লেখকঃ সন্দীপ ব্যানার্জি, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট(কলকতা)
”ধর্মনিরপেক্ষ শেখমুজিবুর রহমান, জোটনিরপেক্ষ বঙ্গবন্ধু” এই উক্তির মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ধর্মনীতি, বিদেশ নীতি ছাড়াও শুধু বাঙালি জাতির জন্যই নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যানের কথাই ভাবতেন। সেই ভাবনা চিন্তার নানা দিক নিয়ে আমার এই নিবন্ধ।
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত নোটবুক থেকে ৩০.৫.১৯৭৩ তারিখ উল্লিখিত একটি দার্শনিক বক্তব্য পাওয়া যায়- “As a man, what concerns mankind concerns me. As a Bengalee, I am deeply involved in all that concerns Bengalees. This abiding involvement is born of and nourished by love, enduring love, which gives meaning to my politics and very being.” এই বক্তব্যের বাংলা রূপান্তর করলে যা দাঁড়ায় তা মোটামুটি এইরকম- “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতির অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে”। এই অভিব্যক্তির নির্যাস থেকে যা পাওয়া যায় তা হল, একজন ব্যক্তিত্ব যিনি নিজেকে উন্নীত করেছেন মানবিকতার স্তরে। তাঁর মধ্যে সামাজিক বা ধার্মিক সংকীর্ণতা পাওয়া যায় না। একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল যে, ওপরের বক্তব্যের তারিখটি- ৩০.৫.১৯৭৩। অর্থাৎ, শেখ মুজিবুর রহমান তখন সদ্যগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একজন নব্য রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এর চেয়ে ভাল, এর চেয়ে উদার মনোভাব আর কি পাওয়া যেতে পারে? শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষতার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত এখান থেকেই উঠে আসে। তাঁর সমগ্র জীবন ও কর্মের মধ্যে সেই ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে তাঁর মূল্যায়ন করলে প্রথমেই যা মেনে নিতে হবে তা হল, তাঁর চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা সময়ের সঙ্গে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। উনি, ওনার রাজনৈতিক মতবাদের মধ্যে ধার্মিক মতবাদ প্রচার না করে, নিপীড়িত শ্রেণীর স্বার্থের কথা প্রচার করেছিলেন। ১৯৬২ সালে চীন সফর করে ফিরে এসে উনি সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত করেছিলেন এবং তা, তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত ছিল। এখানে মনে রাখা দরকার, যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব তিনি দিয়েছিলেন, তা কোনো নির্দিষ্ট ধার্মিক সম্প্রদায়ের ছিল না, তা ছিল সবার মুক্তির জন্য যুদ্ধ। সে যুদ্ধ শুধু স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল না, তা ছিল একটা সমগ্র জাতির মুক্তির যুদ্ধ। শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে প্রজ্বলিত জাতীয়তাবাদ পাওয়া যায়। কিছুদিন আগে “দ্য টেলিগ্রাফ” নামে একটি পত্রিকা, যেটা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়, সেখানে মুন্তাসির মামুন, একজন বিখ্যাত বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী, বলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে “বাঙালি জাতীয়তাবাদ” বা “বেঙ্গলি ন্যাশনালিজম” দেখতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাধারার মিল পাওয়া যায়। ধর্ম ও রাজনীতির সমীকরণের ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের ধারণা খুব স্বচ্ছ ছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতন তিনিও মনে করতেন যে, ধর্ম একজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং রাজনৈতিক বিষয়, বিশেষত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক মতবাদ ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হওয়াই কাম্য। আজকে যখন পৃথিবীর নানান জায়গায় রাজনীতির ধার্মিক মেরুকরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং তার কুফলও স্বচ্ছভাবে উঠে আসছে, তখন শেখ মুজিবুর রহমানের উদার রাজনৈতিক মতবাদ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
যদিও শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন, কিন্তু ওনার বিদেশনীতি ছিল মূলত জোট-নিরপেক্ষ। ওনার বিখ্যাত উক্তি- “I am a human being, then a Bengalee, and after that a Muslim.”এই উক্তির সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে। বর্তমান বিশ্বে যখন আমরা বিভিন্নভাবে সাম্প্রদায়িকতার শিকার হচ্ছি এবং তার ভয়াবহতার সম্মুখীন হচ্ছি, আমাদের শেখ মুজিবুর রহমানের সম্প্রদায়িক উদারচেতা মনোভাবকে মান্যতা দিতে হবে। নব্যগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের যে সংবিধান ১৯৭২ সালে তৈরি করা হয় তাতে পরিষ্কারভাবে “সেকুলার” বা “ধর্মনিরপেক্ষ” কথাটির উল্লেখ আছে।
বর্তমান বাংলাদেশে যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, তা আসলে স্থাপন করেন শেখ মুজিবুর রহমান নিজে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলে তাঁর পিতার নীতি ও আদর্শকেই অনুসরণ করছেন। “দ্য ডেইলি স্টার” পত্রিকাতে একটি নিবন্ধে, যা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ১৫ই অগস্টে, আনিসুর রহমান অধ্যাপক আব্দুর রজ্জাককে উল্লেখ করে বলেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ববর্গ ছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মধ্যে কিছুটা অনন্য বা পৃথক। তিনি জিন্না সাহেবের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পথের না হেঁটে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পথ নেন। এক্ষেত্রে তিনি গান্ধীজীর ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দর্শনের থেকেও আলাদা ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয়তাবাদ সে দিক থেকে আরও উদারপ্রসারী কারণ তা কোনো ধর্ম বা কোনো নির্দিষ্ট ভৌগলিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে নয়। যে “বাঙালি” শব্দটি শেখ মুজিবুর রহমান ব্যবহার করতেন এবং যা তাঁর সময় সংবিধানেও গ্রহণ করা হয়েছিল, তা আসলে জাতীয়তাবাদের ধর্মনিরপেক্ষতার সংকেত। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, এই ধর্মনিরপেক্ষতা কিন্তু ধর্মকে অস্বীকার করা নয়। এটা হচ্ছে ধর্মসমন্বয় এবং সবার পৃথকভাবে ধর্ম পালন করার অবস্থান। এটাই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ধার্মিক নমনীয়তা। তাঁর নিজের বক্তব্যে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন যে, যেমন যারা মুসলমান তারা তাদের ধর্মবিশ্বাস ও আচার পালন করবে, তেমন অন্য ধর্মের মানুষরাও তা করার অধিকার পাবে। তিনি ধর্মের নামে কোনো রাজনৈতিক বিভেদকে প্রশ্রয় দেননি এবং এক কথায়, কোনো বিভাজনকারী রাজনীতি করেননি। তিনি প্রকৃতই “বঙ্গবন্ধু” হয়ে উঠেছিলেন। এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন, যাকে বোধহয় আজকের দিনে অনেক বেশি করে দরকার।
১৯৭২ সালের আলজিয়ার্স শহরে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনের সময় সৌদি আরবের রাজা ফয়জল ও লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি গদ্দাফি, শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেন বাংলাদেশের নাম “পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ” থেকে পরিবর্তন করে “ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ” করে দিতে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তা মানেননি। তিনি উত্তরে বলেন যে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। তাই এইরূপ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মজার ব্যাপার হল, তিনি চাইলেই কিন্তু ওরকম করতে পারতেন। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার দ্বারা তিনি চাইলে যা খুশি তাই করতে পারতেন। কিন্তু এখানেই তিনি স্বতন্ত্র। তিনি সেটাই করেছেন যা তাঁর নীতি, বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে মিলেছে। ঠিক সেই কারণেই এত বছর পরেও তিনি অবিস্মরণীয়, তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয়। তাঁর মতাদর্শ শুধু বাংলাদেশ নয়, বহু জায়গাতেই পাথেয়।
আমরা যখন শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনসংগ্রাম দেখি তখন উপলব্ধি করতে পারি তাঁর মানবতা ও কল্যাণকর চিন্তার ব্যপ্তি। যে লড়াইয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই মুক্তির লড়াই। মনে রাখতে হবে যে, যাদের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তারা কিন্তু তাঁর স্বধর্মাবলম্বী। এটাই প্রমাণ করে যে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মনুষ্যত্ব ও মানুষের কল্যাণ। যখন তিনি নবগঠিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি শুরু করলেন এক প্রয়াস যার দ্বারা সমস্ত নাগরিক স্বাধীনতার সত্যিকারের সুফল লাভ করতে পারে। শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন এক দ্রষ্টা। তাঁর দূরদৃষ্টিতে তিনি দেখেছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষতা সব ধরনের উন্নয়নের সহযোগী।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর সম্বন্ধে বিশ্বখ্যাত কিছু ব্যক্তিত্বের উক্তি প্রমাণ করে যে তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানকে কি চোখে দেখতেন। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, “I have not seen the Himalayas. But I have seen Sheikh Mujib. In personality and courage, this man is Himalayas.” (আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসে, এই মানুষটি হিমালয়ের মতন বিশাল।)
মুজিবুর রহমান ছিলেন বিরাট গণতন্ত্রবাদী। তাঁর স্বপ্ন ছিল এক সোনার বাংলাদেশ, যা দাঁড়িয়ে থাকবে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর। এর জ্বলন্ত উদাহরণ শেখ মুজিবুর রহমানের কথাতেই আমরা পাই। এ বিষয়ে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার যে, যখন ভারতবর্ষ ভাগ হচ্ছিল তখন শেখ মুজিবর রহমান “পূর্ব পাকিস্তান” নামকরণ না করে “পূর্ববাংলা” এই নামকরণের পক্ষে ছিলেন। তিনি এখানেও বাঙালি সত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। আবার ১৯৫৫ সালে 2৫ শে আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন, “We have demanded so many times that you should use the word ‘Bengal’ instead of ‘Pakistan’. The word ‘Bengal’ has a history, a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted.” (আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে আপনারা ‘পাকিস্তান’ না বলে ‘বাংলা’ বলে উল্লেখ করুন। ‘বাংলা’ শব্দটির একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন।) এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে শেখ মুজিবুর রহমান কত বড় প্রজাতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। একটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় না যে, বিবিসির করা একটি জনমত সমীক্ষার ভিত্তিতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন। আসলে শেখ মুজিবর রহমান তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবিকতা ও রাজনৈতিক উদারীকরণের মধ্যে দিয়ে সর্বযুগের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী হিসেবে চিরকাল থেকে যাবেন। তাঁর জীবন ও দর্শন চিরকালীন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থেকে যাবে।
লেখকঃ সন্দীপ ব্যানার্জি, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট(কলকতা)
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ