লেখক- কাজী সানজিদা রহমান
‘আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাধা সমুদ্র আছে সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙ্গার কুঠার হলো বই’ -উক্তিটি বিশ্ব নন্দিত লেখক ফ্রানৎস কাফকা’র। আত্মার মাঝে জমে থাকা সকল দুঃখ, আনন্দে ভেসে যাওয়া ও জেগে উঠা’সহ সকল কিছুই অন্তর্নিহিত হয় একটি বইয়ের মাধ্যমে।
বই পড়ে পাঠক যে আনন্দ ও দুঃখ পান পৃথিবীর আর কিছুতে এই বোধের সৃষ্টি হয় না। নানান ধরনের বই পৃথিবীর নানা রকমের মানুষের মনের খোরাক যোগায়। গভীর দৃষ্টি দিয়ে পড়লে, মনের মত করে দুঃখকে হৃদয়ঙ্গম করা যায়, উপলব্ধি করা যায় বইয়ের পাতার প্রতিটি শব্দের মর্মার্থ। বই পড়লে দৃশ্যের চরিত্রগুলোকে চিত্রায়ন করা যায় খুব সহজেই, তাতে করে মনের যুগান্তকারী বিকাশ ঘটে আর বিকাশ ততোই ঘটবে যতই বই পড়বে।
বলছিলাম একটি লাইব্রেরির কথা, যেখানে একসময় ছিল ময়লা আবর্জনার স্তূপ, কখনো কখনো এক পাশে চলতো গাঁজার আসর। আর আজ সেখানে গড়ে উঠেছে একটি লাইব্রেরি, যাকে সবাই চেনে “উন্মুক্ত লাইব্রেরি” হিসেবে। এখানে বই পড়তে পারার অনিন্দ্য সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে ছোট-বড় সকলের জন্য। সবুজ, সুসজ্জিত রঙবেরঙ বসার বেঞ্চ, গাছের গুড়ি’র টেবিল, পাশেই চায়ের ব্যবস্থা। সকালের সোনালি রোদে বা পড়ন্ত বিকেলে চায়ের সাথে পাঠকদের সমন্বয়, অসাধারণ এক পরিবেশ তৈরি করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করার জন্য রাস্তার পাশে অথবা কোন রেস্তোরাঁর ধার দিয়ে কিংবা কোন গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে বই সাজিয়ে রাখা হয়, মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য। এমন কিছু বিষয়কে কাজে লাগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর হাসান সৈকত এবং তার বন্ধুরা মিলে প্রকাশ ঘটায় একটি নান্দনিক চিন্তার স্থান “উম্মুক্ত লাইব্রেরি”।
বই পড়ার এত দারুন পরিবেশ বিশেষ করে উন্মুক্ত পরিবেশে ঢাকায় খুঁজলে পাওয়া খুব দুরূহ হবে, কারন বর্তমানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। হতে পারে, তা সোশ্যাল মিডিয়ার সহজলভ্যতার কারনে। আর, আগ্রহ যেহেতু কমে গেছে সেহেতু এমন আধুনিক চিন্তাচেতনা নিয়ে এগোবার মানুষও কমে গেছে। তাই, ঠিক সেই সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে সৈকতরা শুরু করে “উম্মুক্ত লাইব্রেরি”র নতুন পথ চলা। যা, নতুনদেরকে নিয়ে সামনের দিনগুলোতে গড়ে উঠবে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ও দৃষ্টিনন্দন সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
মানুষকে বই মুখো করার জন্য উন্মুক্ত লাইব্রেরি যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে এমন উদ্যোগ নেওয়ার সামর্থ্য থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি, আর এই অনিন্দ সুন্দর কাজটি সফল করেছে তানভীর হাসান সৈকত ও তার বন্ধুরা। কাজেই সমাজের বইপ্রেমি পাঠকরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে আরও প্রাণবন্ত হবে ছোট্ট এই লাইব্রেরিটি। “উন্মুক্ত লাইব্রেরি” একদিন বাংলাদেশের তরুণদের কথা বলবে, তরুণদের উদ্যমের স্মৃতিফলক হিসেবে কাজ করবে। তাই, এই লাইব্রেরিতে ইতিমধ্যে অনেক নামজাদারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বই উপহার দিয়েছেন, সামনে আরও এমন শুনবো হয়ত একদিন অনেক বিখ্যাত মানুষ আসবেন এই লাইব্রেরির বই গুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে।
এই লাইব্রেরিকে শুরুতেই আমি বলেছিলাম এটি একটি শিক্ষাবান্ধব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ। হ্যাঁ ঠিক তাই, সন্ধ্যার পরে ছোট-ছোট আড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা গিটার বাজিয়ে গান করে, কেউ কবিতা পড়ে আবার জনপ্রিয় গায়ক বা লেখকের আড্ডায় মেতে উঠে। এমন সুন্দর, বিদ্বেষহীন মিলনমেলার আয়োজনে আমিও ছিলাম, আছি এবং থাকব। বলে রাখা দরকার, এবার’ই প্রথম এই লাইব্রেরির ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব-১৪২৮ এবং এটি আগামিতে চলতেই থাকবে যতদিন বেঁচে থাকবে উন্মুক্ত লাইব্রেরি।
তাই সকলের কাছে আবেদন, অনুগ্রহ করে বাচ্চাদের লাইব্রেরিতে বই পড়ার উপযোগী করে গড়ে তুলুন। দেশ, সংস্কৃতি এবং জাতি গঠনে ওরা একদিন সুপারসনিক গতিতে এগিয়ে যাবে, যদি ওদের মধ্যে জানার ও বোঝার আকুতি থাকে। আর এই আকুতি তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের ও আপনাদের। আর সহযোগিতার জন্য সেই পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে সৈকতদের মত মননশীল চিন্তাধারার তরুণরা।
প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন- “বই কিনলেই যে পড়তে হবে, এটি হচ্ছে পাঠকের ভুল। বই লেখা জিনিসটা একটা শখ মাত্র হওয়া উচিৎ নয় কিন্তু বই কেনাটা শখ ছাড়া আর কিছুই হওয়া উচিৎ নয়”। আমার এমন শখ করে কেনা অনেক বই আছে বইয়ের গন্ধে উন্মাদ হয়ে বই কিনতে ভালো লাগে। আসাব্বপত্রের মত দরকারি মনে করে একটি চিকন বই হলেও কিনুন এবং তা পড়ার জায়গা খুঁজুন, যদি তা হয় উন্মুক্ত লাইব্রেরির মত কোন জায়গা তাহলে সময় টুকু হবে হিরণ্ময়। তানভীর হাসান সৈকত এবং তার বন্ধুরা ভিন্ন কিছু করার জন্য এমন একটি জায়গাকে ওরা বেঁছে নিয়েছে, যে জায়গার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। যেখানে, ১৯৭১’সালের ৭’মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ৭’কোটি বাঙ্গালির উদ্দেশে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন ঠিক সেই উদ্যানের গেইটের সম্মুখে।
বঙ্গবন্ধুর ৭’মার্চের তর্জনীর একটি চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে লাইব্রেরীর একটি দিক। এ’ছাড়া রয়েছে, খুবই চমৎকার নকশায় আঁকা ছোট ছোট বই রাখার ঘর, যে ঘরগুলোকে বাইরে থেকে আঁকা হয়েছে বিভিন্ন রুপে, সাথে সঙ্গ দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ক্ষুদে ক্ষুদে আঁকিয়েরা।