষের দেশ। রাষ্ট্রে আদিবাসীদের ছোট ছোট অধিকার দিলে, সম্মান করলে, উন্নত করলে, সমগ্র দেশটাই উন্নত হয়। এ নিয়ে বাঙালি জাতি তখন গর্ব করতে পারে যে, অন্যান্য জাতির অধিকারের প্রতি তারা কত সহনশীল ও শ্রদ্ধাশীল। এখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী আছে, আবার শংখ-মেননেং-সোমেশ্বরী-চেংগী-মাইনী-বুগাই নদী আছে। গারো ও খাসি পাহাড়, চিম্বুক, ফুরামন আছে। সমুদ্র উপকুলে রাখাইনরা আছেন এবং সুন্দরবনে আছেন মুন্ডারা। আসামকে নিয়ে ভূপেন হাজারিকার একটি গান আছে, ‘পাহাড় এসে সমতলে বাজায় করতালি, বিহুর সাথে মিশে গেছে কখন ভাটিয়ালী।’ এভাবেই আদিবাসীদের সঙ্গে বাঙালিদের সংবাহন বিন্দু গড়ে উঠতে পারে।

আমাদের এই বৈচিত্রময়তার সৌন্দর্যের কথাই বলতে হবে সবার মধ্যে। Diversity is not a threat বরং এটি যে সুন্দর, এ কথাটাই ছড়িয়ে দিতে হবে মানুষের হৃদয়ে। তখনি সমাজের সর্বত্র আদিবাসীদের প্রতি মানবিক ভালোবাসা জেগে উঠবে, আদিবাসীদের দুঃখ-বেদনা সকলকে আহত করবে, ওদের দুঃখে সমভাবে দুঃখী হবে বাংলাদেশ। তাই প্রগতিশীল মুক্ত-সংস্কৃতিমনা বাঙালিদের আদিবাসীদের পাশে থাকা দরকার। এই পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা ৫ ভাগ হলো আদিবাসী, অথচ এরাই পৃথিবীর শতকরা ৮০ ভাগের বেশি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। আদিবাসীরাও মানুষ এবং তারা এ দেশের নাগরিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। তাই আজ আদিবাসী দিবসে আশা করছি, সরকার আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিবে। তাদের প্রতি বিশেষ সংবেদনশীল হবে। আদিবাসীদের অধিকার হলো মানবাধিকার। আদিবাসী ইস্যুতে জনসচেতনতা তৈরিতে সরকার, জাতিসংঘ, নাগরিক সমাজ ও গণ-মাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা পালন করা জরুরি। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রে যে সকল অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা সকলের দায়িত্ব। এভাবেই আমাদের প্রিয় স্বদেশ একদিন আরো বেশি গণতান্ত্রিক, উদার ও অসাম্প্রদায়িক, উন্নত মানবিক রাষ্ট্র হয়ে উঠবে।

মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি একই সুরে বলেছেন, একটি দেশ ও একটি সমাজ কতখানি উন্নত, সভ্য ও মানবিক তার বিচার্য্য বিষয় হলো সেই দেশে ও সেই সমাজে সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ কেমন আছেন? আমাদের রাষ্ট্রের মহিমা বৃদ্ধি পাবে যখন এখানে একজন সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, হাজং, খাসিয়া, মুন্ডা, কড়া, বানাই, খুমি, ম্রো, কোচসহ সকল আদিবাসী মানুষ ভালো থাকবেন, সংখ্যালঘু জনগণ নিরাপদে থাকবেন। আসুন আজ আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের শক্তি ও আত্ম-পরিচয়ের অধিকারকে শুধু স্বীকৃতিই নয়, সারা দেশে আনন্দ ও ভালোবাসা নিয়ে উদযাপন করি।

লেখক – সঞ্জীব দ্রং, কলামিষ্ট ও মানবাধিকারকর্মী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে