গত বছর জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের ‘বিশ্ব জনসংখ্যা সম্ভাবনা ২০২২’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছে গিয়েছে ৮ বিলিয়নে যেখানে চীন ও ভারত যৌথভাবে বিশ্বের মোট ৩৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী। ঐ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যা ছিল ১.৪২৬ বিলিয়ন আর ভারতের ১.৪১২ বিলিয়ন। আর সম্প্রতি গত ১৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)- ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩’-এর বার্ষিক প্রতিবেদন (যেখানে বরাবর বিশ্ব জনসংখ্যার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ ক্রমধারা, চ্যালেঞ্জ, এবং টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনার চিত্র ও দিক নির্দেশনা থাকে) অনুযায়ী ২০২৩ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা পৌঁছে গিয়েছে ৮.০৪৫ বিলিয়নে- যেখানে ভারতের ১.৪২৮৬ বিলিয়ন- আর চীনের ১.৪২৫৭ বিলিয়ন। ফলে এ প্রতিবেদন অনুযায়ী এ বছর এপ্রিল বা এর পরবর্তী কোন এক সময়ে ভারতের জনসংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে যাবে বা গিয়েছে। ফলে এ নিয়ে বিশ্ব মিডিয়াতে নানা আলোচনা- কী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে চীনে। কোন কোন মিডিয়াতে চীনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকাও প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে কোন রূপ ভীতি বা আশংকা সংবাদের পরিবর্তে এ ক্ষেত্রে যৌক্তিক ও প্রমাণ্য নির্ভর আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজনেই আমার আজাকের এ লেখা।
প্রশ্ন হলো- কেন এবং কেমন করে চীনের জনসংখ্যায় এ পরিবর্তন আসলো? এ বিষয়টিকে জনমিতিক প্রক্রিয়া (জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তর)- এর ভেতর দিয়ে ব্যাখা করা যেতে পারে। তবে জনমিতিক সংক্রমণ মডেল অনুযায়ী, জন্মহার ও মৃত্যু হার এখানে মুখ্য ভূমিকা রাখে- অর্থাৎ জন্মহার ও মৃত্যু হারের হ্রাসবৃদ্ধির কারণে কোন দেশের জনসংখ্যার আকার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তারতম্য ঘটে। দীর্ঘ মেয়াদে ও বর্তমান সময়কাল বিবেচনায় এটি লক্ষ্যনীয় যে, চীনের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ভারতের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশ কম। ফলে ভারতের জনসংখ্যার আকার বাড়ছে এবং তা জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী এ বছর (২০২৩) চীনকে জনসংখ্যার আকারে অতিক্রম করছে বা করেছে। ফলে ভারত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনসংখ্যাবহুল দেশ। ১৯৫০- ১৯৬০-এর দশকে চীনের উচ্চ মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ছিল ৫ থেকে ৬-এর মতো। অর্থাৎ ১৫-৪৯ বছর বয়স্ক একজন বিবাহিত নারী গড়ে ৫ থেকে ৬ জন সন্তান প্রসব করতো। ফলশ্রুতিতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার লক্ষ্য করা গিয়েছে এবং তা ছিল প্রায় ৩ শতাংশের কাছাকাছি। এ অবস্থায় চীনা সরকার সমগ্র দেশব্যাপী পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচী গ্রহণ করে যেখানে কৌশল ছিল- দেরিতে বিয়ে ও দেরীতে সন্তান ধারণ; সন্তান গ্রহনোত্তর বিরতিতে সন্তান নেয়া, এবং বিনামূল্যে আধুনিক জন্মনিরোধক সরবরাহ। ফলে টিএফআর ১৯৭১ সালে ছিল ৫.২৭ যা ১৯৭৯ সালে দাঁড়ায় ২.৬৬-এ। প্রজনন হার হ্রাসে চমৎকার সাফল্য পেলেও চীনের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বিবেচনায় রেখে চীন সরকার সন্তান গ্রহণ নীতিকে ১৯৮০ সালে আরও জোরদার করে এক সন্তান নীতি প্রণয়ন করে। পরবর্তীতে টিএফআর আরও কএম আসে। ২০০০ সালে চীনের টিএফআর পৌঁছে যায় ১.২২; ২০১০ সালে ১.১৮ এবং ২০২০ সালে ১.৩০ যা প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজননহার (২.১)-এর চেয়ে বেশ কম। ফলে চীনা সরকার ২০১৬ সালে দুই সন্তান নীতি গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে তিন সন্তান নীতি গ্রহণ করে ২০২১ সালে। বর্তমানের নিম্ন প্রজনন হার ( টিএফআরঃ ১.২, বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩) প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগতে পারে- চীনে ক্ষেত্রে কি প্রধাণ প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে? এটি চীনা সরকারের নীতিমালার কারণে নাকি আর্থসামাজিক উন্নয়নের কারণে? বর্তমানে চীন সরকার এখন টিএফআর বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতি কৌশল নিয়ে কাজ করছে। উল্লেখ্য যে, এক সন্তান নীতি চীনের উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসে সফল ছিল। চীন সরকার তখনকার বাস্তবতায় আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন তথা জীবন মান উন্নয়নে সার্বিকভাবে এক সন্তান পরিবার পরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করলেও ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্নতা ছিল। পাশাপাশি চীনের আধুনিকায়নে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নগরায়নের হার বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও আকাঙ্ক্ষা, সন্তান লালন-পালনে উচ্চ ব্যয়, আগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দেরীতে বিয়ে ও দেরীতে সন্তান ধারণ, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি প্রভৃতি এ প্রজনন হার হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। চীন ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য যায়- যেখানে শিক্ষা, নগরায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে মোট প্রজনন হারও কমে আসার অনেক উদাহরণ রয়েছে – যেমন ভারত, বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, উন্নয়নের লক্ষ্য হলো সকল মানুষের জীবনের গুণগত মানের উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে জনসংখ্যার পরিমাণগত আকারের পাশাপাশি জনসংখ্যার গুণগত উন্নয়নও অত্যাবশ্যক। জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ভাবনায় বর্তমান বিশ্বে সকলের জন্য সহনশীল ভবিষ্যৎ,সুযোগকে কাজে লাগানো এবং অধিকার ও পছন্দ নিশ্চিত করাই হচ্ছে সকল রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে সংখ্যার চেয়ে ব্যক্তির অধিকার ও পছন্দই মুখ্য যা ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৫-১৩ তারিখে মিশরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সন্মেলন (আইসিপিডি)- র মূল উপজীব্য বিষয়। এ লক্ষ্যে আইসিপিডি এক মাইলফলক যেখানে জনসংখ্যার গুণগত দিক তথা অধিকারের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় প্রথম বারের মতো। আইসিপিডি-তে চীনসহ পৃথিবীর ১৭৯টি দেশ জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত কর্মসূচী চূড়ান্ত করে যার কেন্দ্রে রয়েছে অধিকার ও উন্নয়ন। তখন থেকেই জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ে এক ‘প্যারাডাইম’ শিফট ঘটে যেখানে জনসংখ্যার পরিমাণগত দিক থেকে গুণগত দিকেই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলোতে লাভ করে বিশেষ গুরুত্ব যা জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ে দেশীয় ও বৈশ্বিক নীতি-পরিকল্পনায় সংযুক্ত হয়। এ ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের সম-অধিকার, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার, ব্যক্তির মানবাধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণ করা টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত । প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার পরিকল্পনার বিষয়গুলো অধিকতর গুরুত্ব পায় যা জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ভাবনার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি- পরিকল্পনায় যুক্ত হয়। জনসংখ্যা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ- এর আন্তঃ সম্পর্ক; জেন্ডার সমতা, সমদর্শিতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন; পরিবারঃ পরিবারের ভূমিকা, অধিকার, গঠন এবং কাঠামো; জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও কাঠামো; প্রজনন অধিকার ও প্রজনন স্বাস্থ্য; স্বাস্থ্য, রোগ ও মরণশীলতা; জনসংখ্যা বন্টন, নগরায়ন ও স্থানান্তর; আন্তর্জাতিক স্থানান্তর; জনসংখ্যা, উন্নয়ন ও শিক্ষা; প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও গবেষণা; জাতীয় কর্মকৌশল; আন্তর্জাতিক সহযোগিতা; বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্ব এবং সন্মেলনের ফলো আপ বা অগ্রগতি পর্যালোচনার বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । ফলে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে আইসিপিডি যেন এক মাইলফলক। ফলে এক্ষেত্রে জনসংখ্যা বাড়ানো বা কমানো নয় বরং সকলের সুযোগ গ্রহণে সমান প্রবেশগম্যতা ও সুযোগকে কাজে লাগাতে প্রতিবন্ধকতা দূর করা- প্রান্তিক বা পিছিয়ে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠী যেমন, নারী, যুব, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও স্থানান্তরিত বা মাইগ্রেন্ট জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা। জনমিতিক সহনশীলতা নিশ্চিত করতে সকলের মানবাধিকার- ব্যক্তির প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ও পছন্দকে গুরুত্ব প্রদান।
উপরোক্ত আইসিপিডি-এর প্রেক্ষাপটে বর্তমান চীনকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসের সাথে সাথে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে। চীন বিশ্বে এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। মোট প্রজন হার (টিএফআর) হ্রাস পেলেও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)- বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনে এখন ৬৯% জনগোষ্ঠী বিশাল কর্মক্ষম যাদের বয়স ১৫-৬৪ বছর। প্রথম জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সময়কাল এখনো শেষ হয়ে যায়নি চীনের। আরও এক দশক (২০২৩-২০৩৩) পর্যন্ত (মধ্যমেয়াদি প্রক্ষেপণ দৃশ্যপট অনুযায়ী) মোট নির্ভরশীলতার হার অনুকুলে থাকবে বা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে চীন। ফলে এ সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ত্বরায়ণ নির্ভর করছে বয়স-কাঠামোর পরিবর্তনে কর্মক্ষম এ জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক নীতি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণের ওপর। ফলে চীন যদি এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারে এবং জনমিতিক চ্যালেঞ্জকে ব্যবস্থাপনা করতে পারে তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। মনে রাখতে হবে যে, জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন শুধু সংখ্যার পরিমাণ নয় বরং তা নির্ভর করে গুণগত দিকেরও উপর। জনসংখ্যার সার্বিক গুণগত দিক, বিশেষ করে শিক্ষা যা ক্রমাগত বাড়ছে চীনে- স্থিতিশীল ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে মানব সম্পদ সৃষ্টি ও প্রযুক্তিগত বিল্পবের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো দরকার। উল্লেখ্য যে, বর্তমান চীনে মানব পুজির স্টক বাড়ছে- একই সাথে নতুন শ্রমবাজারে শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতাও বাড়ছে- চাইনিজ ট্যালেন্ট ডিভিডেন্ড ক্রমশ বাড়ছে যা প্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়নের জন্য বেশ সহায়ক হতে পারে। বিশ্ব ব্যাংকের উন্নয়ন সুচকের ২০২১ এর তথ্য বলছে- চীনে ৭৩% মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বিশ্বব্যাংকের আরও তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালেই চীনে ২৫ বছরের উপরে নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছে ৬৫.৩% মানুষ। আর এ ক্ষেত্রে ২২.৩% মানুষ কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছে। চীন মানব সম্পদের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ করছে। প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ও ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম গ্রহণ করছে। মান সম্পন্ন বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটছে আজকের চীনে যা ইতমধ্যেই লক্ষ্য করা গিয়েছে। ফলে বিশ্বের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে ও আন্তর্জাতিক র্যাংকিং-এ শীর্ষে উঠে আসছে- চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
উল্লেখ্য যে, চীনের ইর্ষনীয় অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি জনমিতিক ক্ষেত্রে মোট প্রজনন হার পেলেও জীবন আয়ুষ্কাল উন্নীত হয়েছে ৭৮.২ বছরে (সুত্রঃ ন্যাশনাল হেলথ কমিশন-এনএইচসি ২০২১) । জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩ অনুযায়ী জন্মকালে চীনে পুরুষের জীবন আয়ুষ্কাল ৭৬ বছর আর নারীর ৮২ বছর। এ ক্ষেত্রে ভারতে ২০২৩ সালে পুরুষের ৭১ বছর আর নারীর ৭৪ বছর আর বাংলাদেশে যথাক্রমে ৭২ ও ৭৬ বছর। চীনের এ অগ্রগতির পাশাপাশি নতুন ও উদ্ভূত চ্যালেঞ্জও লক্ষ্যনীয়। জনসংখ্যার বয়স কাঠামোতে আশাব্যঞ্জক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি দ্রুত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে । জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩ বলছে- চীনে ৬০ বছর বা উপরে রয়েছে মোট প্রায় ২০% মানুষ আর ৬৫ বছরের উপরে রয়েছে ১৪%-এরও বেশী। ফলে চীন এখন মধ্যম মানের এইজিং চলছে। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর বেড়ে যাওয়া ও প্রজনন হার কমে যাওয়ার ফলে চীনকে এখন কৌশল নিতে হবে কি করে দ্বিতীয় জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের এ সুযোগের সদ্ব্যবহার এবং তা দীর্ঘায়ন করার ওপর। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ এক্ষেত্রে কার্যকর। ফলে একই সাথে বয়স্ক মানুষের অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও সামাজিক যত্নের দিকে বিশেষ নজর প্রদান করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার নিশিচত করতে হবে।
শ্রমবাজারে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনে সহায়ক। চীনে ভারত ও বাংলাদেশের তুলনায় অধিকতর নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ রয়েছে। চীনে এ হার ৬২% তবে ভারতে ও বাংলাদেশে তা যথাক্রমে ১৯% ও ৩৫% (বিশ্ব ব্যাংক)। তবে লক্ষ্যনীয় যে, জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনে যুব বেকারত্ব একটি বাধা। চীন, ভারত ও বাংলাদেশে উচ্চ যুব বেকারত্বের উপস্থিতি রয়েছে। চীনে এ হার ১১.২৬% আর ভারতে ও বাংলাদেশে যথাক্রমে ২৮.৩% ও ১২.৮% (বিশ্ব ব্যাংক)। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অবদান নির্ণয়ের সূচক- ‘মানব পুজি সূচক’ অনুযায়ী ২০১৭-২০২০ সালে চীনের মান ছিল উচ্চ (০.৭) যা ভারত ও বাংলাদেশ থেকে বেশী। মানব পুঁজি হতে হলে করতে হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ। ২০২১ সালে চীন শিক্ষায় মোট জিডিপির ৪.১% ব্যয় করেছে। আর সরকার ২০১৯ সালে চীনে মোট জিডিপির ৫.৩৫% সরকার ব্যয় করেছে স্বাস্থ্যে যা ছিল ভারতে ও বাংলাদেশে যথাক্রমে ৩.০১% ও ২.৪৮% (বিশ্বব্যাংক) । জাতিসংঘের বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩ অনুযায়ী, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা আওতা সুচকেও চীন ভারত ও বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে (চীন=৮২, ভারত=৬১, বাংলাদেশ=৫১)।
তবে আধুনিক চীন উন্নয়নের এক রোল মডেল- বিশাল জনসংখ্যাবহুল দেশটিতে দারিদ্র দূরীকরণে রয়েছে ইর্ষনীয় সাফল্য। বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৯ এর তথ্যানুযায়ী চীনে মাথা পিছু ২.১৫ ডলারের নিচে (২০১৭ পিপিপি) রয়েছে মাত্র ০.১% মানুষ। পাশাপাশি এও লক্ষ্যনীয় যে, চীনে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে । ২০২০ সালের জনশুমারি অনুযায়ী চীনে প্রায় ৬৪% মানুষ এখন নগরে বাস করে। বিভিন্ন কারণে মানুষ শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। নগর জীবনে উদ্ভূত হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। জন্মহার হ্রাস পেলে নগরের শ্রমবাজারে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের বিশেষ করে সুলভ গ্রামীন শ্রমিকরা নগরে ব্যবধান ঘোচাতে পারে। এর পাশাপাশি বহিঃবিশ্বে আন্তর্জাতিক স্থানান্তরের ব্যাপারেও নজর দিতে হবে চীনকে। এছাড়া চীনকে শিশুর জন্মকালে লিঙ্গানুপাতে ব্যবধান ক্রমান্বয়ে কমে আসছে বা পরিবর্তন আসছে। কার্যকর নীতি- কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে জেন্ডার সমতা বা ভারসাম্য আনয়ন করতে হবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে।
বর্তমান বাস্তবতায় নিম্ন প্রজনন হার থেকে প্রজনন হার বৃদ্ধিতে চীনের বর্তমান উৎপাদন ও ভোগে কোন প্রভাব স্বল্প বা মধ্য মেয়াদে পড়ার কোন আশংকা না থাকলেও কাঠামোগত পরিবর্তনে চীন কিভাবে ব্যবস্থা নেয় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রম বর্ধমান বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে চীন সরকার কী কার্যকর ভূমিকা নেয় তা বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। চীনের জনসংখ্যা ভারতের পর বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আসলেও চীনের বর্তমান জনসংখ্যা (১.২৪৬ বিলিয়ন) কিন্তু সমগ্র ইউরোপ (৭৪৪ মিলিয়ন) ও সমগ্র আমেরিকা (১.০৪ বিলিয়ন)-মহাদেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশী কিংবা বলা যতে পারে সমগ্র আফিকা মহাদেশের প্রায় সমান (১.২৪৭ বিলিয়ন)। ৮ বিলিয়ন বিশ্বের জনসংখ্যায় এটি একটি বড় সংখ্যা- বড় চ্যালেঞ্জ এবং একই সাথে বড় সম্ভাবনা। ২০২২ সালের জাতিসংঘের প্রাক্কলিত হিসাবে জনসংখ্যার মধ্যমেয়াদী দৃশ্যপট প্রক্ষেপণে চীন ইতমধ্যেই ‘পিক’ বা শিখরে জনসংখ্যায় পৌঁছেছে কী না তা নিয়ে একাডেমিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতান্তর থাকলেও এ কথা ঠিক যে এক সময় না এক সময় চীনের জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকবে যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হবে। ফলে চীনের জনসংখ্যাকে ভারত অতিক্রান্ত করছে বা করেছে- এ বার্তাকে চীনের দুঃশ্চিন্তার বিষয় বলে ভাববার কিছু নেই বরং চীন ও বিশ্বকে দেখতে হবে- চীনের প্রগতি ও উন্নতির প্রতীক হিসাবে এবং ব্যক্তিগত অধিকার ও পছন্দকে বেঁছে নেবার আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিফলন হিসাবে।
জনসংখ্যার গুণগত উন্নয়নই চীনের শক্তি । মানব পুজি সৃষ্টির আধার হিসাবে- বিশেষ করে টেকসই বা বজায়যোগ্য উন্নয়ন এজেন্ডা-এসডিজিকে ও এসডিজি উত্তর বিশ্ব সমাজ বাস্তবতায়-যেমন- জলবায়ুজনিত ও অন্যন্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়। চীনের দরকার জনসংখ্যাকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিদুতে রেখে পপুলেশন ডিনামিকসকে অনুধাবন এবং সে অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কর্ম-উদ্যোগ গ্রহণ করা- মানুষের গুনগত উন্নয়নে অধিকার ও পছন্দকে নিশ্চিত করা। এ জন্য পলিসি ডিবেট ও ক্রিটিক্যাল আলোচনাকে অব্যাহত রাখতে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে দরকার মানুষের জীবনের গুণগত উন্নয়নে অধিকার নিশ্চিতকরণ ও পছন্দকে বেছে নেওয়ার সক্ষমতা বা সামর্থ্য সৃষ্টি করা ও অব্যাহত রাখা।
লেখক: ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম, অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।