আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট (আইএমএলআই) যেন গতিহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা গবেষণা ও সংরক্ষণ এবং প্রচার-প্রসারের উদ্দেশে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ৯ বছর আগে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির নির্ধারিত ২৩টি কাজের মধ্যে মাত্র ৪টি পুরোপুরি এবং কয়েকটি আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্যে দেশে-বিদেশে বাংলা ভাষা প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা ছিল অন্যতম প্রধান কাজ।

পাশাপাশি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে নানা উদ্যোগও নেয়ার কথা। কিন্তু বিদেশে বাংলা প্রসারে অদ্যাবধি নেয়া হয়নি তেমন কোনো পদক্ষেপ। এছাড়া প্রায় ৬ বছর আগে ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’ করা হয়েছিল। এর ওপর দশটি গ্রন্থ প্রকাশের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত হয়েছে একটি। তবে নির্ধারিত কাজের মধ্যে যে চারটি বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভাষা বিষয়ে চারটি গবেষণা-জার্নালসহ বিভিন্ন প্রকাশনা; সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজনের পাশাপাশি প্রতি বছর পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এছাড়া ৩ বছর আগে বিভিন্ন ভাষার লিখনবিধির আর্কাইভ ও একটি ভাষা-জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। যদিও প্রচারের অভাবে সেখানে দর্শনার্থী নেই- এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

জানা গেছে, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি আইএমএলআই ভবনে অনেক সময়ই দাফতরিক কাজ করেন। সেখানে মাঝে-মধ্যে হয় মন্ত্রণালয়ের সভা-সেমিনার। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে গঠিত জাতীয় কমিটির কার্যালয় ভবনটিতে স্থাপন করা হয়েছে। এসব কারণে এক বছর ধরে সেখানে লোকসমাগম বেড়েছে। এর আগে স্থানটি অনেকটা নিরালা ভবনে পরিণত হয়েছিল। তবে আইএমএলআইর তৎপরতা অনেকটা ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিকই হয়ে গেছে। বাকি ১১টি মাসই অনেকটা ঝিমিয়ে কাটে। এ প্রতিষ্ঠানের জনবল সংকট তীব্র। ফলে প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারাই ভরসা।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির পাশে অবস্থিত মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট। মঙ্গল ও বুধবার- এ দু’দিন ওই ভবনে সরেজমিন দেখা গেছে, ভেতরে-বাইরে কয়েকজন মানুষ ভবন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত। চলছে একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাজসজ্জা।

প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ও অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট অন্যসব প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। ভাষার মতো একটি কঠিন বিষয়ের গবেষণা আর অন্য বিষয়ের গবেষণা সমান নয়। তাই সমীক্ষা হলেও তা চূড়ান্ত করে গ্রন্থ প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি আরও জানান, জনবলকাঠামোতে ৯৩ জন থাকলেও সব পদে এখনও নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। আসলে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য দরকার বিশেষায়িত জনবল। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তা তৈরি করে না। তাই এ ধরনের পদে নিয়োগ করা যায়নি। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন আছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট (আইএমএলআই) আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির জন্য ২৩টি সুনির্দিষ্ট কাজের কথা বলা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাভাষা প্রচার ও প্রসারে কার্যক্রম গ্রহণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা-প্রশিক্ষণের উদ্যোগ। বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা-আন্দোলনের বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেস্কোর সদস্য দেশগুলোতে প্রচার।

বাংলাভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে কার্যক্রম গ্রহণ। বিভিন্ন ভাষার উপাদান ডাটাবেসে সংরক্ষণ, অডিও ভিজ্যুয়াল পদ্ধতিতে বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত ভাষাগুলোকে দৃশ্যমান করা। বিভিন্ন ভাষার অভিধান প্রকাশ ও হালনাগাদকরণ এবং ভাষা ও বর্ণমালার আর্কাইভ নির্মাণ-পরিচালনা। সব ভাষারবিবর্তন বিষয়ক গবেষণা। ভাষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান-সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ। বিশ্বমানের লাইব্রেরি ও তাতে ভাষার ওপর লিখিত যাবতীয় বই, ব্যাকরণ রাখা। ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া চ্যানেল স্থাপন। ভাষা বিষয়ে গবেষণায় অবদানের জন্য বৃত্তি, ফেলোশিপ, পদক ও সম্মাননা প্রদান। একটি ভাষা-জাদুঘর ও আর্কাইভ পরিচালনা।

ভাষা বিষয়ে গবেষণা-জার্নাল প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালা আয়োজন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন। এর মধ্যে সম্মাননা দেয়ার জন্য জুনে একটি নীতিমালা মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। এতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ, চর্চা, প্রচার, প্রসারের জন্য আন্তর্জাতিক পদক দেয়ার কথা বলা আছে। প্রতি ২ বছরে জাতীয় ক্ষেত্রে দুটি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুটি পদক দেয়ার কথা। তবে এবার এ ধরনের কোনো পদক দেয়া হচ্ছে না বলে জানান মহাপরিচালক। এ প্রতিষ্ঠানটির ৯ বছরে অর্জন শুধু বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষিক অবস্থান নির্ণয় করা। ২০১৪ সালে এ কাজ শুরু হয়। সমীক্ষা শেষে ১০টি বাংলা ও ১০টি ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশ করার কথা ছিল। তবে এখন পর্যন্ত একটি প্রকাশ করা হয়েছে। আরও দুটি গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। ভাষাবিজ্ঞানীরা এক সময় মনে করতেন ২৭টি ভাষাভাষীর মানুষ বসবাস করেন এ দেশে। কিন্তু এ সমীক্ষায় বাংলাসহ ৪১ ভাষার মানুষ পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।এদিকে ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বিদ্যমান উল্লিখিত সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে ১০টির নিজস্ব লিপি আছে। এদের মধ্যে সরকার চাকমা-মারমাসহ ৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় বই দিয়েছে। আরও তিনটি ভাষায় ভবিষ্যতে বই দেয়ার চিন্তা চলছে।

আরও জানা গেছে, ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে বিদেশগামী বাংলাদেশিদের জন্য শিগগিরই বিদেশি ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু করা হচ্ছে। এছাড়া জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ ৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে শাঁওতালদের ভাষা সাদ্রী, ত্রিপুরাদের ককবরক এবং গারো ভাষায় ৭ মার্চের ভাষণ রূপান্তর করা হয়েছে। এছাড়া ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালায় লিপ্যন্তর এবং জাতির পিতার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণ ইশারা ভাষায় ও ব্রেইল লিখন-বিধিতে প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ বিকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এর মোড়ক উন্মোচন করবেন।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ওই ঘোষণার পর সরকার দেশে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।এরই অংশ হিসেবে ২০০০ সালের মাঝামাঝি ১৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট স্থাপন প্রকল্প’ সরকার অনুমোদন করে। ২০০১ সালের ১৫ মার্চ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ইন্সটিটিউট ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই বছরের অক্টোবরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর কিছুদিন ভবন নির্মাণ কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০৪ সালের শেষদিকে সরকার প্রকল্প সংশোধন করে নির্মাণকাজ শেষ করার উদ্যোগ নেয়।

সংশোধিত প্রকল্পের আওতায় ২০১০ সালে তিনতলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এরপর শুরু হয় এর পথচলা। শুরু থেকেই বর্তমান মহাপরিচালক দায়িত্ব পালন করছেন। দেখতে দেখতে এবার ১০ বছরে পদার্পণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও শুরুতে প্রকল্পে ১২ তলা একটি ভবন নির্মাণের কথা বলা ছিল। তার মধ্যে প্রাথমিকভাবে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। তাতে একটি মিলনায়তন, চারটি সম্মেলন কক্ষ, কম্পিউটার ল্যাব, মিউজিয়াম, আর্কাইভ, ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য ১০টি শ্রেণিকক্ষসহ প্রয়োজনীয় অফিস কক্ষের ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ কাজ হিসেবে ২০১৪ সালে ভবনের আরও তিনটি তলা নির্মিত হয়। /যুগান্তর
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্‌স নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে