স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনীতির ৫০’বছরে অর্জন অনেক। তবে সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই বাংলাদেশের কূটনীতি শুরু হয়। ওই বছরের শেষের দিকে ভুটান ও ভারত স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তবে বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি দেয়। ফলে ২০২২ সালে অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতির ৫০ বছর উদযাপিত হবে। এসব দিক বিবেচনায় ৫০ বছরের কূটনীতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বহুমুখী কূটনীতির প্রসার এবং বিদেশে বড় শ্রমবাজার প্রতিষ্ঠা বড় অর্জন হলেও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে বাংলাদেশের উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখাই হবে আগামী দিনে কূটনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বেশির ভাগ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭২ সালে। ফলে ২০২২ সালে বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন হবে। এ উপলক্ষ্যে বিশেষ ইভেন্ট থাকবে। উচ্চ পর্যায়ে সফর বিনিময়ে সম্ভাবনা আছে। এসবের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিক দিয়ে অগ্রগতির আশা করা হচ্ছে।’ বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের কূটনীতির লক্ষণীয় দিক হলো দ্রুততম সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্যপদ প্রাপ্তির মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করে। তবে ওই আমলে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির মাধ্যমে কূটনীতিতে বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটেছিল। ফিলিস্তিনসহ কোনো কোনো দেশ জটিল কূটনীতির কারণে আজও জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ কয়েক বছরে কূটনীতিতে অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। প্রথমদিকে চীনের ভেটোর কারণে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তি কঠিন হলেও পরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই স্থায়ী সদস্য দেশটি ভেটো তুলে নেয়। ফলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে কূটনীতির সবচেয়ে বড় অর্জন সার্ক প্রতিষ্ঠা করা। দক্ষিণ এশিয়ায় দেড়শ কোটি মানুষ বাস করলেও এই অঞ্চলে কোনো আঞ্চলিক সংস্থা ছিল না। বাংলাদেশের উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গঠিত হয়। যদিও ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতার কারণে সার্ক সম্মেলন স্থগিত আছে। কিন্তু এই অঞ্চলে সহযোগিতার অন্যতম বাহন হিসাবে এখনো সার্কই একমাত্র অবলম্বন।
বাংলাদেশ যেসব দেশের সঙ্গে ২০২২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করবে, তার মধ্যে অন্যতম থাইল্যান্ড। ঢাকায় থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মাকাওয়াদি সুমিতমোর সাংবাদিকদের বলেছেন, নতুন বছরে তারা অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। এসব আয়োজনের লক্ষ্য হলো, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। সাম্প্রতিককালে ভূ-রাজনীতির গোলকধাঁধার কারণে বাংলাদেশের কূটনীতি কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এশিয়ায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা মোকাবিলায় মরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র হিসাবে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। অন্যদিকে চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। ফলে দুই শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে রয়েছে। বাংলাদেশ নিজ দেশের অগ্রগতির প্রতি জোর দিয়ে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতি নিয়ে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে থাকে। এই নীতির কারণে কোনো বিশেষ পক্ষের প্রতি ঝুঁকে থাকা বাংলাদেশের প্রবণতা নয়। রোহিঙ্গা সংকট নানা কারণে সমাধান হচ্ছে না। এ নিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতি সক্রিয় থাকলেও কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান বাংলাদেশের কূটনীতির সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক রয়েছে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন এবং সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ অন্যতম। তবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই এখনো সম্ভব হয়নি। সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলো বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার। অন্যদিকে চীন, জাপানসহ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই জোরালো হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে দুলছে।
অতিসম্প্রতি র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে এলিট ফোর্সটির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাইডেন প্রশাসন। জানতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বিব্রতকর। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে এখনই তেমন কিছু ঘটবে বলে মনে করি না। যুক্তরাষ্ট্র যে বিষয়গুলো তুলেছে সেসব বিষয় তলিয়ে দেখে তা সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে মনে করি। তবে গত ২০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের আমলে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। বাইডেন প্রশাসন মানবাধিকারকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করছে। আমাদেরও বিষয়টি অধিক গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। এম হুমায়ুন কবির আরও বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। ফলে অন্য কোনো ক্ষেত্রে যাতে তার প্রভাব না পড়ে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগসমূহ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহায়তা গ্রহণ সংক্রান্ত একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে যে কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস দেখাশোনা করছে। প্রয়োজনে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বাংলাদেশ আইনি ফার্ম নিয়োগ করবে।/ যুগান্তর থেকে
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ