আমার মাকে কখনো এই শাড়িটা আমি পরতে দেখি নাই। বারোহাত জর্জেটের ফুরফুরে শাড়ি, যেন আবিরের রঙে রাঙানো। গোলাপির সঙ্গে হলুদ মিশে রংগুলো গড়িয়ে পড়ছে নীলের উপর। তার মাঝে জানলার শিক গলিয়ে রোদের মতো উঁকি দিচ্ছে হালকা কমলা।
কলেজের পিকনিকে যাবো বলে মার আলমারি থেকে এই শাড়িটা বের করলাম।
মা বলল,- এই শাড়িটাই তোর ভালো লাগল?
-হ্যাঁ মা, কী সুন্দর শাড়িটা! তোমাকে তো কোনোদিন পরতে দেখি নাই!
-না, পরেছি শুরুতে…মানে মাঝে মাঝে পরি, দেখিস নাই হয়তো।
সন্ধ্যায় ফিরে এসে মাকে বললাম,
-জানো মা, সবাই এত পছন্দ করেছে এই শাড়িটা! কে কিনেছিল এইটা?
-কে আর কিনবে? আমার সব শাড়ি তোর বাবাই তো কিনে। আমি কি কখনো দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করেছি নাকি। যা এবার শাড়ি-টাড়ি বদলে খেতে আয়।
মার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি। পরদিন সকালে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়িটা না দেখে ছুটে এলাম মার কাছে।
-মা শাড়িটা ওয়াশরুমে নেই, তুমি কি দেখেছ?
মা একটু আনমনা হয়ে বলল,
-আমি তুলে রেখেছি। মোমেনা ধুতে নিলে হয়তো নষ্টই করে ফেলবে। তোর বাবার এইটা অনেক প্রিয় শাড়ি।
সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম এই শাড়ির সঙ্গে মার একটা প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। হয়তো কোনো বিশেষ দিনে বাবা কিনেছিলেন। হতে পারে, সেদিনটা ছিল মার জন্মদিন কিংবা বিয়েবার্ষিকী। আচ্ছা, এমনটা কি হয়েছিলো, বাবা শাড়িটা কিনে রঙিন কাগজে মুড়ে বালিশের তলায় রেখে দিয়েছিলেন। অনেক রাতে সংসারের কাজকর্ম সেরে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে মা নিজের ঘরে এসে দেখেন, বাতি নিভিয়ে বাবা ঘুম। খুব মন খারাপ নিয়ে বিছানায় এসেছিলেন। আজকের দিনটাও ভুলে গেল! পাশে শুয়ে বালিশে মাথা দিতেই কীরকম একটা কাগজের মচমচে শব্দ না? ব্যাপারটা কী বুঝতে চেয়ে মা বালিশের তলায় হাত দিয়ে অবাক! বাতি জ্বালিয়ে দেখেন বাবা মিটিমিটি হাসছেন। মোড়ক খুলে শাড়িটা মেলে মা বললেন,
-এ কী করেছ? এতো রঙিন শাড়ি আমি কি পরি? ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে না এখন?
-তাতে কী হয়েছে? অন্যদের সামনে পরতে না চাইলে, তুমি এই শাড়িটা শুধু আমার সামনে পরবে।
আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, মা সেদিন শাড়িটা পরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে সাজলেন। চুলে ফুল গুঁজে দিলেন। মায়ের অমন লাজুক মূর্তি দেখে আমারই কেমন লজ্জা করতে লাগল। এই শাড়িটা নিয়ে মায়ের এমন অনেক স্মৃতি থাকলে থাকতেও পারে। আমি তাই শাড়িটা আর কখনো পরতে চাইনি।
বাবা ছাপ্পান্ন বছর বয়সে চলে গেলেন। বাবার চেয়ে মা দশ কি বারো বছরের ছোটো হবেন। মা এরপর আর কখনো রঙিন শাড়ি পরেন নাই। আমরা ভাইবোনেরা রঙিন শাড়ি কিনে দিলে আলমারিতে তুলে রাখতেন। বাবা মারা যাবার তিন বছর না হতে না হতেই মা স্ট্রোক করে বিছানা নিলেন। সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে শুধু একটি নামই তাঁর মনে ছিল। তাঁর নিজের নাম, মরিয়ম।
ছেলে-মেয়ে কারো নামই মনে করতে পারেন না। বললেও ভুলভাল নাম বলেন। মেয়েকে ডাকেন ছেলের নামে, ছেলেকে মেয়ের নামে। আর তাঁর মনে আছে কেবল ছেলেবেলার গল্প। কবে সেই ছোটোবেলায় রিকশা থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন, সেই ব্যথা এখনও অনুভব করেন। কাউকে কাছে পেলেই বলবেন,
–কাল রিকশা থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার পায়ে একটু ওষুধ লাগিয়ে দে। ব্যথায় তো ঘুমাতে পারি না। আবার কখনও জানালা খুলে দিতে বলতে চেয়ে বলছে্ন – আমার পা খুলে দে।
সারাদিন আমরা ভাইবোনেরা মার এসব কথা নিয়ে রীতিমত গবেষণা করি। কোন কথার সূত্র ধরে কোন শব্দ বলছেন।
ধীরে ধীরে আমরা মার সীমিত শব্দ ভাণ্ডার থেকে তাঁর মনের কথা বুঝতে শিখে গেলাম। মাংসের রেজালায় ঘি কম হয়েছে বলতে চেয়ে যখন বলেন, এইটাতে গরু আর গাছ কম হয়েছে। আমরা ঠিক বুঝে যেতাম, ঘি আর ঝাল কম হয়েছে। আমরা তাঁর কথা বুঝতে না পারলে যতটা বিরক্ত হতেন, বুঝতে পারলে ততটাই খুশি হতেন। শিশুসুলভ হাসি চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ত, বুঝাতে পেরেছেন বলে।
বছর দুয়েক ফিজিওথেরাপি করে বেশ সেরে উঠলেন। ডান হাত-পা যা মোটেই নড়াচড়া করতে পারতেন না, ইদানীং ধরে ধরে হাঁটতেও পারেন, হাতও কিছুটা ব্যবহার করছেন। চিকিৎসায় স্মৃতি ফিরে পেতে শুরু করেছেন। কথা ভালোই গুছিয়ে বলেন। নামও ঠিকঠাক বলছেন সবার। ছেলেবেলা থেকে ফিরে এসে সবাইকে চিনতে শুরু করেছেন। এখন যদি আমরা গিয়ে বলি,
-মা, লায়লাখালাকে চিনতে পারছ?
-লায়লাকে চিনব না? তোরা কী শুরু করলি?
উলটা আমাদেরই ধমক খেতে হয়।
মা-বাবা দুজনের ঘরটি এখন একজনের ঘর হয়ে গিয়েছে। বাবা মারা যাবার পরও ঘরটি একইরকম ছিল। কিন্তু চিকিৎসার সুবিধার জন্য বড়ো খাটটি সরিয়ে ছোটো একটা বিছানা পাতা হল সেই ঘরে। ঘরের ড্রেসিংটেবিল সরিয়ে সেখানটাতে একটা ফ্রিজ এলো, ওষুধপত্র আর খাবার রাখতে সুবিধা হবে। বাবার জামা-কাপড়ের আলমারি সরিয়ে সেখানে চেয়ার পাতা হল। মা মন খারাপ করে চেয়ে চেয়ে দেখলেন, কিছুই বললেন না। শুধু মার শাড়ির আলমারি যথাস্হানে রয়ে গিয়েছে।
মা এখন আর সাদা শাড়িও পরেন না। ম্যাক্সি পরেন। মাঝে মাঝে মন চাইলে আজানের সময় একটা সাদা ওড়না মাথায় দেন। আমি সেই ওড়নাটা শুঁকে দেখি, এতে মার শাড়ির আঁচলের গন্ধ আছে কিনা। কিন্তু শাড়ির আঁচলের পান আর জর্দার সুগন্ধ ওড়নাতে পাই না।
যত চেষ্টাই করা হোক মা কিছুতেই হাঁটাহাঁটি করতে পছন্দ করেন না। বাথরুমে যাওয়া ছাড়া কিছুতেই বিছানা থেকে নামবেন না। অথচ ডাক্তার বারবার বলেন, হাঁটাহাঁটি করলে উনি সুস্থ থাকবেন। সবাই বার বার বলে ক্লান্ত। আত্মীয়স্বজন যাঁরা মাকে দেখতে আসেন তাঁদেরকেও আড়ালে ডেকে নিয়ে শিখিয়ে দেয়া হয়, মাকে হাঁটতে বলার কথা। প্রথম দিকে কিছু বলতেন না। পরে নিজেই বিরক্ত হয়ে বলতেন, অন্য কিছু বলো, নইলে আমাকে একা থাকতে দাও। আমার সব দেখা শেষ। এখন আর আমি হেঁটেহেঁটে কী দেখব! এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা।
আমাদের সত্তর কেজি ওজনের মা শুকিয়ে শুকিয়ে চল্লিশ কেজি হয়ে গেলেন। সবাই ভাবলাম ডায়াবেটিস হল কিনা। না, সেরকম কিছুই নয়। কেবল, কোনোকিছুই খেতে ভালো লাগে না। শুরুতে চামচ দিয়ে বাঁ-হাতে খেতেন, ডাক্তারের নির্দেশ মতো। ডান হাতে স্ট্রোকের পর থেকে জোর পান না বলে কিছু করেন না। কিছুদিন পর নিজের হাতে খেতে হবে বলে বলতেন, আমার খিদে পায় না। আমরা খাইয়ে দিতে চাইলে তবেই খেতেন। তাও খুব সামান্য। দুর্বলতার কারণে প্রায় পড়ে যান বিছানা থেকে নামতে গিয়ে। এত করে যে বলা হয়, একা একা বাথরুমে যেও না! কিন্তু কথা শুনবেন না। কাউকে ডাকবেনও না। শুধু একটা কাজ খুব আগ্রহ নিয়ে করেন, পান সেজে খাওয়া। পানগুলোকে খুব যত্ন করে ধুয়ে অনেকটা সময় নিয়ে সাজেন। তারপর এক গালে পুরে চিবুতে থাকেন। সেই সময় মার মুখখানি সুখী মানুষের মুখের মতো তৃপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁর নিজের একটা মোবাইল ফোন আছে, শুক্রবার হলেই ডাকাডাকি শুরু করেন ছেলেমেয়েদের। না যেতে পারলে রাগ করে ফোন করা বন্ধ করে দেন। পরের সপ্তাহে গেলে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করবেন তারপর বলবেন, -কেন এলি? আমাকে দেখার তো তোদের সময় হয় না।
এরপর মাকে একটা হুইলচেয়ার কিনে দেয়া হল যদি বিছানা ছেড়ে একটু বাইরে ঘোরাঘুরি করেন। দুদিন খাবার ঘরে এসে সবার সঙ্গে খেলেন। তিন দিনের দিন আবার সেই বিছানাতেই বসে থাকেন। আমি বলি,- মা তোমার ইচ্ছে করে না ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরেটা দেখতে?
-নারে বাপু, আমার কিছুই দেখতে মন চায় না। এখন চলে যেতে পারলেই ভাল লাগবে। আমার বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করে না।
– তোমার প্রিয় রান্নাঘর, সেখানেও যেতে মন চায় না?
-না। আমি তো এখন রান্না করতে পারব না, দেখে কী করব?
ছুটির দিনে মাকে দেখতে গেলাম। বললেন,- আমার আলমারিটা খোল।
– কেন কী হবে?
– সবাই এক এক করে আমার শাড়িগুলো নিচ্ছে, তুইও এখান থেকে একটা নে।
– নিয়ে কী করব মা?
– নে, আমি যখন থাকব না এইটা তোর ছেলেমেয়েদের দেখাবি।
– কী সব যে বলো তুমি!
আলমারি খুলে বললাম,
-কোনটা নেব তুমি বলো?
-ওই যে নিচের দিকে একটা শাড়ি আছে ওটা নে।
মাকে দেখাই এটা ওটা… সবটাতেই বলেন, না না এটা না, ওটা না।
মা বিরক্ত, আমি ক্লান্ত। কোন শাড়িটা মা আমাকে দিতে চান বুঝতে পারছি না।
অবশেষে ঠিকঠাক মতো হাত গেল শাড়িটায়। মা খুশি হয়ে বললেন, এইটাই তো এতক্ষণ চাচ্ছিলাম।
এই সেই শাড়ি, কলেজে থাকতে পিকনিকে যেটা পরেছিলাম।
মা আজ নেই। তাঁর দেয়া সেই শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে আছি। শাড়িটার রং ঠিক তেমনি আছে …একটা রং থেকে আর একটা রং গড়িয়ে পড়ছে, আর আমি দেখতে পাচ্ছি, রংগুলোর সঙ্গে গড়িয়ে পড়ছে বাবার জন্য মার প্রেম।