মোস্তাকিম ভুঞা, কলামিস্ট।। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতিতে ‘কূটনীতি’ অনেক পরিচিত শব্দ, এর ব্যবহারও অনেক। কিন্তু ‘তথ্য কূটনীতি’ শব্দবন্ধের ব্যবহার অনেকের কাছেই অচেনা ঠেকতে পারে। কেউ কেউ বিস্মিতও হতে পারেন। তাদের জন্য বলি, ‘তথ্য কূটনীতি’কে আর্থনীতিক কূটনীতি, বাণিজ্য কূটনীতির মতোই কূটনীতির একটি আধুনিক শাখা মনে করতে পারেন। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কূটনীতিতে তথ্যের ব্যবহার বুঝাতেই এই শব্দ বন্ধের ব্যবহার করেছি।
কূটনীতিতে তথ্যের আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক- এই দুই ধরণের ব্যবহারকেই এই শব্দ বন্ধের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। কয়েক মাস আগে দেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকার সংবাদ বেশ নজর কাড়ে। একটি বিদেশি কোম্পানি দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছে, তাই নিয়ে এক বিস্তর প্রতিবেদন, প্রতিবেদনটি সম্ভবত প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশে থাকা সংশ্লিষ্ট দেশটির দূতাবাসের বরাত দিয়ে, কোম্পানিটি সম্পর্কে বেশ তথ্যবহুল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু একটি বিদেশি কোম্পানির সংবাদকে আমাদেরই একটি জাতীয় পত্রিকায় এতো গুরুত্ব দেওয়ার মানে সহসা বুঝতে পারিনি, বুঝতে পেরেছিলাম বেশ কিছুদিন পর। একটু পর্যবেক্ষণ করে লক্ষ্য করলাম, ওই বিদেশি কোম্পানিটি আমাদের দেশের বেশকিছু মেগাপ্রকল্পে ঠিকাদারির কাজ করছে- সামনে আরও কাজ পাওয়ার লক্ষ্যেই হয়তো এমন ইতিবাচক প্রচার। আর বিদেশি ওই দেশটি দূতাবাসের মাধ্যমেই তথ্য প্রচারণার কাজটি করতে ‘তথ্য কূটনীতি’র ব্যবহার করে।
বাংলাদেশে ‘তথ্য কূটনীতি’র এমন প্রয়াস যে শুধু ওই নির্দিষ্ট দেশটিই করছে তা নয়। আমাদের নিকট প্রতিবেশি একটি দেশও ‘তথ্য কূটনীতি’র ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। দেশটি প্রতিনিয়ত এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এদেশীয় গণমাধ্যমের আন্তর্জাতিক সংবাদগুলোয় একটু লক্ষ্য করলেই তা বেশ অনুধাবন করা যায়। আর যদি একটু পর্যবেক্ষণ বা ‘আধেয় বিশ্লেষণ’ করা যায় তবে ‘ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ ধরনের অবাক করা বিষয়টি বুঝতে পারবেন।
গণমাধ্যমের শিক্ষার্থী ও একজন ক্ষুদে সংবাদকর্মী হিসেবে শুরুতে এগুলোকে ‘পেইড নিউজ’ মনে হতো, কিন্তু নাহ্। পেইড নিউজ ধারণাটি এতো বিস্তৃত অর্থে বড্ড সংকীর্ণ। কারণ এখানে খুব বেশি ‘এজেন্ডা’ থাকে না, ছোট-খাট স্বার্থ বা আর্থিক লাভ থাকে। কিন্তু ‘তথ্য কূটনীতি’র মাধ্যমে প্রচারিত এমন কনটেন্ট বা আধেয়’র জন্য বিশাল অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়- আধেয়ের আকার, সংখ্যা ও এজেন্ডা দেখলে, তা খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়। কারণ এখানে যেমন ওই নির্দিষ্ট দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ‘এজেন্ডা’ থাকে; সেই সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও জড়িত থাকে। তাদের সকলের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ প্রচারণা আর দায়িত্বেই এগিয়ে চলে ‘তথ্য কূটনীতি’। বাংলাদেশকে উৎকণ্ঠিত করার মতো ওই প্রতিবেশি দেশের সংবাদের ‘আধেয় বিশ্লেষণ’ করলেই ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
সাংবাদিকতায় খারাপ সংবাদকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ভাল সংবাদ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ এই ধরনের সংবাদের কাটতি অনেক বেশি। অনলাইন সংবাদের ক্ষেত্রে এমন পূর্বানুমানকে আরও বেশি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রতিবেশি ওই দেশটির স্পর্শকাতর ইস্যুতে আমাদের দেশে মূল তথ্যকে পাশ কাটিয়ে তথ্য কূটনীতির রিং মাস্টারদের ইচ্ছায় সার্কাসের ভালুকের মতো অসংখ্য বাংলা/ইংরেজি কনটেন্ট আমাদের মিডিয়ায় ছড়াছড়ি-গড়াগড়ি খেতে থাকে। কিছু কিছু সংবাদ বিবরণী দেখলে খুব সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এই ধরণের আধেয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তারপরও প্রচারিত হচ্ছে। অনলাইন মাধ্যমের কারণে ‘তথ্য কূটনীতি’ কাজে লাগিয়ে এমন প্রচারণা আরও বেশি আকারে বিস্তৃতি পাচ্ছে। বেশ কিছুদিন চীন আন্তর্জাতিক বেতার শুনেছি। বেতারের প্রচারিত বেশ কিছু অনুষ্ঠানে চীনা কণ্ঠে বাংলা আওয়াজ ভেসে আসে। ওই বাংলা উচ্চারণ ‘তোঁতা পাখি’র মুখের বাংলা উচ্চারণের মতো মনে হলেও, শুনতে মন্দ লাগে না। আমরা অনেকেই কত কষ্ট করে বিদেশি ভাষা শিখি, দেশান্তরী হওয়ার খায়েশে। সেখানে চীনা হয়েও ‘তথ্য কূটনীতি’র স্বার্থে কষ্ট করে বাংলা বলে যাচ্ছে, বিনে পয়সায় বাংলায় মান্দারিন (চীনা ভাষা) শিখিয়ে যাচ্ছে- ভেবে বুকটা গর্বে ফুলে উঠে। আর এসব দেখে মাথায় কেবল ডেভিড কফ’র ‘অ্যাকালচারেশন’ (দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে শাসন করার নীতি) শব্দটিই চলে আসে।
ভূ-রাজনীতিতে ক্রমশ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে থাকা বাংলাদেশের গুরুত্বকে ত্বরান্বিত করেছে করোনা মহামারি, মহামারি না আসলে হয়তো বাংলাদেশ একটা সময় আন্তর্জাতিক মতমোড়লদের প্রত্যক্ষ নজরে আসত। সে যাই হোক, মহামারির এই বিশ্বে বাংলাদেশ যে ভূ-রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিস্ময় সৃষ্টি করতে যাচ্ছে এবং কূটনীতিক সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে- তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে নিজেদের আরও এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ‘তথ্য কূটনীতি’র জন্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারে। আর তা করতে পারলে একটা সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারকারী ‘থিংক ট্যাংক’ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবং কার্যক্রমে সমৃদ্ধ হবে দেশ। এর ফলে তথ্য কূটনীতি শুধু প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশগুলোর পাশার গুটি হয়ে থাকবে না; এই চতুরঙ্গের ছকে আমরাও নিজেদের খেলাটা শুরু করে দিতে পারি।
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ