বন্ধুরা বলছে চুপ করে থাক। সাবধানে থাক। কিন্তু চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিলেই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। যাবেনা । একই অবস্থা বোধ করি এখন দেশের বেশিরভাগ মানুষের মনে। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত এবং সেই নিশ্চিতেরই চেষ্টাই করছেন । নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না, চিন্তাও করছেনা । এভাবেই প্রতিদিন অনিরাপদ হয়ে পড়ছি আমরা সকলে। আর এ সুযোগটাই নিচ্ছে তারা।
জঙ্গিরা এর আগে পুলিশ হত্যা করেছে৷ ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর ঢাকায় গাবতলিতে জঙ্গিরা পুলিশের চেকপোস্টে এক সাব-ইন্সপেক্টরকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিল্প পুলিশের এক কনস্টেবলকে৷ ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর বামনডাঙ্গা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র এবং রেল স্টেশনে হামলা ও আগুন দেয় জামায়াত শিবির ক্যাডাররা। সে সময় পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় চার পুলিশ কনস্টেবলকে। এর আগে সন্ত্রাসীদের আক্রমনে ২০১৩ সালে ১৪ জন, ২০১৪ সালে ৩জন পুলিশ সদস্য হত্যার তথ্য পাওয়া যায়। এরও আগে ২০০৪ সালের ৮ জুলাই হরিনাকুন্ডু থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) জাহিদুল ইসলামকে বোমা মেরে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এছাড়াও পুলিশ সদস্য হত্যা করে প্রিজন ভ্যান থেকে শীর্ষ দুই জঙ্গী পালিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। সেময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন বাংলাদেশে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের স্থান হবে না।
কিন্তু গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে একই স্টাইলে ৪৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ এতে নিহত হয়েছেন ৪৭ জন৷ এসব হামলার অনেকগুলোরই দায় স্বীকার করেছে আইএস ও আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের কথিত বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। কিছু কিছু মাধ্যমে বলা হচ্ছে এজাতীয় ঘটনায় গত দেড় বছরে নিহত হয়েছেন ১৫০ জন। এরমধ্যে মাত্র চারটির চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। আর এসব ঘটনা জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪৬ জনকে। তাদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে ৪৯ জন। গ্রেফতারকৃতরা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে দাবি পুলিশের।
তবে পুলিশ পরিবারের সদস্যকে হত্যার ঘটনা এই প্রথম৷ এঘটনা নিয়ে যখন প্রশাসন ব্যবস্ত তখন এ ঘটনার ৭২ ঘন্টার মধ্যে দেশে সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের আরও দুই জন্য ব্যক্তির হত্য হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যতদিন যাচ্ছে জঙ্গীরা আরও বেশী সংগঠিত ও সুপরিকল্পিত ভাবে কাজ করছে। সেখানে প্রশাসন এখনও অনেকটা উদাসীন । প্রশ্ন একটাই কেন?
অতীতের বেশ কিছু ঘটনার মতো মিতুর হত্যাকারীরাও মোটর সাইকেলেই এসেছিল৷ এরইমধ্যে ওই এলাকার একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে তা স্পষ্ট হয়েছে৷ মোটর সাইকেলে মোট তিনজন আরোহী ছিলেন৷ পুলিশ সেই মটরসাইকেলটিও পরিত্যাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেছে৷ মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনাকে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যনান্য হত্যার ধরনের সাথে মেলালে অনেক সমীকরণের মিল পাওয়া যায়। তাই এখনও কোন জঙ্গী গোষ্ঠি এর দায় স্বীকার না করলেও সূত্র মিলিয়ে এ হত্যাকান্ডের সাথে জঙ্গী সম্পৃক্ততার আভাসই মেলে।
তারপরও দেশে জঙ্গী আছে জঙ্গীনেই বিতর্কে লেগে রয়েছে রাজনৈতিক দল গুলি মধ্যে। আর এজন্য বোধ করি পুলিশেও অনেকটা উদাসিন ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজেই বলেছেন, ‘‘অব্যাহতভাবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে, জঙ্গিদের দমন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের পুলিশ ফোর্স যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে কাজ করছে, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য, এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে।
‘‘পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর এটা স্পষ্ট যে, জঙ্গিরা তাদের কৌশল পরিবর্তণ করছে৷ তারা ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন ধর্ম এবং বিদেশি হত্যার পর এখন পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য হত্যা করল৷ তারা আগে পুলিশ হত্যা করেছে, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের ওপর আঘাত এই প্রথম৷ তারা এখন পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সক্রিয়, তাদের এভাবে দুর্বল করে দিতে চাইছে৷ এর মাধ্যমে তারা বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
এরকম পরিস্থিতিতে রাজধানীর পল্লবীর কালশীতে দুজন জেএমবির সদস্য ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। রাজধানীর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের-ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম জানান এ বিষয় নিশ্নিত করেছেন। নিহতদের একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক প্রফেসর রেজাউল করিম হত্যাকাণ্ড এবং অন্যজন বগুড়া শিয়া মসজিদে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।
পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যার পর জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্যদের বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ও এসব সদস্যরা সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গীতৎপরতায় যুক্ত ছিল বলে পুলিশের বিবৃতিকে প্রসাশনের নড়ে চড়ে বসা বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। কিন্তু এঘরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে খুব একটা কার্যকর বিগত সময়েও হয়নি। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৃণমূল থেকে কাজ করা প্রয়োজন বলছেন তারা।
এদিকে মঙ্গলবার অ্যামনেস্টির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সংস্থার দণি এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক চম্পা প্যাটেল দাবি করেন, ‘‘বাংলাদেশ সরকারের কাছে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি জানানো হলেও তারা তেমন সাড়া দিচ্ছেনা৷ ধারাবাহিক এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তারা নিজেদেরই আত্মরার কথা বলছেন৷ মাঝে মধ্যে হুমকির শিকার হওয়াদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় অধিকারের সুরায় আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির লঙ্ঘন৷’
গেলো কয়েক বছরে উন্নতির নানা সূচকেই ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। উন্নতির এই ধারাকে ব্যাহত করার জন্যই বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্তে মেতেছে দেশি বিদেশি নানা গোষ্ঠী বলাই যেতে পারে। দেশে কোনও হত্যাকান্ড ঘটে যাওয়ার পর আইএসের হয়ে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের দায় স্বীকার সেই চক্রান্তের ইঙ্গিত এরই একটি উদাহরণ হতে পারে।
‘বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং সারা বিশ্বে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, সেটাকে আমলে নিতে হবে। সেটাতে জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক কোনও মহল সেটাতে খুশি নাও থাকতে পারেন। সেই বিষয়ে আমাদের দলমত নির্বিশেষে একমত হয়ে আমাদের করণীয় ঠিক করা দরকার। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? এই করতে করতে যেয়ে যেন বিড়ালের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা না হয়। এই বিতর্ক নিয়ে মেতে থেকে চোখ বন্ধ করে থাকলে কি উগ্রপন্থীদের হাতে অস্বাভাবিক ভাবে মানুষের নিহত হওয়ার কমবে ? অথবা কমে যাবে উগ্রপন্থা?
সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে স্পর্শকাতর এই বিষয়ে সিরিয়াস হওয়ার তাগিদ সরকার ও প্রশাসনকে অনেক আগে থেকেই দেয়া হচ্ছে। এখন বোধ করি এ বিষয়টি জাতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব হিসিবে বিবেচিত হবে এবং এই অবস্থা মোকাবেলায় সব রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়কে একমত হয়ে কাজ করবে। আর বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার মনোভাবের কারণেই এসব উগ্রবাদীরা এক সময় পিছু হটবেই এ বিশ্বাস করতে চায় দেশের জনগণ।
লেখক: আবু হেনা মোস্তফা জামাল, গনমাধ্যম কর্মী।