অষ্ট্রিয়ার স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী আনা হারিঙ্গার এর পরিকল্পনায় মাটি, খড় ও বাশ দিয়ে সাধারণ স্থাপত্যরীতিতে তৈরী একটি অভিনব স্কুলভবন। ২০০৭ সালে এ ভবনই হয়ে ওঠে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য। লাভ করে আগা খান পুরস্কার। ২০০২ সাল, অস্ট্রিয়ার লিনজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে গড়া স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের টোবিয়াস হাগলাইটনার, আনা হারিঙ্গার, পেটরা রাগের আর গুনার ভিলহেল্মকে পাঠানো হলো তাদের নতুন অধ্যয়নস্থল: বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরের বাইরের ছোট্ট এক গ্রাম রুদ্রপুরে।

বাংলাদেশে আসার আগে তাদের জানানো হলো, এটি বাংলাদেশের দরিদ্রতম গ্রামের একটি এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম। ওখানে তাদের পড়াশোনার মূল লক্ষ্য হবে: বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ছোট গ্রামটিকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখা ও বোঝার চেষ্টা করা। নির্দিষ্ট সময় এই গ্রামে কাটানোর পর ছাত্রছাত্রীর দলটি রুদ্রপুর নিয়ে তাদের বিচার-বিশ্লেষণ, ওখানকার ঘরবাড়ির ছবি, স্কেচ স্যুটকেস বোঝাই করে নিয়ে ফিরে এল অস্ট্রিয়ায়। এদের মধ্যে একজন আনা হারিঙ্গার সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তাঁর অভিসন্দর্ভ বা গবেষণামূলক নিবন্ধটি তৈরি করবেন রুদ্রপুরের ওপর। এবং পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো স্থানীয় স্থাপত্যকৌশল কাজে লাগিয়ে আধুনিক স্থাপত্যকলার সমন্বয়ে একটি স্কুল বানানো। অতি উচ্চমানের একটি অভিসন্দর্ভ রচিত হলো, যা শুধু কাগুজে নয়, সঠিক পরিকল্পনা অনুসরিত হলে এর বাস্তব রূপায়ণও সম্ভব। আনার এই স্বপ্নের বাস্তবায়নে এগিয়ে এল জার্মানির উন্নয়ন সংস্থার আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, আর বাংলাদেশ থেকে সাড়া দিল বেসরকারি সেবা সংস্থা দীপশিখা। কিন্তু পুরো পরিকল্পনার পালে সত্যিকারের হাওয়া লাগল আনার সঙ্গে জার্মান স্থপতি একে রসভাগের সঙ্গে সাক্ষাতের পর। আনার পরিকল্পনা দারুণভাবে আত্মস্থ করতে সক্ষম হলেন একে। আনার পরিকল্পনা আর একের স্থাপত্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা—দুইয়ের সমন্বয়ের ফল হলো রুদ্রপুরের স্কুল। বার্লিনের এক ক্যাফেতে বসে আনা একে রসভাগকে এক টুকরো ন্যাপকিনে স্কেচ এঁকে তাঁর স্বপ্নের স্কুলের বয়ান দিয়েছিলেন। খুবই সাধারণ স্থাপত্যরীতি: প্রচলিত রীতি মেনে একটি দোতলা স্থাপনা তৈরি হবে, যার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে একটি উন্মুক্ত সিঁড়ি। নিচের তলায় থাকবে তিনটি শ্রেণীকক্ষ, ওপরের তলায় থাকবে একই রকম তিনটি পড়ার ঘর—এগুলোর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করবে দুটো হলঘরের মতো খোলা কক্ষ। ওপরের তলার অধিকাংশ তৈরি হবে বাঁশ আর কাঠে। নিচের অংশ তৈরি হবে মোটা মাটির দেয়াল দিয়ে। গুহাসদৃশ কিছু খোলা ঘর থাকবে, যেখানে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা ও খেলাধুলা করবে।
pjimage (9)আগা খান পুরস্কার
আগা খান ফাউন্ডেশন ২০০৭ সালে সেরা স্থাপত্যের জন্য নির্বাচিত করে রুদ্রপুরের বাঁশ আর মাটির তৈরি স্কুলটিকে। পুরস্কারে বিচারকদের মন্তব্যে বলা হয়: দৃষ্টিনন্দন দোতলা এ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তৈরি হয়েছে স্থানীয় স্থাপত্যরীতি ও মালমসলায়। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্য ও পরিচয় প্রতিফলিত হয়েছে। এই স্থাপত্যরীতি হয়তো মুসলিম বিশ্বের আর কোথাও অনুসরণ করা সম্ভব হবে না—কিন্তু অঞ্চলভেদে এ ধরনের স্থাপনা মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। এই স্কুল ছাড়াও রুদ্রপুরে আনা হারিঙ্গার বানিয়েছেন কিছু মাটির বসতবাড়িও। স্কুলের মতো মাটির নতুন ধরনের বসতবাড়ি পেয়ে স্থানীয়রা খুশি।

রুদ্রপুরের আলাপচারিতা
বাংলাদেশের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দীপশিখা গ্রামের উন্নয়নে কাজ করে, পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে প্রস্তাবটি আসে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের হয়ে গ্রামেগঞ্জে কাজ করার। ‘আমার কাজ হলো বাংলাদেশের গ্রাম, এর কৃষিভিত্তিক সমাজ ও মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করা।’ ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে আসার আগে আনার মনে যথেষ্ট ভয় কাজ করেছে। ‘কিন্তু বাংলাদেশে গিয়ে আমার ধারণা পাল্টে যায়। বর্ণিল শাড়ি, আত্মবিশ্বাসী মানুষ। এখানে আসার পরই আমি বুঝি, সৌন্দর্য বিলাসিতা নয়, সৌন্দর্য কারও কারও জন্য আত্মপরিচয়েরও অংশ।

রুদ্রপুরে যে স্কুলটি আমরা বানাই, শুরুতে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল স্থানীয় নির্মাণশৈলীকে খাটো না করে প্রচলিত পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় ঘটানো। যে কারণে আমরা বেছে নিই মাটি আর বাঁশ। আর কাজে আমাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় নির্মাণশৈলীর সঙ্গে সৌন্দর্য যোগ করা। ‘দোতলা স্কুলঘরের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর আমি বিস্মিত হই বাংলাদেশের মানুষের নতুন ধরনের স্থাপত্যকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতায়।’ স্কুল ছাড়াও আনা রুদ্রপুর গ্রামে কিছু ঘরবাড়ির নির্মাণশৈলীতেও পরিবর্তন আনেন। ‘বাংলাদেশে এসে আমি এটাও বুঝি, স্থাপত্যকলা শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করা নয়, এর সঙ্গে জড়িত মানুষের পরিচয়, আত্মগরিমা। ‘আমাদের আরেকটা লক্ষ্য ছিল, গ্রামে বসবাস করেও যে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করা যায়, তা প্রমাণ করা। সুন্দর দৃষ্টিনন্দন স্কুল আর গোছানো বাড়িঘর ছিল এই পরিকল্পনারই অংশ।
pjimage (11)স্থপতি আনা হারিঙ্গার
১৯৭৭ সালের ১৩ অক্টোবর জার্মানির রোসেনহাইম শহরে আনা হারিঙ্গারের জন্ম। পরবর্তী সময়ে লোফেন শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা। বর্তমান নিবাস অস্ট্রিয়ার সালসবুর্গ শহর। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশে আসেন।
১৯৯৯-২০০৪ সাল পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার লিনজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করেন।
২০০৪ সালে তিনি ‘স্কুল—হ্যান্ডমেড ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রজেক্ট পরিচালনা করেন।
২০০৫ সাল থেকে তিনি বেজহ্যাবিট্যাটের প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ই তিনি জার্মানির উন্নয়ন সংস্থার অধীন আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (এমইটিআই) সঙ্গে বাংলাদেশে মাটির স্কুল বানানোর কাজে হাত দেন। এ সময় তার সঙ্গে যোগ দেন জার্মান স্থপতি একে রসভাগ। ২০০৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তিনি শান্তি পার্টনার্সশ্যাফট বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৮ সাল থেকে তিনি অস্ট্রিয়ার লিনজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে