ইয়াং ওয়েই মিং,বেইজিং|| “শাংশু”-র ইতিহাস দুই সহস্রাধিক বছরের। “শাংশু”-র অর্থ হলো ‘প্রাচীনকালের বই’। এটি “রাজনৈতিক বইয়ের পূর্বপুরুষ এবং ইতিহাসের বইয়ের উৎস” হিসাবে পরিচিত। এটি প্রাচীন সভ্যতার কাঠামো তৈরি করেছিল তাই, এটি সবার আগে বিদেশী ভাষায় অনূদিত প্রাচীনতম চীনা ক্লাসিকগুলির অন্যতম। একজন ব্রিটিশ চীনবিশেষজ্ঞ মার্টিন পালমার “শাংশু” অনুবাদ করতে আগ্রহী। তিনি একবার বলেছিলেন: “আপনি ‘শাংশু’ না-পড়লে, আজকের চীনকে বুঝতে পারবেন না।”
“শাংশু”-তে মোট ৫৮টি অধ্যায় রয়েছে, যা কালানুক্রমিকভাবে সাজানো এবং চারটি ভাগে বিভক্ত: “ইউ শু”, “শিয়া শু”, “শাং শু” এবং “চৌ শু”। প্রাচীনরা বিশ্বাস করত যে, “শাংশু” প্রাচীনকালের দেশ পরিচালনার মৌলিক নিয়ম ও অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ আছে। “শাংশু” এবং এর মধ্যে থাকা দেশ শাসনের আদর্শ দীর্ঘকাল ধরে চীনা সভ্যতার জন্য অফুরন্ত শক্তির উৎস ছিল।
“ইয়ু গং” অধ্যায় এ কথা দিয়ে শুরু হয়: “禹敷土,随山刊木,奠高山大川”,যার অর্থ, প্রাচীনকালের রাজা ইয়ু ভূমির সীমানা বিভক্ত করেছিলেন, তিনি উঁচু পাহাড়ে হেঁটেছিলেন, গাছ কেটে রাস্তার চিহ্ন সাজান এবং উঁচু পাহাড় ও নদী দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের সীমানা চিহ্নিত করেছিলেন। ইয়ু হল হুয়াং সম্রাটের বংশধর। তাদের সময়ে হলুদ নদীতে প্রায় বন্যা হতো। ইয়ু তার বাবা কুনের পানি অবরোধের প্রচেষ্টার ব্যর্থতার থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে তা পরিবর্তন করে, বন্যাকে নদীর মধ্যে মিলানোর পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন। ইয়ু ১৩ বছর ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তিন বার নিজ বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যান, কিন্তু বাড়িতে ঢুকেননি। এমনই ছিল তাঁর ব্যস্ততা। অবশেষে তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। বন্যা নিয়ন্ত্রণে ইয়ু দারুণ অবদান রেখেছিলেন এবং সম্রাট শুন তাকে তার সিংহাসন দিয়েছিলেন। ইয়ু আদিবাসীদের নেতা হয়েছেন এবং জনগণের সমর্থন ও ভালবাসা পেয়েছেন।
ইয়ু বন্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে স্থানীয় অবস্থা পরিদর্শন করেন এবং সভ্যতার প্রচার করেন। তিনি তখনকার চীনকে ৯টি রাজ্য হিসেবে বিভক্ত করেন এবং তাদের নামকরণ করেন। সে নামগুলোর কোনো কোনোটা আজও ব্যবহার করা হচ্ছে। তার প্রচেষ্টায়, হুয়াশিয়া সভ্যতা অর্থাৎ চীনা সভ্যতা একটি বড় ভূমির আওতায় বিস্তৃত হয়েছে এবং চীনা সভ্যতার এক বিশ্ব গঠিত হয়েছে।
“শাংশু”-এ বিভিন্ন রাজবংশের পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। যেমন, “মু শি” (অর্থাৎ মু অঞ্চলের শপথ) অধ্যায় চৌ রাজবংশের উ রাজা মুয়ে অঞ্চলে শাং রাজবংশের জৌ রাজার সাথে যুদ্ধের গল্প বলা হয়েছে।“称尔戈,比尔干,立尔矛,予其誓” অর্থাত, তোমার ছোরা ধর, তোমার ঢাল সারিবদ্ধ কর, তোমার বর্শা দাঁড় করাও, এবং আমি যুদ্ধের শপথ উচ্চারণ শুরু করতে যাচ্ছি। মাত্র কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে মানুষ অপ্রতিরোধ্য শক্তি অনুভব করতে পারে। এখানে শুধুমাত্র চৌ রাজবংশের রাজা উ-এর জৌ রাজবংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করা হয়নি, বরং রাজা উ কেন জৌ রাজাকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন, তার কারণগুলিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শাং রাজবংশের রাজা জৌ নৃশংসভাবে শাসন করতেন। তিনি মানুষের জীবন-মৃত্যুর পরোয়া না করে শুধুমাত্র নিজের আনন্দের কথা চিন্তা করতেন। তিনি প্রাসাদ তৈরি করতেন, খাদ্য শোষণ করতেন এবং জনগণকে দমন করার জন্য বিভিন্ন অত্যাচার করতেন। যার কারণে মানুষ প্রচুর অভিযোগ করতেন। অবশেষে, যুদ্ধক্ষেত্রে, শাং রাজবংশের সৈন্যরা একের পর এক তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়, যার ফলে শাং রাজবংশের পতন ঘটে।
“শাংশু”-তে বলা হয়েছে, 民惟邦本,本固邦宁”, যার অর্থ হলো জনগণই দেশের ভিত্তি, এবং ভিত্তি মজবুত হলেই দেশ শান্তিপূর্ণ হতে পারে। চীনের ইতিহাসে এই প্রথম “জনমুখী” ধারণাটি সামনে আনা হয়েছে। “শাংশু” এর অনেক অধ্যায়ে দেখা যায় যে, রাজনীতিবিদরা “জনগণই রাষ্ট্রের ভিত্তি” এবং “জনগণের সমর্থন রাষ্ট্র শাসনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ” ধারণাটি মেনে চলেন এবং দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে এ ধারণাটি দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করেন।
“জনমুখী” হবার চিন্তাধারা “শাংশু” থেকে শুরু করে চীনের দীর্ঘ ইতিহাসে, উত্তরাধিকার হিসেবে বিকশিত হয়েছে এবং একটি বিশাল প্রভাব ফেলেছে এবং মহান শক্তি নিয়ে এসেছে। পশ্চিমে অনেক দুর্গ বা কেল্লা আছে, কিন্তু চীনে রয়েছে মহাপ্রাচীর। কেন মহাপ্রাচীর হাজার হাজার মাইলজুড়ে বিস্তৃত? কারণ, এর সৃষ্টি মানুষকে রক্ষা করার জন্য। পশ্চিমের দুর্গে শুধু দুর্গের মধ্যে অভিজাতদের রক্ষার জন্য। আর মহাপ্রাচীর সকল মানুষকে যুদ্ধের শিকার হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য।
“শাংশু” শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকা রাজাদের জন্যই পরামর্শ দেয় না, ব্যক্তিগত চরিত্র উন্নতির জন্য অনেকগুলি পরামর্শও দেয়। যেমন,“与人不求备,检身若不及” এর মানে হল যে, আপনি সবকিছুর জন্য অন্যকে দোষারোপ করবেন না, সবসময় মনে রাখবেন যে, আপনার নিজেরও কিছু ত্রুটি রয়েছে।“不矜细行,终累大德;为山九仞,功亏一篑”,এর মানে হল: আপনি যদি সূক্ষ্ম আচরণে মনোযোগ না দেন, তবে শেষ পর্যন্ত আপনার নিজের গুণের ক্ষতি হবে। যেমন, উঁচু পাহাড় নির্মাণ করতে চাইলে, শেষের এক ঝুড়ি মাটি ছাড়াও চলবে না। এ ছাড়াও আছে“满招损,谦受益”, যার মানে, আত্মতুষ্টি ক্ষতি করে, এবং বিনয় কল্যাণকর। “有容,德乃大”, যার অর্থ হল: সমস্ত কিছু সহ্য করে এমন মন দিয়েই ব্যক্তি চরিত্র মহত হতে পারে।“克勤于邦,克俭于家”, যার মানে: দেশের জন্য কঠোর পরিশ্রম করা উচিত এবং মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। এসব কথা ইতিমধ্যে চীনা মানুষের অনুসরণ করা নৈতিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।
কনফুসিয়াস বলেছিলেন, “‘শাংশু’ পড়ে আপনি পুর্বপুরুষদের শাসনের মৌলিক নিয়ম জানতে পারেন, রাজবংশের উত্থান ও পতনের কারণ জানতে পারেন এবং ব্যক্তিগত চরিত্র লালনের কথা জানতে পারেন।” “শাংশু” চীনা জাতির জন্য একটি আশীর্বাদ। আমরা কোন খান থেকে এসেছি, তা জানা থাকলে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজতর হয়। আশা করি, আপনিও এ বই থেকে কিছু শিখতে পারেন। সূত্র: চায়না মিডিয়া গ্রুপ।