দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় বিভিন্ন ‘চরমপন্থী’ গ্রুপের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে র্যাব ও পুলিশ। বাংলাদেশে রোববার সিরাজগঞ্জে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিন শতাধিক চরমপন্থি সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, এরা সবাই সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, কুষ্টিয়া, পাবনা ও মেহেরপুর এবং রাজবাড়ী জেলার সর্বহারা বা বিভিন্ন চরমপন্থি দলের সদস্য।
র্যাবের আয়োজনে সিরাজগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তারা দুই শতাধিক অস্ত্রশস্ত্রও জমা দিয়েছে। এসব বাহিনীর মধ্যে রয়েছে এলএম লাল পতাকা বাহিনী, জনযুদ্ধ ও সর্বহারা পার্টির লোকজন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণ, আইনগত সহায়তার মাধ্যমে এই চরমপন্থিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। র্যাব ১২’অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন বলেছেন, এই চরমপন্থিরা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান বলে সোর্সের মাধ্যমে র্যাবের সাথে যোগাযোগ করেছেন। তারা যে ভুল পথে ছিলেন, তা থেকে স্বাভাবিক পথে ফিরে আসতে চান। তারা সুস্থ পথে ফিরে এলে এই এলাকার অপরাধ অনেক কমে যাবে। যারা আত্মসমর্পণ করছেন, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে,” বলেন মি. হোসেন। তবে যাদের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। অন্য ছোটখাটো মামলাগুলোকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ছয় শতাধিক সর্বহারা বা চরমপন্থি দলের সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। এর আগে ১৯৯৯ সালে দুই হাজার চরমপন্থি আত্মসমর্পণ করেছিল।
কীভাবে টিকে আছে সর্বহারা বা চরমপন্থিরা
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপরই সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, মেহেরপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী এলাকায় ঘাটি তৈরি করেছিল বামপন্থী চরমপন্থিরা। মার্কস-লেনিন বা মাওবাদী আদর্শের নামে সেই সময় ওই এলাকায় ১৫টির বেশি সংগঠন ছিল। তাদের নিজেদের মধ্যে যেমন সহিংসতা হতো, তেমনি সাধারণ অনেক মানুষ এসব বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আশির দশকে এই এলাকার (সিরাজগঞ্জ) কয়েকটি জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় সর্বহারা ও চরমপন্থিরা ঘাটি তৈরি করেছিল। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে অনেকে আলোর পথে ফিরে আসে। যারা আত্মসমর্পণ করছেন, তাদের আর্থিক সহযোগিতা থেকে সবরকম সহায়তা করা হবে বলে তিনি জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ‘কিন্তু কেউ যদি মনে করেন আমরা দুর্গম এলাকায় বসে থাকব, অপরাধ করব আর আপনারা ধরতে পারবেন না, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন’। সিরাজগঞ্জে র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তিন শতাধিক চরমপন্থি, গত দুই দশক ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের দমন করতে একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে। এতে এসব দলের শীর্ষ অনেক নেতা নিহত হয়েছেন। বিশেষ করে র্যাব গঠন হওয়ার পর নিয়মিত অভিযান চালানো শুরু হলে এসব দলের অনেক নেতা আত্মগোপনে চলে যান। র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নানা নামে এসব সংগঠন চাঁদাবাজি, হত্যা, ডাকাতির মতো নানা অপরাধ করছে। গত ২০ বছরে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া এলাকায় এসব সংগঠনের হাতে তিনশোর বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।
বাংলাদেশে বামপন্থী চরমপন্থি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি বলেন, অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশে আন্ডারগ্রাউন্ডে হলেও তারা সক্রিয় আছে। বাংলাদেশ সরকার কঠোর দমন নীতি নিয়ে তাদের দমন করার চেষ্টা করেছে। তবে শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কী কারণে তারা এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে, সেটা বের করা দরকার।পাবনার স্থানীয় সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, গত এক দশক ধরে প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে একাধিক চরমপন্থি দলের সক্রিয় থাকার তথ্য শোনা যায়। বিশেষ করে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের দুর্গম বিল বা চরাঞ্চল, টাঙ্গাইলের জঙ্গল এলাকাগুলো এদের তৎপরতা বেশি। মাঝে মাঝে নানা সংগঠনের ব্যাপারে হামলা বা চাঁদা চাওয়ার অভিযোগও ওঠে। সহজে অর্থ লাভের আশায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর অনেক বাসিন্দা এসব সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলছেন, সাধারণত চরমপন্থিরা একটা আদর্শগত বিশ্বাস থেকে এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়। কিন্তু সেই আদর্শগত জায়গায় এখন অনেক ভাটা পড়েছে। সেখান থেকে সরে তারা চাঁদাবাজি, খুনখারাবির মতো নানারকম অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে, যার মাধ্যমে তারা টাকাপয়সা অর্জন করতে পারে, বলেন তিনি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন ‘একটু অস্বাভাবিক’
কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জের সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এসব জেলায় খুব ছোট আকারে হলে বিভিন্ন চরমপন্থি বাহিনীর নামে চাঁদাবাজি বা ডাকাতি রকরা হয়। এসব বাহিনীর কাছে আদর্শগত বিষয় আর প্রাধান্য পায় না। বরং তারা নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে। তবে যশোরে একসময় এরকম বাহিনীর আধিপত্য থাকলেও গত কয়েক বছরে সেখানে তাদের নামে কোন কর্মকাণ্ডের কথা শোনা যায়নি।বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এসব চরমপন্থি বাহিনীর কর্মকাণ্ডের কথা খুব বেশি শোনা না গেলেও, হঠাৎ একসাথে এতজন ব্যক্তির আত্মসমর্পণ করতে আসাটা কিছুটা অস্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
বাংলাদেশে বামপন্থী বা চরমপন্থিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি বই লিখেছেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।তিনি বিষয়টিকে ‘একটু অস্বাভাবিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এলাকায় সত্তরের দশকে কিছু বামপন্থী দল থাকলেও এখন আর তারা নেই। অনেকেই দলছুট হয়ে চুরি-ডাকাতির মতো কাজ করতে শুরু করে। তাদের চরমপন্থি বলা যাবে না, তারা আসলে ক্রিমিনাল। অনেকদিন ধরেই ওই এলাকা মোটামুটি শান্ত তবে হঠাৎ করে এটা(একসঙ্গে এতজনের আত্মসমর্পন) করাকে অনেকটা পাবলিসিটি স্ট্যান্ড বলা যেতে পারে, তিনি বলছেন।
কেন পুরোপুরি দমন হচ্ছে না
২০০৪ সালে র্যাব গঠন হওয়ার পর থেকে তারা পুরোদমে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সেই সময় দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোয় র্যাব ও পুলিশের হাতে বিভিন্ন চরমপন্থি দলের কয়েকশো সদস্য নিহত হয়। এসব বাহিনী দাবি করেছে, তারা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে – ২০০৫ সালে ঢাকা থেকে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোফাখখার চৌধুরীর ‘ক্রসফায়ার’, ২০০৮ সালে নিষিদ্ধ সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল জনযুদ্ধ) নেতা আব্দুর রশীদ মালিথা বা দাদা তপন। একই বছরে আরও নিহত হয়েছিলেন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল লাল পতাকা) নেতা ডা. মিজানুর রহমান টুটুল। চরমপন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন নেতা নিহত হওয়ার পর থেকে ওইসব সংগঠনের প্রকাশ্য তৎপরতা খুব একটা দেখা যায়নি।
গবেষকরা বলছেন, যেভাবে চরমপন্থিদের দমন করার চেষ্টা করা হয়, সেটা ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণেই এই প্রবণতা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলছেন, সরকার শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইছে। কিন্তু যত শাস্তিই দেয়া হোক না কেন, তাদের জড়িত হওয়ার কারণ খুঁজে বের করে সমাধানের ব্যবস্থা না করা হলে এটা থেকেই যাবে। অভিযোগ রয়েছে, আত্মসমর্পণের কিছুদিন পরে অনেকে পুনরায় চরমপন্থি দলে ফিরে গেছেন। গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, প্রত্যাবাসনের কথা বলা হলেও পরবর্তীতে অনেক সময় আমরা দেখেছি, তারা আবার পুরনো পেশায় ফিরে যাচ্ছে। এটা টেকসই না হওয়ার কারণ হলো, যাদের ডাকাতি পেশা, তারা সেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। দ্বিতীয় হলো, তাদের খেয়ে পড়ে বাঁচার মতো কর্মসংস্থান বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। ফলে তারা আবার পুরনো পেশায় ফিরে যায়। তিনি বলেন, তাদের রাজনৈতিক কোন নীতি নেই। আট দশ জন ডাকাতের মতোই তারা কাজ করে। বরং অনেক ডাকাতও সর্বহারা শ্লোগান দিয়ে ডাকাতি করে। সিরাজ শিকদার এবং মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপগুলোর নেতারা নিহত বা মারা যাওয়ার পরে তাদের দলগুলো একাধিক গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। এদের কোন কোন গ্রুপ পরবর্তীতে ডাকাতি, চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে।/বিবিসি বাংলা থেকে