আকস্মিক উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের নিম্নাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, ধানী জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। গত কয়েকদিন থেকে টানা বর্ষণে এবং পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় জনজীবনে ভোগান্তি সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও শাল্লা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল থেকেই ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে ঢল নামতে শুরু করে। সীমান্তের ওপারে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিস্টরা। দুপুরের দিকে তলিয়ে যায় বিস্তির্ন অঞ্চল। তলিয়ে গেছে এসব এলাকার জমির ফসল। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। অনেক বাসাবাড়িতেও ঢুকে পড়েছে পানি। পাহাড়ি ঢলে সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও শাল্লা উপজেলা।

সিলেট
উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় আকষ্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে পড়েছে এই দুই উপজেলার নিম্নাঞ্চল। এছাড়া জৈন্তাপুর উপজেলারও অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ঢলে তলিয়ে গেছে এসব এলাকার জমির ফসল। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট। অনেক বাসাবাড়িতেও ঢুকে পড়েছে পানি। সোমবার সকাল থেকেই ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে ঢল নামতে শুরু করে। দুপুরের দিকে তলিয়ে যায় বিস্তির্ন অঞ্চল। সীমান্তের ওপারে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিস্টরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রোববার রাত থেকেই ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল থেকে ঢল নামা শুরু হয়। ঢলের স্রোতে ভেঙে গেছে নদীরক্ষা বাঁধ। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গোয়াইনঘাট উপজেলা। সোমবার দুপুরের দিকে গোয়ানঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী রুস্তমপুর, পূর্ব জাফলং, পশ্চিম জাফলং, মধ্য জাফলং, গোয়াইনঘাট সদর ও পূর্ব আলীরগাঁও এবং পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনয়নের নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়ে পড়ে। ঢলে তলিয়ে যায় এসব এলাকার এলাকার রাস্তাঘাট। জাফলং বাজার, রাধানগর বাজার, লন্ডনী বাজার, বাংলাবাজার ও নতুন বাজারসহ উপজেলার কয়েকটি হাটবাজার এবং এসব এলাকার কিছু ঘরবাড়িতেও পানি ঢুকে পড়ে।

নদীর পানি উপচে তলিয়ে গেছে জাফলং-রাধানগর-গোয়াইনঘাট সড়কের জাফলং চা বাগান এলাকা। ফলে উপজেলা সদরের সঙ্গে পর্যটন কেন্দ্র জাফলংয়ের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে ডউকি নদীর প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের আসামপাড়া এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য নির্মিত বাঁধ। পানিতে তলিয়ে গেছে এসব উপজেলার বোরো ধান।

উপলো কৃষি কর্মকর্তার তথ্য মতে, ঢলে ৫ থেকে ৬শ হেক্টর পানি তলিয়ে গেছে। তবে স্থানীয়দের হিসেবে আরও তলিয়ে যাওয়ার জমির পরিমান আরও বেশি। রাধানগর এলাকার কৃষক আউয়াল মিয়া বলেন, ঢলে আমাদের এলাকারই প্রায় দুইশ হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। ঢলের যে স্রোত ছিলো তাতে উপজেলার বেশিরভাগ জমিই তলিয়ে যাওয়ার কথা। তবে গোয়াইনঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রায়হান পারভেজ বলছেন, এ পর্যন্ত ৫ থেকে ৬শ’ হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। তবে দুয়েক দিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ফসলের তেমন একটা ক্ষয়-ক্ষতি হবে না।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাহমিলুর রহমান বলেন, ভারী বর্ষণ ও ঢলের কারণে উপজেলার নি¤œাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে গেছে। ফসলি জমির পাশাপাশি বেশকিছু রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। ইতিমধ্যে আমরা বন্যা কবলিত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছি এবং সবকটি ইউনিয়নের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

ঢলে তলিয়ে গেছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলারও বিভিন্ন এলাকার জমির ফসল। সোমবার বিকেল পর্যন্ত উপজেলার ইসলামপুর পুর্ব, তেলিখাল, ইছাকলস ও দক্ষিণ রনিখাই ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। এসব এলাকার কয়েকটি সড়ক এবং কিছু বাসাবাড়িতেও পানি প্রবেশ করেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এই চার ইউনিয়নের প্রায় ৫শ’ হেক্টর জমিতে পানি প্রবেশ করেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

ইসলামপুর পুর্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর আলম জানান, চানপুর গ্রামে বাঁধ ভেঙে গিয়ে রংপুর, শিমুলতলা নোয়াগাঁও, মোস্তফানগর, ঢালারপাড়সহ আশপাশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক ঘরবাড়িতেও পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকার আধাপাকা ও কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার নিচু এলাকার জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে কি পরিমান জমি তলিয়েছে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুসিকান্ত হাজং বলেন, এখনও পর্যন্ত হাওরে পানি প্রবেশ করেনি। তবে কিছু নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। সোমবার দুপুরের পর থেকে জৈন্তাপুর উপজেলারও নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কাল পর্যন্ত ভালো ছিলো। আজ সকাল থেকে নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। দুপুর থেকে নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তবে কোন এলাকায় পানি ঢুকেছে বা কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার খবর এখন্ও পাইনি।

সিলেট জেলায় এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে জানিয়ে জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ কাজী মজিবুর রহমান বলেন, ঢলে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় কিছু ধানের ক্ষতি হয়েছে। তবে তা খুব বেশি নয়। দুইশ’ হেক্টরের মতো ডুবেছে বলে শুনেছি। তবে পুরো হিসেব এখন্ও পাইনি। তিনি বলেন, পাহাড়ে বৃষ্টি ও ঢল অব্যাহত থাকলে ক্ষতির পরিমান বাড়বে।

সুনামগঞ্জ
উজানের পানির চাপে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওরে নজরখালী বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে হাওরে ঢুকছে পানি। এতে ওই হাওরের প্রায় ৫ হাজার একর ফসিল ধানি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গত কয়েকদিনর বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাঠলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়া হাওরের সপ্তাহখানেক স্থানীয় কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষার চেষ্টার পর আজ শনিবার সকল ১১ টায় টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রবেশ মুখ নজরখালি বাঁধ ভেঙে গিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি প্রবেশ করে।

নজরখালী বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই অনায়াসেই টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি ঢুকে টাঙ্গুয়ার হাওরে আশপাশের বেশ কয়েকটি হাওরের বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোঃ আসাদ জামান। এদিকে নজরখালী বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি প্রবেশ করার খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক নজরখালী বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা( ইউএনও) মোঃ রায়হান কবির। তিনি বলেন, এটা মুলত টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি ঢুকার প্রবেশ দার, এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন বাঁধ নয়। এই বাঁধটি স্থানীয় কৃষকদের দাবির মধ্যে আগে টাঙ্গুয়ার হাওর উন্নয়ন কমিটি কে দিয়ে করা হত। কিন্তু এবার তাদের দাবীর মাধ্যমেই স্থানীয় কৃষকদের মাধ্যমে পি আই সি করে উপজেলা পরিষদ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামান্য কিছু বরাদ্দ দিয়ে বাঁধটি করা হয়। তবে বাঁধটি ভেঙ্গে যাওয়ায় নদীর পানি হাওরের প্রবেশ করছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে পানি প্রবেশ করার কারণে আশপাশের বেড়িবাঁধ কোন ক্ষতি হবেনা বাঁধ ভাঙ্গার আশংকা মুক্ত থাকবে।

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বাঘার হাওরে বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি প্রবেশ। তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের হাজার একর বোর ধানি জমি। কৃষকদের চোখের সামনেই ভেঁসে যাচ্ছে হাজার একর ফসলী জমি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতার বাহিরে হওয়ায় এই বাঁধটিতে দেওয়া হয়নি কোনো প্রকল্প। শুরু থেকেই বাঘার হাওরে প্রকল্প দেয়ার দাবী জানালেও পাউবো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

স্থানীয়রা সুত্রে জানা যায়, বাঘার বাঁধ এলাকায় প্রায় এক হাজার একর জমি রয়েছে। শুরু থেকেই এই এলাকায় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবী জানানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রকল্প না দিয়ে অপ্রয়োজনীয় জায়গায় প্রকল্প দিয়ে সরকারের টাকা লোপাট করছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) দাবী করছে সার্ভে টিমের ম্যাজারমেন্ট অনুযায়ী প্রকল্প দেয়া হয়েছে। যার ফলেই এই হাওরের বাঁধটি আওতার বাহিরে।

শাল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারি প্রকৌশলী (এসও) আব্দুল কাইয়ুৃম বলেন, আমাদের হাওর রক্ষা বাঁধ এখনো ভাঙ্গেনি। যেদিকে বাঘার হাওরে পানি প্রবেশ করেছে এটা আমাদের তালিকার বাহিরে। আর আমাদের আওতায় যে বাঁধগুলো রয়েছে সর্বক্ষন মনিটরিং করছি। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো বাঁধ শাল্লায় নেই।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টির সম্ভাবনা আগের চাইতে কম। তবে উজানে এখন বৃষ্টিপাত কম থাকলেও তা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এতে সিলেটের নিম্নাঞ্চলে বাড়তে পারে পানি। এতে করে সিলেটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে