ফসলের ঋতু হেমন্তের শুরু এক মাস আগেই। কার্তিকের প্রথম দিন নতুন ঋতুকে স্বাগতও জানানো হয়। এক সময় মরা কার্তিকে এসে কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে যেত। অভাব দেখা দিত খাবারের। সবাই তখন তাকিয়ে থাকত অগ্রহায়ণের দিকে। অগ্রহায়ণের শুরুতে ঘরে উঠত নতুন ধান, সেই ধান থেকে বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হত পিঠা-পুলিসহ নানান পদের খাবার, উৎসবের ধুম পড়ে যেত ঘরে ঘরে। তবে যতদিন গেছে ততই বদলে গেছে হিসাব-নিকাশ। কার্তিক আর আগের মতো নেই। এ মাসেও পাওয়া যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধান।
বস্তুত শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। তবে বাঙালীর নবান্ন উৎসবের রেশ রয়ে গেছে আজও অমলিন। এখন কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। বরগুনা, রংপুর, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলার কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কিষানী। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন সেগুলোর অন্যতম। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা যখন চালু হয়েছিল, অনুমান করা হয়, তখন থেকেই নবান্ন উৎসব উদ্যাপন হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। ফসল কাটার আগে কৃষকরা বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখতেন। বাকি ধান থেকে চাল করে সে চালে পায়েস করা হতো। এছাড়াও নবান্ন উৎসবের দিন গৃহস্থ বাড়িতে নানা পদ রান্না হতো। শাক, ভর্তা, ভাজিসহ কুড়ি থেকে চল্লিশ পদের তরকারি রান্না করা হতো কোনো কোনো বাড়িতে। এবারে এমন এক সময়ে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে যখন গোটা বিশ্বে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ছে বিভিন্ন দেশ। শঙ্কামুক্ত নয় বাংলাদেশও। মুদ্রাস্ফীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। এমনকি দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। এ অবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। উৎপাদন বাড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়ে আজ বুধবার উদ্যাপিত হবে নবান্ন উৎসব ১৪২৯।
আজ বুধবার সকালে শিল্পকলা একাডেমির খোলা প্রাঙ্গণে নবান্ন উৎসবের আয়োজন রয়েছে। দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজক জাতীয় নবান্ন উৎসব উদ্যাপন পর্ষদ। অনুষ্ঠান শুরু সকাল সাড়ে ৭টা থেকে। দুপুরের দিকে বিরতি দিয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে উৎসব। আয়োজকদের পক্ষে নাঈম হাসান সুজা জানান, :এবারও শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরে মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। মঞ্চ সজ্জায় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে লোক চেতনাকে। সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রামীণ নানা অনুষঙ্গ। উৎসব মঞ্চ থেকে নাচ গান কবিতা ও কথায় নবান্ন উৎসবের ঐতিহ্য তুলে ধরা হবে। ফসলকেন্দ্রিক অর্থনীতির চিত্র ফুটিয়ে তোলা হবে। জয়গান করা হবে কৃষকের।” বিশেষ করে এবার অর্থনৈতিক মন্দার কালে ফসল উৎপাদনে আরও বেশি মনোযোগী হতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হবে বলে জানান তিনি।
আয়োজন সম্পর্কে পর্ষদের আরেক সদস্য মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, “বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অথচ আমরা ভয়ংকরভাবে আমদানি নির্ভর হয়ে গেছি। ফসলের জমি নষ্ট করে অট্টালিকা গড়ছি। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে কমছে উৎপাদন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আমরা তাই উৎসব মঞ্চ থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার আহ্বান জানাব।”