লেখক -মোঃ হাবিবুর রহমান
১৩৫৮’বঙ্গাব্দের ৮’ই ফাল্গুন(২১’শে ফেব্রয়ারি, ১৯৫২) ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। জাতিসংঘ ১৯৯৯’সালের ১৭’ই নভেম্বর এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতির ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৪৭’সালের ৮’ই ডিসেম্বর বাঙালি ছাত্র সমাজ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের তা সমর্থন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তা নিয়ে তালবাহানা শুরু করে। শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, আইনজীবী, অনুবাদক, কবি, সাহিত্যিক, লোকবিজ্ঞানী, দার্শনিক, জ্ঞানতাপস, ভাষাসৈনিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ যুক্তি দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি উপস্থাপন করেন।
উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ও চারণভূমি। আপামর জনসাধারণ, ছাত্র সমাজ এবং জনসাধারণের মধ্যে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ গণ আন্দোলন দমন করার জন্যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৪৪ধারা জারি করে। ১৩৫৮’বঙ্গাব্দের ৮’ই ফাল্গুন(১৯৫২’সালের ২১’শে ফেব্রয়ারি) ১৪৪’ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মী মিছিল শুরু করে। একটি মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অমান্য করার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে শহিদ হন যথাক্রমে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান, আব্দুস সালাম সহ অনেকে। ভাষা শহিদদের আত্নত্যাগ ও আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানসরকার বাংলা ভাষাকে স্বাকৃতি দেয়। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বাকৃতি প্রদান করা হয়। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতি তাঁদের অন্যান্য অধিকার আদায় করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে বঙ্গবন্ধুর নামটিও জড়িত। ভাষা আন্দোলন চলাকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তাঁর এক স্মৃতি কথায় লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকলেও তিনি ভাষা আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতি সহ্য করতে পারে না। মূলত, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উৎযাপন করার বিষয়টি বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসৃত হয়েছে। এটা ইউনেস্কো-এর সাধারণ সম্মেলন কর্তৃক ১৯৯৯ সালে অনুমোদিত হয়েছে এবং ২০০০’সাল থেকে বিশ্বব্যাপী উৎযাপিত হয়ে আসছে। মূলত টেকসই সমাজব্যবস্থা স্থাপনের জন্যে সংস্কৃতি এবং ভাষাতাত্তি¡ক বৈচিত্র্যের বিষয়টি ইউনেস্কো বিশ^াস করে। এটা মূলত শান্তির আওতায় পড়ে যা সংস্কৃতি এবং পার্থক্যের বিষয়টি সংরক্ষণ করার পাশাপাশি সহিষ্ণুতা এবং অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি বিস্তৃত করে।
ভাষাতাত্ত্বিক বৈচিত্র ও কতিপয় ভাষা আজ হুমকির মুখে। বিশ্বব্যাপী ৪০% জনগণ তারা যে ভাষায় কথা বলে বা বুঝে সেই ভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো -টংরহম। মূলত প্রযুক্তি বহুভাষা শিক্ষা অগ্রসরের ভূমিকা এবং মানসম্মত শিক্ষার উন্নয়ন এবং সকলের জন্যে শিক্ষা সহায়তা পর্যালোচনাই মূখ্য বিষয়। বিশ্বব্যাপী আজ মাতৃভাষা দিবস উৎযাপিত হচ্ছে যা বাংলা ভাষাভাষি হিসেবে আমাদের জন্যে অত্যন্ত গৌরবের। এছাড়াও বিশে^র যে সকল দেশ, তাঁদের ভাষা বিপন্ন ও হুমকির মুখে তারা ভাষা আন্দোলনের থেকে শিক্ষা ও অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে। যে পাকিস্তান এক সময় এ বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেছিলো সে দেশের জনগণ আন্তর্জাাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। প্রতি বছরই বাংলা একাডেমি অমর একুশে বইমেলা আয়োজন করে থাকে। তবে মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে তা কয়েক বছর নিয়মিতভাবে আয়োজন করা ছিলো চ্যালেঞ্জ ও হুমকিস্বরূপ। তবে বিলম্বিত হলেও বাংলা একাডেমি এ বছর বইমেলা আয়োজন করেছে। বাংলা একাডেমি মূলত বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক। এবারের অমর একুশে বইমেলা-২০২২ বাংলা একাডেমি সুন্দর ও প্রানবন্ত আয়োজন করেছে। বাংলা একাডেমি মূল প্রাঙ্গন ছাড়াও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা আয়োজন করা হয়েছে। তরুণ, নতুন ও প্রবীণ লেখকদের প্রকাশিত প্রবন্ধ, কবিতার বই, উপন্যাস, ছড়া, গল্প ও অভিধান ইত্যাদি বইয়ে মেলার বিভিন্ন স্টল সাজানো হয়েছে। বইপ্রেমী, লেখক, গবেষক, পাঠক, পাঠিকা, কিশোর কিশোরী এবং সাধারণ মানুষ সাধ্যমত বই কেনার চেষ্টা করছেন।
মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাকে জাগ্রত ও একুশের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে এ বছর ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ২১ শে পদক প্রদান করা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে এককালীন নগদ ৪ (চার) লাখ টাকাসহ ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, রেপ্লিকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেয়া হয়েছে। এ বছর ভাষা আন্দোলন বিভাগে দুই জন যথাক্রমে মোস্তফা এম এ মতিন (মরণোত্তর) এবং মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল (মরণোত্তর) এবং মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে চার জন যথাক্রমে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ অধ্যক্ষ মো. মতিউর রহমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (মরণোত্তর), কিউ এ বি এম রহমান ও আমজাদ আলী খন্দকার কে পুরস্কৃত করা হয়। শিল্পকলা (শিল্প, সংগীত ও নৃত্য) বিভাগে সাতজন যথাক্রমে জিনাত বরকতুল্লাহ, সংগীতে নজরুল ইসলাম বাবু (মরণোত্তর), ইকবাল আহমেদ ও মাহমুদুর রহমান বেনু, অভিনয়ে খালেদ মাহমুদ খান (মরণোত্তর), আফজাল হোসেন ও মাসুম আজিজকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাংবাদিকতা বিভাগে এম এ মালেক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মো. আনোয়ার হোসেন এবং শিক্ষায় অধ্যাপক ডা. গৌতম বুদ্ধ দাসকে পুরস্কৃত করা হয়। সমাজসেবা বিভাগে দুই জন যথাক্রমে এস এম আব্রাহাম লিংকন ও সংঘরাজ ডা. জ্ঞানশ্রী মহাথেরোকে পুরস্কৃত করা হয়। ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন দুই জন যথাক্রমে কবি কামাল চৌধুরী ও ঝর্ণা দাস পুরকায়। গবেষণা বিভাগে চার জন যথাক্রমে ডা. মো. আব্দুস সাত্তার মন্ডল, ডা. মো. এনামুল হক (টিম লিডার), ডা. শাহানাজ সুলতানা (টিম) এবং ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস (টিম) কে পুরস্কার প্রদান করা হয়।
ভাষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ এবং বিশ্লেষকদের পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক আবুল কাশেম ফজলুল হক একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকেই অবলম্বন করা দরকার। অন্যদিকে ভালোভাবে ইংরেজি শেখানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও তিনি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা সুষ্ঠু ধারায় অগ্রসর করার জন্যে নৈতিক সচেতনার উপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়াও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করে বাংলা বর্ণমালা ক্ষণাবেক্ষণ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোন দিবসে আবদ্ধ না থেকে বর্ণমালার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জাগরিত থাকুক এটাই কামনা করছি।
লেখক -মোঃ হাবিবুর রহমান, গবেষক ও কলামিষ্ট