বিডি টাইমস ডেস্কঃ নদীর ওপরে বাস করেন রাজা। মন্ত্রিসভার বৈঠকও হয়  সেখানেই। রাজ্যের সব মানুষ রাজাকে পূজা ও দিচ্ছেন তার বাসস্থানে। আর সেই রাজার আশীর্বাদ নিয়ে প্রজাদের ইচ্ছে ও  পূরণ হচ্ছে।  আবার সে রাজার সুদৃষ্টির অভাবে ঘটে চলেছে  ঝুঁকি, দুর্ঘটনা– এমনকি প্রাণহানির মত ঘটনা। এ কোনো রূপকথার গল্প নয়। এ রকম বিরল ঘটনা ঘটে চলেছে সাঙ্গু নদীর ওপর তিন্দু নামক স্থানে। যদিও সে রাজা কোনো মানুষ নয়, পাথর। রাজা পাথর!

বান্দরবান জেলার একমাত্র পাহাড়ি নদী হচ্ছে  সাঙ্গু। অত্যন্ত খরস্রোতা, তবে গুরুত্বপূর্ণ।  স্বচ্ছ ও নীল পানি। এ নদীর দু’পাশে আকাশছোঁয়া সবুজ পাহাড়। পাহাড়গুলো ও পাথরের। দেখলেই বুঝা যায় পাথরের ওপর ভাসছে নদীটি;  প্রকৃতি যেন তার সব সৌন্দর্য নিজ হাতে ঢেলে দিয়েছেন এ নদীকে ঘিরে।

বাংলাদেশে যে দুটি নদী দেশের ভেতরে উৎপত্তি হয়ে দেশেই শেষ হয়েছে; তার অন্যতম একটি হচ্ছে  সাঙ্গু নদী। পৃথিবীতে এত সুন্দর জায়গা খুব কম স্থানেই আছে। মিয়ানমার সীমান্ত ঘিরে বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলা সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উজানে ২ ঘণ্টা যাওয়ার পর পাথরের রাজা ও তার মন্ত্রিসভার রাজ্যকে খুঁজে পাওয়া যায়।নদীর স্রোতকে  আটকে স্থির হয়ে মিশে আছে বিশাল পাথর। তার আশেপাশে রয়েছে তার চেয়ে ছোট ছোট পাথর। ১২টি পাথরের মধ্যে বড় পাথরটির নাম হল রাজা পাথর।

কথিত আছে– অনেক আগে অর্থাৎ এই নদী যখন সৃষ্টি হয়েছে, তখন থেকে ১২টি পাথর নদীর ওপর ছিল। পাহাড়িদের মধ্যে অনেক আগে থেকে একটা ধারণা ছিল– ওই স্থানে সবচেয়ে বড় পাথর জীবিত আছে। এই জীবিত পাথরের কাছে পূজা দিয়ে কিছু চাইলে তার মনের আশা পূরণ হয়। প্রচলিত আছে– রাজা পাথরের কাছে কিছু চেয়ে অনেকের অনেক আশা নাকি পূরণ হয়েছে। তাই বড় পাথরকে তারা সম্মান করে রাজা পাথর বলে ডাকতে শুরু করে। তখন থেকে পাথরের নদী সাঙ্গুর যে জায়গায় রাজা পাথর অবস্থিত; তখন থেকেঐ স্থানটি রাজা পাথর, ১২ পাথর এবং বড় পাথর নামে পরিচিত।

আবার পাহাড়িরা বড় পাথরকে দেবতা বলেও মনে করেন। কারণ তারা মনে করে যে, বড় পাথরটি হলো রাজা এবং বাকি ছোট পাথরগুলো মন্ত্রী। অর্থাৎ রাজা তার মন্ত্রীদের নিয়ে সভা করছেন। পাহাড়িদের এ বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগসূত্র না থাকলেও বছরের পর বছর ধরে মানুষের মধ্যে এ বিশ্বাস চলে আসছে। আগ্নেয়গিরি কিংবা ভূকম্পনে এসব পাথর পাহাড়ের জন্ম বলে গবেষকরা মনে করেন। গবেষকদের মতে, এখনও বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আশঙ্কা পাহাড়ি অঞ্চলে বেশি। কারণ ভূগর্ভে শূন্যতা থাকতে পারে। ফলে স্থানটি নিয়ে ভূতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে অনেকে মনে করেন।

বড় পাথর এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভয়ঙ্কর সরু এক বাঁক সেখানে। বাঁকের মধ্যে  স্রোত ও অনেক বেশি। এর মধ্য দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে সে  জায়গাটিকে অতিক্রম করে। বড় পাথরে ১০ মিনিট দাঁড়ানো মাত্রই দেখা গেল দুর্ঘটনা। পর্যটকবাহী একটি নৌকা -বড় পাথরের বাঁক অতিক্রম করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাথরের সঙ্গে দুবার ধাক্কা খায়। তবে অল্পের জন্য নৌকাটি উল্টায়নি।ফলে লাল পোশাকের তরুণী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রাণে বেঁচে যান, ভ্রমণের আনন্দ ফিকে হয়ে আসে। প্রতি বছর বহু মানুষ এ বাঁকে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এটি কি রাজার কৃপার অভাব!


বান্দরবান থেকে নীলাচল হয়ে আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু গহিন জঙ্গল পেরিয়ে ৮০ কিলোমিটার গেলে থানচি। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে মসৃণ রাস্তা হয়েছে। কাউকে শাস্তি হিসেবে বান্দরবান বদলি করা হলে এখন এটি হবে আশীর্বাদ। কারণ বান্দরবান এখন আর দুর্গম জনপদ নয়। অনেক রাস্তা। পাহাড়িদের নিজস্ব পোশাকের ব্যবসা আছে। মোটরসাইকেল, ডিশলাইন, ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো, প্রত্যন্ত গ্রামেও সোলার প্যানেল আছে।

থানচি যাওয়ার পথে শুধু উঁচু পাহাড় নয়; পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে জুমচাষ, পেঁপে, কলা, কাজুবাদাম, ফলের বাগান দেখা যায়। বান্দরবান থেকে চান্দের গাড়ি কিংবা বাসে যাওয়া যায়। তবে ব্যক্তিগত গাড়িতে গেলে পাহাড়ে ওঠানামার মতো শক্তিশালী গাড়ি ও অভিজ্ঞ চালক লাগবে। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ৮০ কিলোমিটার পথ কখন যে ফুরিয়ে যায় টেরই পাওয়া যাবে না।

থানচিতে পৌঁছার পর বিজিবি ক্যাম্পে নিবন্ধন করে সাঙ্গু নদীতে আনন্দ উপভোগে নামতে হবে। থানচিতে আছে ৩০০ থেকে ৩২০টি লম্বা সাম্পান আকৃতির ডিঙি নৌকা। তার সঙ্গে ইঞ্জিন। থানচি ঘাটে আছে ১৬০ থেকে ১৭০ জন গাইড। থানচি থেকে নৌকা ভাড়া করে রেমাক্রি রওনা হওয়ার পর আসল সৌন্দর্য।

ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ফুটের বেশি ওপরে অবস্থিত এ নদী নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আঁধার। ছোটবড় নালা ও ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে দুপাশে চোখ জুড়ানো পাহাড় ও অরণ্য। পাহাড়িদের বৈচিত্র্যময় জীবন যাপন, আকাশে মেঘের আনাগোনা মাঝে মাঝে মন ছুঁয়ে যায়। পর্যটকদের মধ্যে এমন এক অনুভূতির জন্ম হয়, যা নিজে উপভোগ না করলে বলে বোঝানো যাবে না।

রেমাক্রি পর্যন্ত যাওয়ার পথে রাজা পাথর। সেখানে দুর্ঘটনা এড়াতে অনেকে সতর্কতার জন্য হেলমেট, পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত শক্ত জুতা পরেন। লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক।অনেকে মনে করেন, বড় পাথরে দুর্ঘটনা এড়াতে নৌকার মাঝিদের সেখানে ইঞ্জিন বন্ধ করে বাঁক অতিক্রম বাধ্যতামূলক করা উচিত। ওই স্থানে দুর্ঘটনার শিকার পর্যটকদের উদ্ধারে থাকা উচিৎ উদ্ধার দলও; যাতে আনন্দ মুহূর্তে বিষাদে পরিণত না হতে পারে।তবে রেমাক্রিতে রাতযাপন করে জ্যোৎস্নাময় রাত উপভোগ না করলে পুরো ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ মনে হবে বলে বিশ্লেষকরা ও পর্যটকরা মনে করছেন।

নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইমস নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে