লেখকঃ সন্দীপ ব্যানার্জি,  শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট(কলকতা)
আমরা আজ কোন পৃথিবীতে বাস করছি? একি আমাদের চেনা জগৎ? সকলের কাছেই উত্তর হবে না মানুষ আসলে সামাজিক জীব। সে একা বাঁচার পক্ষে নয়। তাই পরিবার থেকে সমাজ সব জায়গাতেই মানুষ সঙ্গী চায় অথচ বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক তার বিপরীতপন্থী। এখানে দূরত্ব আবশ্যক হয়ে উঠেছে সবার ভালো থাকার জন্য। করোনা তাড়িত পৃথিবী অনেক সামাজিক নিয়মের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল। এত দিন যা-যা কাম্য ছিল, সেগুলো এখন সাময়িকভাবে হলেও ত্যাজ্য। যে অতিমারির মধ্যে দিয়ে গোটা পৃথিবী চলেছে, তা শুধু মানুষের জীবন হানিকর নয়, তা মানুষের জীবিকাও কেড়ে নিচ্ছে।

মানুষ জীবনও জীবিকার সংঘাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে দিন কাটাচ্ছে। সাধারণত মানুষ জীবন নির্বাহ করে জীবিকার সাহায্যে।কিন্তু যদি এরকম হয় যে জীবন ও জীবিকা একে অপরের পরিপন্থী হয়ে উঠছে! ভাবুন তাহলে, মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পড়বে।আর এখন ঠিক তাই ঘটছে বলে আমরা যেমন এক দিকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হচ্ছি, অন্য দিকে তেমনি সেই দূরত্ব বজায় রেখে, জীবিকার ব্যবস্থা করে, জীবন কাটা বকি করে সেই নিয়ে নিরন্তর ভেবে চলেছি। মানুষের মৃত্যু মিছিল আজ রোজ নামচা।

চারদিকে উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তা, সবাই অসহায় ভাবে দিন কাটাচ্ছে আর ভাবছে যাক্, আজকের দিনটা তাহলে কেটে গেল! কিন্তু অনেকেই এমন আছেন যারা সেই দিনটা কি করে কাটবে, তা নিয়ে নিশ্চিত নয়। একদিকে সবার প্রাণের ভয়, আবার অন্য দিকে সেই প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে আর্থিক সংগতি প্রয়োজন তা নিয়ে সংশয়।এ যেন এক বিশাল সমুদ্রে দোদুল্যমান একটা তরী- কোথায় যাবে, কোন দিকে যাবে, কিভাবে যাবে কোনো ঠিক নেই।জীবনের অভিমুখ তার নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে একটি ব্যাধির দ্বারা।

আমাদের এই মারণব্যাধির হাত থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। কিন্তু তাতেই কি শুধু বেঁচে থাকা নিশ্চিত হবে? জীবনযাপনের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তা কোথা থেকে আসবে? অধিকাংশ মানুষই যেখানে রুজি-রোজগারের নিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তিত তখন জীবন চলবে কি করে! একটা জিনিস মনে রাখা দরকার- করোনা যে থাবা আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপর বসিয়েছে, তার প্রভাব সুদূর প্রসারী। এই প্রভাব যেভাবে প্রথম বিশ্বের মানুষকে আক্রান্ত করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আক্রান্ত করছে তৃতীয় বিশ্বকে। বেকার সমস্যা, কাজ হারানো- সারা পৃথিবীকেই গ্রাস করলেও, তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যেহেতু এই করোনা মুক্তি বাতার প্রতিষেধক কবে পাওয়া যাবে তা আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারি না, তাই এই কঠিন পরিস্থিতি চলতেই থাকবে।

করোনা থেকে বাঁচার একটা বড় অস্ত্র হল শারীরিক দূরত্ব। কিন্তু এই দূরত্ব আর একটা অন্য দূরত্ব তৈরি করছে- বেঁচে থাকা ও কিভাবে বেঁচে থাকব এই দুইয়ের। অবশ্যই সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলোর অনবরত সাহায্য চলছে। কিন্তু তা কি যথেষ্ট? কারণ, এ তো রোজের বাঁচার লড়াই। লক্ষ-লক্ষ লোক নিশ্চিত ও অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে, দৈনিক খবরের কাগজে আমরা দেখেছি যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা তাদের পরিবারকে নিয়ে হেঁটে চলেছে সে দৃশ্য ভীষণ দুঃখের ও বেদনার। ছোট্ট বাচ্চা সাইকেলে চেপে বাবার সঙ্গে মাইলের পর মাইল রাস্তা অতিক্রম করছে, শিশু তার মৃত মায়ের শরীর জড়িয়ে কাঁদছে, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শ্রমিক রেললাইনে শুয়ে পড়েছে এবং ট্রেনের তলায় জীবন হারিয়েছে- এ সবই ঘটেছে জীবন ও জীবিকার সংঘাতের ফলে। সবচেয়ে বড় কথা, যে সব শ্রমিকরা বিভিন্ন জায়গায় কাজের তাগিদে ঘর ছেড়ে ছিল, তারা যখন ফিরে আসছে তখন তাদেরও তাদের পরিবারকে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাদের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী তাদেরকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারছে না। দুর্ভাগ্যবশত, এই সব শ্রমিকেরা বহু ক্ষেত্রে করোনা বাহক হয়ে উঠছে এবং সামাজিক সংক্রমনে সাহায্য করছে, নিজেদের অজান্তেই।

তৃতীয় বিশ্বের, বিশেষত ভারতীয় উপমাদেশের অনেকটা জায়গা জুড়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের চল।এই সব শ্রমিকরা সংখ্যায় বিরাট। কিছু জায়গায় তারা কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৭০ ভাগ। এরা আজকের দিনে সব থেকে বিপাকে।তাদের বর্তমান কর্মক্ষেত্র সংকুচিত বা বন্ধ, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তারা জানে না বর্তমানে কি ভাবে জীবন চলবে বা ভবিষ্যতে তারা কি করবে।

প্রাণের দায়ে তারা ঘরে বসে আছে, আবার ঘরে বসে থাকলে না খেতে পেয়ে পরিবার নিয়ে পথে বসার সম্ভাবনা।যারা দৈনিক মজুরি হিসেবে কাজ করে, তাদের দৈনিক কাজ করাটাই সমস্যা। করোনার এই সমস্যা হঠাৎ করে চলে যাবার নয়।সারা পৃথিবীতে দক্ষ ও অদক্ষ- দুই শ্রেণীর শ্রমিকেরই চাকরী নিয়ে টানাটানি চলছে। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হলেও, যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, বিশেষত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, তা সহজে ও তাড়াতাড়ি মেটার নয়। বরঞ্চ, একটা চিরস্থায়ী ক্ষতির সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। যেহেতু বেশির ভাগ জায়গাতেই রাষ্ট্র দ্বারা কর্মসংস্থান পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত নয়, তাই শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ও নিশ্চিত নয়।বাজার অর্থনীতির চাহিদা ও যোগানেরও পরনির্ভরশীল। যদি মানুষের হাতে টাকা না থাকলে ক্রয় ক্ষমতা কমবে, আর তার সঙ্গে কমবে চাহিদা। চাহিদা কমলেই কর্মসংকোচন হতে বাধ্য। পুরোটাই একটা ক্ষতিকর চক্র। এ থেকে বেরোনো সহজ নয়।

অর্থনৈতিক সমস্যা থেকেই ব্যাপ্ত হয় বিভিন্ন ধরনের অন্যান্য সমস্যা যা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিককেও প্রভাবিত করে।সমাজের এক স্তর ভালো থাকবে, আর বেশির ভাগ লোক অভাবে থাকবে, এটা সুস্থ সামাজিক অবস্থার লক্ষণ নয়।তাই শুধু কিছু লোকের অর্থনীতি গোটা সমাজের মুখ নয়। মনে রাখতে হবে, যারা আজকে কাজ হারাচ্ছে তারা ভবিষ্যতে কাজ ফিরে পাবে এরকম কোনো নিয়ম বা নিশ্চয়তা নেই। এরা সবাই দুই পৃথিবীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে- একটি মৃত, আরেকটি জন্ম নিতে অক্ষম।গোটা সমাজ এমন এক দোলাচালের মধ্য দিয়ে চলেছে যার থেকে সামাজিক সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। শিশুরাও এর থেকে মুক্ত নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি বিরাট বিপদ আঁচ করা হচ্ছে। শ্রেণি ভিত্তিক পঠন-পাঠনের কোনো সুযোগ এখন না থাকায়, ছাত্রদের অনলাইন বা ই শিক্ষার ও পরনির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু ই-শিক্ষার সুফল তোলার জন্য যা দরকার- একটি কম্পিউটার বা কমপক্ষে একটি স্মার্টফোন, তা সব ছাত্রের বাড়িতে নেই।

স্মার্টফোন থাকলেও পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই ফোনের ইন্টারনেট পরিষেবা রিচার্জ করার অর্থ জোগাড় হচ্ছে না। এই রকম বেশি দিন চললে, যে সব ছাত্ররা অনলাইন শিক্ষা নিয়মিত ভাবে গ্রহণ করতে পারবে না তারা শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে যাবে। ফলে একটি বৃহৎ সংখ্যক স্কুল ছুট তৈরি হবে। বহু পরিবারে অর্থের অভাবে ছাত্ররা, বিশেষত একটু নিচু শ্রেণীর, কাজের খোঁজে পড়াশোনা ছেড়ে দেবে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হব।আর শিক্ষার ক্ষতি মানে তা আসলে জীবন ও জীবিকা- দুইয়েরই ক্ষতি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্ব এমন সংকট আর দেখেনি। এখন “জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ”- সেই অবস্থা।মানুষ এমন এক ভীতির মধ্যে বাস করছে যে সামাজিক দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছে অনেক সময়।আমরা শুনতে পাচ্ছি যে করোনা আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে মানসিক ও সামাজিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এই যে মানসিক ব্যবচ্ছেদ, তা কোনো ভাবেই আমাদের সাহায্য করবে না।করোনা আমাদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বাড়াক, কিন্তু মানসিক দূরত্ব যেন না বাড়ায়। জীবন যুদ্ধে যারা আজকে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে, যাদের জীবিকার রাস্তা ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে উঠছে- তাদের জন্য সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।আজ আমাদের সবাই মিলে জীবনের এই কঠিন লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হবে।

মানুষ যুগ যুগ ধরে অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠেছে।বর্তমানের এই সংঘাত মানব সমাজকে অনেক কিছু অন্য ভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। জীবিকার তাড়নায় মানুষকে অনেক কিছু করতে হচ্ছে, কারণ অনেকের জীবিকার পথই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।এটাও জীবন ও জীবিকার টানা পোড়েন। সব দিক থেকে আমরা একটা ঘেরা টোপের মধ্যে আছি। আছি একটা বাঁধনের মধ্যে যা থেকে আমরা নিজেদের ইচ্ছে মতন বেরোতে পারছি না। কিন্তু এটা তো নিয়তি হতে দেওয়া যেতে পারে না!সকলকে তাই সমবেত ভাবে সকলের পাশে দাঁড়িয়ে সকলের ব্যথা অনুভব করতে হবে। আর এভাবেই আমরা ঘরে ও বাইরে করোনার সামাজিক প্রভাবের হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারব। জীবন না থাকলে জীবিকার কোনো মূল্য নেই, আর জীবিকা না থাকলে জীবন চলবে না।এই দুইয়ের মধ্যে মেল বন্ধন ঘটানো সবচেয়ে কঠিন এবং তা করতে পারলে, তবেই করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই ফল প্রসূহবে সব দিক থেকে।

লেখকঃ সন্দীপ ব্যানার্জি,  শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট(কলকতা)
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্‌স নিউজ 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে